সোনালি ছবির গল্প-সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল!
ছেলে-বুড়ো সবার পছন্দের একটি ছবি 'ছুটির ঘণ্টা'। জনপ্রিয় এই ছবিটি নির্মাণের গল্প জানাচ্ছেন পরিচালক আজিজুর রহমান নিজেই। ১৯৭৮ সাল। আমার 'অশিক্ষিত' ছবিটি মাত্র তখন মুক্তি পেয়েছে। সারা দেশে ছবিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনাও চলছে। এমন সময় হঠাৎ একদিন 'দৈনিক বাংলা'য় প্রকাশিত একটি সংবাদ চোখে পড়ল। নারায়ণগঞ্জের একটি স্কুলের বাথরুমে ১৫ দিন বন্দি থাকার পর এক ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু।
ঠিক করলাম এ ঘটনার ওপরই ছবি তৈরি করব। সেদিন রাতেই শুরু করলাম পাণ্ডুলিপি লেখার কাজ। ১৫ দিন একটানা কাজ করে চিত্রনাট্য দাঁড় করালাম। কিন্তু সংলাপগুলো মনের মতো হচ্ছিল না। পাণ্ডুলিপি নিয়ে এটিএম শামসুজ্জামানের কাছে গেলাম। তিনি গল্প শুনে 'থ' হয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, 'এ কী করেছ? শুটিং করবে কোথায়? এই ছেলেটার ভূমিকায় কে অভিনয় করবে?' আমি বললাম, 'ভাই, সেসব পরে দেখা যাবে। আগে আমার কাজটা করে দিন।' অবশেষে তিনি এবং লতিফুজ্জামান দুজনে মিলে সংলাপ লিখে দিলেন। এবার অভিনয়শিল্পী চূড়ান্ত করার পালা। শুরুতে গেলাম রাজ্জাকের কাছে। তিনি তখন 'অশিক্ষিত' ছবির সাফল্যে খুশিতে ভাসছেন। প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু এটিএমের মতো সেই একই প্রশ্ন। ছেলেটির ভূমিকায় কে অভিনয় করবে? আমি বললাম ভাবছি। কাউকে তখনো বলিনি ছবিটি সত্যদার স্ত্রী রমলা সাহা প্রযোজনা করবেন। আর এই ছেলেটির ভূমিকায় অভিনয় করবেন তাঁদেরই ছেলে ইমন। আমি জানতাম যদি পেশাদার অভিনয় করা কোনো ছেলেকে দিয়ে চরিত্রটি করাই তাহলে তা খুব কৃত্রিম মনে হবে। ইমন এর আগে 'অশিক্ষিত' ছবিতে অভিনয় করেছিল। সেখানে একটি কবরের দৃশ্যে অভিনয় করার সময় ইমন অনেক ভয় পেয়েছিল। সত্যদা নাকি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইমনকে আর অভিনয় করতে দেবেন না। কিন্তু এই ছবির জন্য তিনি আর না বললেন না। অন্যান্য শিল্পীও দিনকয়েকের মধ্যে চূড়ান্ত হয়ে গেল। শাবানা, সুজাতা, শওকত আকবর, এ টি এম শামসুজ্জামান, শর্বরীসহ অনেক নামিদামি তারকাকে এ ছবির জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হলো।
এবার শুরু হলো লোকেশন খোঁজার পালা। গল্প অনুযায়ী আমার এমন একটি লোকেশন লাগবে যেখানে স্কুল এবং ছেলেটির বাড়ির মধ্যে বেশ খানিকটা দূরত্ব হলেও স্কুল থেকে যেমন ছেলেটির বাড়ি দেখা যাবে। বাড়ি থেকেও তেমনি যেন স্কুল দেখা যায়। স্কুলের আঙিনায় বড় একটি মাঠও লাগবে। যেখানে ছেলেমেয়েরা খেলার সময় বন্দি ছেলেটি দেখতে পেলেও তাকে কেউ দেখতে না পায়। চারদিকে ইউনিটের লোকজনদের পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু কেউ এমন লোকেশনের কোনো খোঁজ দিতে পারল না। শেষ পর্যন্ত বাইরের একজনের মুখে শুনলাম কাপ্তাইয়ে নাকি এমন একটি লোকেশন আছে। পরদিনই আমি ছুটলাম সেখানে। যা চেয়েছিলাম ঠিক তাই। শুটিং শুরু হলো। ৯০ জনের একটি ইউনিট নিয়ে আমরা কাপ্তাই গিয়েছিলাম। টানা ২০ দিন শুটিং করলাম। হাজার হাজার মানুষ এল শুটিং দেখতে। একমাত্র টয়লেটের দৃশ্যটি ছাড়া বাকি সব দৃশ্য আমরা কাপ্তাইতে শেষ করেছিলাম। টয়লেটের দৃশ্যটি করার জন্য এফডিসিতে সেট তৈরি করা হয়েছিল। যেহেতু ছেলেটি ১৫ দিন টয়লেটে বন্দি থাকবে তাই ঠিক করলাম এক দিনে নয়, পুরো ১৫ দিন ধরেই দৃশ্যটির শুটিং করব। তাহলে ইমনও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবে। শুটিং শেষ হলো। এবার সেন্সরের পালা। