কল্পকথার গল্প-পুরনো গল্পের নতুন সংস্করণ by আলী হাবিব

ইংরেজিতে রি-টোল্ড বলে একটা কথা আছে। নতুন করে বলা। কিন্তু নতুন কী আর বলা যেতে পারে! আমাদের জীবনে তো সেই 'থোড়-বড়ি-খাড়া, আর খাড়া-বড়ি-থোড়।' এর বাইরে তো কিছু নেই। বড্ড ঝামেলা চারদিকে। অনেকেরই মনে হতে পারে, কোথাও শান্তি নেই। ঘরের শান্তি কেড়ে নিয়েছে বাজার। বাজারের শান্তি কেড়ে নিয়েছে জিনিসপত্রের দাম। বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবেন? উপায় নেই। বাসভাড়া বেড়ে গেছে।


ভাবতে পারেন, এ আর এমন কি? বাংলাদেশ তো সেই দেশ, যেখানে নানা অজুহাতে বাড়ে জিনিসপত্রের দাম। জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর কারণ খুঁজতে এখানে খুব বেশি হাতড়ে বেড়াতে হয় না। সূর্য ডুবতে বসেছে, তো জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। আকাশে মেঘ করেছে, এই অজুহাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। কখনো কখনো ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু তার পরও জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। বাসের ভাড়া বাড়ে। বাড়িভাড়া বাড়ে। সব মিলিয়ে বাড়াবাড়ির খেলা শুরু হয়ে যায়। হতাশ কেউ কেউ কপালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেন, এমন তো কথা ছিল না। কথা ছিল বেশ সুখে থাকব আমরা। তা ঠিক। কিন্তু এটাও ঠিক, কখনো কখনো আমাদের সুখে রাখতেও নাকি দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
যাক সে কথা। আমরা একটু গল্পের দিকে যাই। ঈশ্বরের গল্প। ঘটনাটা হঠাৎ করেই ঘটে গেল। বাংলাদেশে যেমন সকালবেলা খবরের কাগজ পড়ে দেশের মানুষ জানতে পারে, মধ্যরাত থেকে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে, অনেকটা সে রকম। ওয়ান ফাইন মর্নিং দেবতারা দেখলেন, ঈশ্বর স্বর্গধামে নেই। প্রথম দিকে কেউই ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। কিন্তু একের পর এক কয়েকটা দিন চলে গেল। ঈশ্বরকে পাওয়া যাচ্ছে না। যে সময়ের এ গল্প, তখন খবরের কাগজ ছিল না। ছিল না আজকের মতো এত এত টেলিভিশন চ্যানেল। আকাশজুড়ে স্যাটেলাইট ছিল না। তা ছাড়া ঈশ্বর নিজে থেকেই যখন ডুব দিয়েছেন, তখন কারো তো আর কিছু করার নেই।
যাহোক, দিন সাতেক পর স্বর্গধামে ঈশ্বরের দেখা মিলল। তিনি দেবতাদের ডাকলেন। তখন সন্ধে পেরিয়ে গেছে। দেবতারা সবাই উৎকণ্ঠিত। প্রধান দেবতা অনেকটা ভেঙে পড়া গলায় বললেন, 'পরমেশ্বর, আপনি এ কয় দিন কোথায় ছিলেন?'
