ত্রিপুরায় দু'দেশের ব্যবসায়ীদের বৈঠকে শেখ হাসিনা-সম্পর্ক সুদৃঢ় করার এ সুযোগ বিফলে যেতে দেওয়া যাবে না

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সম্প্রতি নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। দু'দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় করার এ সুযোগ বিফলে যেতে দেওয়া হবে না। এ সুযোগ যাতে বিফলে না যায় সেদিকে প্রত্যেককে সজাগ থাকতে হবে। গতকাল বিকেলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার প্রজ্ঞা ভবনে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের এক বৈঠকে বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার বিশাল ক্ষেত্র বিদ্যমান। সত্যিকার সহযোগিতা তখনই সম্ভব যখন রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে।


প্রধানমন্ত্রী অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনসহ যে কোনো দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নিষ্পত্তির জন্য ভারতকে আরও উদার হওয়ার আহ্বান
জানান। বাংলাদেশের চাহিদা মেটাতে ত্রিপুরা থেকে বিদ্যুৎ আমদানির আগ্রহও ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে কাজে লাগাতে দু'দেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এগিয়ে আসবেন, যাতে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিশেষ করে ত্রিপুরার জনগণ লাভবান হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জনগণের ভাগ্য একই সুতায় গাঁথা। আমি মনে করি দারিদ্র্যই আমাদের এ অঞ্চলের প্রধান শত্রু। সে জন্য মানুষের জীবনমান উন্নয়নই আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (সিআইআই) ও এফবিসিসিআই যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, ভারতের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী কপিল সিবাল, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, শিল্পমন্ত্রী জিতেন্দ্র চৌধুরী, এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদ এবং সিআইআই কর্মকর্তা শেখর দত্ত বক্তৃতা করেন। শেখ হাসিনা এর আগে দু'দিনের সরকারি সফরে ত্রিপুরা পেঁৗছেন।
ব্যবসায়ীদের সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্পর্ক উন্নয়নে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ফলে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, অমীমাংসিত সীমানা নির্ধারণ, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিদ্যুৎ ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। তিনি বলেন, সড়ক, রেল, জল ও আকাশপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঢাকা থেকে কলকাতা ও আগরতলার মধ্যে সরাসরি বাস চলাচলের ব্যবস্থা করেছিলেন। এরই মধ্যে মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতে মালপত্র পরিবহন এবং আখাউড়া-আগরতলা হয়ে ত্রিপুরায় কার্গো পরিবহনের জন্য আশুগঞ্জ নৌবন্দর ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ পথে আপনাদের পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কার্গো পরিবহনের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা বিদ্যমান অবকাঠামোর ওপর প্রচ চাপ সৃষ্টি করেছে। এ জন্য আখাউড়া-আগরতলার মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপন এবং ফেনী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাগরোম-রামগড় পয়েন্টে একটি নতুন স্থল শুল্কবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্থলবন্দর এবং স্থল শুল্কবন্দরের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধির জন্য দু'দেশের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধাগুলো দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যমান বাণিজ্য বৈষম্যের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক দেশ। বাংলাদেশ ভারত থেকে বছরে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য আমদানি করে। ভারতে রফতানি করে মাত্র ২৫০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এ বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে প্রথমে ৪৬ ধরনের বস্ত্রপণ্যের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার এবং সাফটার আওতায় সব ধরনের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক দামে বাংলাদেশের পণ্য ভারতের বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সব চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল আগরতলায় রাজ্যভবনে তিনি ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির সঙ্গে এক বৈঠকে দু'দেশের মধ্যে সব চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বৈঠক আধাঘণ্টা স্থায়ী হয়।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, শেখ হাসিনার ত্রিপুরা সফরকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি বলেছেন, পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
'ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী
কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ভূখণ্ড
ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না'
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য বাংলাদেশ তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না। দু'দেশের মধ্যে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা স্বাক্ষরের উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা কখনও ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেব না।' গতকাল সন্ধ্যায় আগরতলায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে তার সঙ্গে ত্রিপুরার গভর্নর ডি. যশবন্ত রাওপাতিল ও মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার সাক্ষাৎ করলে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় ১৬ লাখ বাংলাদেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ত্রিপুরা সরকারকে ধন্যবাদ জানান। ভারতের কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিবালও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা অর্থনীতি, তিস্তা চুক্তির বর্তমান অবস্থা, টিপাইমুখ বাঁধ ও নদী শাসন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম, মুখ্যসচিব শেখ মোঃ ওয়াহিদ উজ জামান ও প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
লালগালিচা সংবর্ধনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু'দিনের সরকারি সফরে গতকাল বিকেলে আগরতলা পেঁৗছলে তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী এবং তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইট ভারতীয় সময় দুপুর ৩টা ১০ মিনিটে আগরতলার সিঙ্গেরবিল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী কপিল সিবাল, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার ও শিল্পমন্ত্রী জিতেন্দ্র চৌধুরী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দরে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা শেষে শেখ হাসিনাকে শহরতলির কুঞ্জবন অতিথি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সফরকালে তিনি সেখানেই থাকবেন। কুঞ্জবন অতিথি ভবনে পেঁৗছলে শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার, ভারতের কেন্দ্রীয়মন্ত্রী কপিল সিবাল, ত্রিপুরার বিরোধীদলীয় নেতা রতন নাথ এবং কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
প্রধানমন্ত্রী আজ ত্রিপুরা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির নবম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করবে। ১৯৮৭ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর শেখ হাসিনা প্রথম বিদেশি নেতা যাকে এ সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনা, নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি এবং শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকারের স্বীকৃতিস্বরূপ এ ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ হামিদ আনসারি প্রধানমন্ত্রীর হাতে এ ডিগ্রি তুলে দেবেন।
এর আগে বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীরা দুপুর ৩টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করেন।

No comments

Powered by Blogger.