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে আটকে দিল। ছবিটি নাকি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলে ছেলেমেয়েরা দেখে ভয় পাবে। কেউ আর স্কুলে যেতে চাইবে না। সত্যদা তো চিন্তায় পড়ে গেলেন। এতগুলো টাকা! আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই। বিভিন্ন স্কুল থেকে বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়ে এবং অভিভাবকদের নিয়ে ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করলাম। সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষও উপস্থিত থাকল। কোনো বাচ্চাই ছবিটি দেখে ভয় তো পেলই না, উপরন্তু অভিভাবকরা ছবিটি দেখে আরো সচেতন হওয়ার কথা ভাবলেন। এবার ছবিটি ছাড়পত্র পেল। প্রথম সপ্তাহে আমরা ৩৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিয়েছিলাম। সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহল পর্যন্ত সবাই অনেক প্রশংসা করেছিলেন। পত্রিকাগুলোতে ছবিটি নিয়ে কলাম লেখাও হয়েছিল। তা ছাড়া কঙ্বাজার ও ফেনীতে হারিয়ে যাওয়া দুটি বাচ্চাকে তাদের মা-বাবা স্কুলে খুঁজে পেয়েছিলেন। ছবিটির আরেকটি অর্জন ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ইমনও শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিল।
অনুলিখন : সুদীপ কুমার দীপ
এবার শুরু হলো লোকেশন খোঁজার পালা। গল্প অনুযায়ী আমার এমন একটি লোকেশন লাগবে যেখানে স্কুল এবং ছেলেটির বাড়ির মধ্যে বেশ খানিকটা দূরত্ব হলেও স্কুল থেকে যেমন ছেলেটির বাড়ি দেখা যাবে। বাড়ি থেকেও তেমনি যেন স্কুল দেখা যায়। স্কুলের আঙিনায় বড় একটি মাঠও লাগবে। যেখানে ছেলেমেয়েরা খেলার সময় বন্দি ছেলেটি দেখতে পেলেও তাকে কেউ দেখতে না পায়। চারদিকে ইউনিটের লোকজনদের পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু কেউ এমন লোকেশনের কোনো খোঁজ দিতে পারল না। শেষ পর্যন্ত বাইরের একজনের মুখে শুনলাম কাপ্তাইয়ে নাকি এমন একটি লোকেশন আছে। পরদিনই আমি ছুটলাম সেখানে। যা চেয়েছিলাম ঠিক তাই। শুটিং শুরু হলো। ৯০ জনের একটি ইউনিট নিয়ে আমরা কাপ্তাই গিয়েছিলাম। টানা ২০ দিন শুটিং করলাম। হাজার হাজার মানুষ এল শুটিং দেখতে। একমাত্র টয়লেটের দৃশ্যটি ছাড়া বাকি সব দৃশ্য আমরা কাপ্তাইতে শেষ করেছিলাম। টয়লেটের দৃশ্যটি করার জন্য এফডিসিতে সেট তৈরি করা হয়েছিল। যেহেতু ছেলেটি ১৫ দিন টয়লেটে বন্দি থাকবে তাই ঠিক করলাম এক দিনে নয়, পুরো ১৫ দিন ধরেই দৃশ্যটির শুটিং করব। তাহলে ইমনও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবে। শুটিং শেষ হলো। এবার সেন্সরের পালা। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে আটকে দিল। ছবিটি নাকি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলে ছেলেমেয়েরা দেখে ভয় পাবে। কেউ আর স্কুলে যেতে চাইবে না। সত্যদা তো চিন্তায় পড়ে গেলেন। এতগুলো টাকা! আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই। বিভিন্ন স্কুল থেকে বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়ে এবং অভিভাবকদের নিয়ে ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করলাম। সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষও উপস্থিত থাকল। কোনো বাচ্চাই ছবিটি দেখে ভয় তো পেলই না, উপরন্তু অভিভাবকরা ছবিটি দেখে আরো সচেতন হওয়ার কথা ভাবলেন। এবার ছবিটি ছাড়পত্র পেল। প্রথম সপ্তাহে আমরা ৩৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিয়েছিলাম। সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহল পর্যন্ত সবাই অনেক প্রশংসা করেছিলেন। পত্রিকাগুলোতে ছবিটি নিয়ে কলাম লেখাও হয়েছিল। তা ছাড়া কঙ্বাজার ও ফেনীতে হারিয়ে যাওয়া দুটি বাচ্চাকে তাদের মা-বাবা স্কুলে খুঁজে পেয়েছিলেন। ছবিটির আরেকটি অর্জন ছিল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ইমনও শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিল।
অনুলিখন : সুদীপ কুমার দীপ
No comments