ঈশ্বর আঙুল দিয়ে একদিকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, 'তাকিয়ে দেখ।'
দেবতারা দেখলেন, কী যেন একটা বেশ আলোয় ঝলমল করছে। দেখতে বেশ। গাছপালা আছে। স্বর্গের মতোই নদী বয়ে যাচ্ছে সেখানে। উড়ছে প্রজাপতি ও পাখি। ফুল ফুটে আছে। ফুলে ফুলে উড়ে উড়ে মধু সংগ্রহ করছে মৌমাছি। এসব দেখে দেবতারা একটু বোধ হয় ঘাবড়েই গিয়েছিলেন। তাঁরা চুপচাপ ভাবছিলেন, ঈশ্বরের এটা আবার কোন খেলা, কে জানে! ঈশ্বর প্রধান দেবতাকে উদ্দেশ করে বললেন, কী ভাবছ? প্রধান দেবতা দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, 'পরমেশ্বর তো অন্তর্যামী। আমাদের মনের খবর আপনার অজানা নয়। আপনি জানেন, আমরা কী ভাবছি।' ঈশ্বর বললেন, 'এটা আমার নতুন সৃষ্টি। এই জায়গাটি পৃথিবী নামে পরিচিত হবে। এখানে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চা হবে। এখানে যারা বসবাস করবে, তারা মানুষ নামে পরিচিত হবে। এই মানুষের নানা রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকবে। এখানে কিছু লোক রাজনীতি করে নিজেদের অবস্থা ফেরাবে। এই ধরনের মানুষ যারা, তাদের পরিচিতি হবে রাজনীতিবিদ।' ঈশ্বরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রধান দেবতা বললেন, 'কিন্তু ঈশ্বর, এদের কথা শোনার মতো কিছু মানুষও তো লাগবে। সবাই রাজনীতিবিদ হয়ে গেলে চলবে কেমন করে?' ঈশ্বর মৃদু হেসে বললেন, 'কিছু বোকা লোকও সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে ব্যালান্স হবে কেমন করে।'
এখন এই গল্পের হাল সংস্করণ বা রি-টোল্ড করলে কী দাঁড়ায়? বলা যাক গল্পটা। ওয়ান ফাইন মর্নিং দেবতারা দেখলেন ঈশ্বর স্বর্গধামে নেই। কোথায় গেলেন? না, তা নিয়ে ভাবলে দেবতাদের চলবে না। ঈশ্বর সবাইকে নিয়ে ভাবেন। সবার ভালো ও মন্দ দেখেন। তিনি নিশ্চয় কোনো কাজে ব্যস্ত আছেন, যে কারণে দেবতারা কেউই তাঁর দেখা পাচ্ছেন না। তো, দিন সাতেক পর একদিন ঈশ্বর দেখা দিলেন। দেবতাদের ডেকে নিলেন। দেবতাদের বললেন, ওদিকে তাকাও। ঈশ্বর যেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন, সেদিকে তাকিয়ে দেবতারা দেখলেন, আলো ঝলমলে নতুন একটা দেশ। দেখতে বেশ। সবুজ সবুজ গাছপালা। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। মাঠে গরু চরছে। কৃষক কাজ করছে। স্বর্গের মতোই নদী বয়ে যাচ্ছে সেখানে। উড়ছে প্রজাপতি ও পাখি। ফুল ফুটে আছে। ফুলে ফুলে উড়ে উড়ে মধু সংগ্রহ করছে মৌমাছি। ঈশ্বর বললেন, "এটা আমার নতুন সৃষ্টি। এই জায়গাটি পৃথিবী নামে পরিচিত হবে। এখানে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চা হবে। এখানে যারা বসবাস করবে, তারা বাঙালি বলে পরিচিত হবে। এই বাঙালিদের নানা রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকবে। এখানে কিছু লোক রাজনীতি করে নিজেদের অবস্থা ফেরাবে। এই ধরনের মানুষ যারা, তাদের পরিচিতি হবে রাজনীতিবিদ। ফাঁকা মাঠে হঠাৎ গাছের চারা গজিয়ে যাওয়ার মতো কিছু কিছু মানুষ নতুন নতুন তন্ত্র নিয়ে রাজনীতিবিদ হয়ে যাবে। নানা ইজম, অর্থাৎ নানা 'বাদ' বাতলাবে এরা। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, এদের কথার প্রতিবাদ করার মতো লোকও অনেক সময় পাওয়া যাবে। এই 'বাদ' আর ওই 'বাদ'অলাদের মধ্যে হয়তো বাদ-প্রতিবাদ হবে। হবে ঘাত-প্রতিঘাত।" ঈশ্বরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রধান দেবতা বললেন, 'কিন্তু ঈশ্বর, এদের কথা শোনার মতো কিছু মানুষও তো লাগবে। সবাই রাজনীতিবিদ হয়ে গেলে চলবে কেমন করে?' ঈশ্বর মৃদু হেসে বললেন, 'কিছু বোকা লোকও সৃষ্টি করতে হবে সেখানে। তা না হলে ব্যালান্স হবে কেমন করে?'
ব্যালান্স করতে গেলে অনেক কিছুই করতে হয়। অনেক সময় ঋণ করে হলেও ঘি খেতে হয়। কিন্তু সেই ঘি খাওয়া যে সব সময় সুখের হয় না, সেটা আমাদের বিলক্ষণ জানা আছে। অনেক সময় বাইরেরটা দেখে আমরা ভুল করে বসি। এমন একটা গল্প আগে বলে নেওয়া যাক। এক ভদ্রলোক রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। আচমকা একটা ট্রাক তার ওপরে উঠে গেল। এমন ঘটনা বাংলাদেশে হরহামেশাই ঘটে। এ গল্পটি অবশ্য বাংলাদেশের নয়। যাহোক, ভদ্রলোক স্বর্গে যাবেন। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। স্বর্গের দ্বাররক্ষক আটকে দিলেন তাঁকে। ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, তাঁকে আটকে দেওয়ার কারণ। দ্বাররক্ষক জানালেন, আজ বাদে কাল এখানে ভোট হবে। আপনাকে ভোট দিতে হবে। স্বর্গ ও নরকের মধ্যে ভোট হচ্ছে। আপনাকে প্রথমে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হবে। আপনি ঘুরে ঘুরে স্বর্গ দেখবেন। এরপর আপনাকে নরক দেখানো হবে। আপনি নরক দেখবেন। তারপর আপনি স্থির করবেন, কোথায় অনন্তকালের জন্য আবাস গড়বেন আপনি। ভদ্রলোককে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো নরকে। নরকের অধিবাসীরা তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে গেলেন ভেতরে। সেখানে সবুজ মাঠে গলফ খেলা হচ্ছিল। তিনিও কিছুক্ষণ গলফ খেললেন। কিঞ্চিৎ পান-ভোজনের ব্যবস্থাও ছিল। তাঁকে আপ্যায়ন করা হলো। একটু নাচ-গানের ব্যবস্থাও ছিল। তিনি বেশ আনন্দে সময় কাটালেন। তাঁর যাওয়ার সময় হয়ে এল। এবার নরকের সবাই এসে একে একে তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। বিদায় জানালেন। ভদ্রলোককে এবার নিয়ে যাওয়া হলো স্বর্গে। তিনি ঘুরে ঘুরে স্বর্গের প্রতিটি জায়গা দেখলেন। না, স্বর্গের ব্যবস্থাও খারাপ নয়। এখানেও আছে সবুজ মাঠ। এখানেও পাখি গান গায়। বয়ে যাচ্ছে নদী। গাছে গাছে ফুল ফুটে আছে। কিন্তু সবাই কেমন যেন নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। ভদ্রলোক নিজের মতো করে ঘুরলেন। একসময় স্বর্গ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হলো তাঁর। তিনি স্বর্গ থেকে বিদায় নিলেন। স্বর্গের দ্বাররক্ষক তাঁকে নিয়ে গেলেন একটি বিশ্রামকক্ষে। সেখানে রাতে থাকবেন তিনি। এরপর সকালে তিনি স্থির করবেন, কোথায় থাকবেন তিনি অনন্তকাল। সকালে আবার স্বর্গের দ্বাররক্ষক ফিরে এলেন। জানতে চাইলেন, তিনি কী স্থির করেছেন। ভদ্রলোক বললেন, আমি স্বর্গ ও নরক ঘুরে দেখলাম। স্বর্গ সম্পর্কে তো মর্ত্যে থাকতেই অনেক কিছু জেনেছি। স্বর্গ তার চেয়েও সুন্দর। কিন্তু নরক? নরক সম্পর্কে মর্ত্যে আমাদের যা জানানো হয়েছে, তা একেবারেই ভুল। আমি নরক দেখে মুগ্ধ। জানি, স্বর্গ অনন্ত শান্তির জায়গা। কিন্তু তার পরও আমি নরকে যেতে চাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, নরক কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমী। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো নরকে। সেখানে নরকের দূত তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নিয়ে গেলেন ভেতরে। এবার নরকে গিয়ে তিনি তো অবাক! এ কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে তাঁকে। গতকালের দেখা নরকের চেহারার সঙ্গে আজকের নরকের তো কোনো মিল নেই। কাল যে নরকের দূতের পরনে ছিল ঝলমলে পোশাক, আজ তাঁর পরনে ছেঁড়া জামা। ভদ্রলোক নরকের দূতকে বললেন, কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমি তো নরকে আসতে চেয়েছি। এ আমাকে কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে? নরকের দূত জানালেন, এটাই নরক। ভদ্রলোক বললেন, কিন্তু কাল আমি যে নরক দেখে গেছি, তার সঙ্গে তো এর মিল নেই। নরকের দূত বললেন, কাল ছিল আমাদের প্রচারের দিন। আজ তো আপনি ভোট দিয়ে ফেলেছেন। কাজেই আপনাকে এখানেই থাকতে হচ্ছে।
এই গল্পের রি-টোল্ড কী হবে? এটা আপনারা তৈরি করে নিন।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.