মমতার মাথাব্যথা রাজ্য নিয়ে-উপমহাদেশ by এম শফিকুল করিম
বছর দুয়েক আগে যখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের রাজধানী নয়াদিলি্ল যাই তখন মনে মনে ভেবেছিলাম, সেখানে অন্তত দু'জন বাঙালি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের অভিমত নেব। তারা হচ্ছেন ক্ষমতাসীন ইউপিএর প্রভাবশালী মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এবং শরিক দল তৃণমূলের সভানেত্রী মমতা ব্যানার্জি। মমতা তখন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী প্রণব অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ, ভারতের রাজনীতিতে তাকে বলা হয়, ট্রাবল শ্যুটার আর মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, বলতে গেলে দিলি্লতে তার দেখা পাওয়া দুষ্কর। প্রায় সর্বক্ষণই তাকে দেখা যেত কলকাতায় ব্যস্ত দিন কাটাতে। ভারতের বিশাল রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তিনি পরিচালনা করতেন কলকাতায় বসে।
দিলি্লর এক সাংবাদিক বন্ধুর সহায়তায় মমতার বিশেষ সহকারী রতনের সঙ্গে পরিচয় হয় তারই বাড়িতে। তিনি কথা দিয়েছিলেন, দিদি, দিলি্ল এলেই কোনো এক ফাঁকে আমাকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি, এমনকি পরবর্তী দেড় বছরেও তা হয়নি। আমার পক্ষে তখন কলকাতা যাওয়া সম্ভব ছিল না। কেননা কলকাতায় ছিলেন আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি। তবে হ্যাঁ, কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকা 'সংবাদ প্রতিদিন'-এর দিলি্ল ব্যুরো চিফ গৌতম লাহিড়ী এক ছুটির দিনে আমাকে প্রণব বাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমবার যখন মমতা ব্যানার্জি দিলি্ল আসেন তখন দিলি্ল প্রেস ক্লাবে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মতবিনিময়ের জন্য। এর আগেও আরও যে ক'টি রাজ্যে নির্বাচন হয়েছিল, যেমন আসাম ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী যথাক্রমে তরুণ গগৈ এবং নিতীশ কুমারও এসেছিলেন এমনি আয়োজনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমি এ দুটি সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থিত হয়েছিলাম এবং শুনেছিলাম তাদের কথা।
মমতা এসেছিলেন ২১ জুন। বাংলাদেশ থেকে আমি একমাত্র সাংবাদিক, যে কি-না এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটি ব্যাপারে মমতার ব্যাখ্যা নেওয়া। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি পশ্চিমবঙ্গের কী কী করবেন, তার একটা বিস্তারিত ফিরিস্তি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতেও তিনি পিছপা হলেন না। বিগত ৩৪ বছর বাম সরকার পশ্চিমবঙ্গকে কী অবস্থায় নিয়ে গেছে তার বিস্তারিত তুলে ধরলেন এ অনুষ্ঠানে।
দিলি্লর এ ধরনের মতবিনিময় ভাষা সব সময় ইংরেজি, যাতে সবাই সেটা বুঝতে পারেন। আমি অনেক আগেই হাত তুলে রেখেছিলাম প্রশ্ন করার জন্য। প্রেস ক্লাবের সভাপতি যিনি অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছিলেন, এক সময় আমাকে ডাকলেন প্রশ্ন করার জন্য। আমি আমার পরিচয় দিয়ে ইংরেজিতে মমতা ব্যানার্জির অনুমতি চাইলাম, উপস্থিত একমাত্র বাংলাদেশের সাংবাদিক হিসেবে আমি তাকে বাংলা প্রশ্ন করতে পারি কি-না। তিনি সহাস্যে অনুমতি দিলে জানতে চাইলাম, যখন তিনি রেলমন্ত্রী তখন ভারতের একটি সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক 'টাইমস অব ইন্ডিয়া'য় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল, বাংলাদেশ যতই চিন্তা-ভাবনা করুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে যাবেন না। রিপোর্টটিতে একটি ইঙ্গিত ছিল, মমতার সায় ছাড়া তিস্তা চুক্তিও হবে না। আমার প্রশ্ন ছিল, 'এ রিপোর্ট ছাপার পরও আপনার মন্ত্রণালয় থেকে কোনো রকম প্রতিবাদ আসেনি। আপনি কি মনে করেন, রিপোর্টটি সঠিক ছিল?' অনেকের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আপনি বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। প্রশ্ন শুনে তিনি হাসলেন এবং বাংলাতেই উত্তর দিলেন_ 'বাংলাদেশ আমাদের বিশেষ বন্ধুপ্রতিম দেশ। বাংলাদেশ সরকার চাইলেই আমরা এ বিষয়ে আলাপ করব।' তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ এবং তার জনগণ রয়েছে আমার হৃদয়ে।' আমি অতি যত্নসহকারে এ রিপোর্টটি ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। মনে হয়েছে, মমতা ব্যানার্জি যেন আমার প্রশ্নটা এড়িয়েই গেলেন।
এ প্রসঙ্গে দিলি্লর এক সাংবাদিকের কথা আজ আমার বারবার মনে পড়ছে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'মমতাকে বোঝা বড় কঠিন। উনি কী বলেন আর কী করেন এ দুটোর মাঝে বিস্তর ফারাক।' তিনি আমাকে এও বলেছিলেন, 'দেখুন, তিস্তা নিয়ে কী হয়।' তিনি বলেছিলেন, 'আমি মমতাকে ছোটবেলা থেকে জানি, উনি খুব আনপ্রেডিক্টেবল।' বিশেষ করে দুটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফর নিয়ে প্রচুর বৈঠক করেছিলেন এবং সেসব বৈঠকের কিছু প্রতিবেদন আমি ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। যেহেতু বিষয়বস্তু নিয়ে যারা আলাপ করছিলেন, তাদের ব্রিফিং পাইনি। ফলে আমার প্রতিবেদনগুলো কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। জানতাম, মনমোহন সিং ঢাকায় এলে অনেক কিছুই ঘটতে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, আমি যখন দিলি্লর পাট চুকিয়ে ঢাকায় রওনা দেব, সেই সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আমাকে দুপুরে একটি পাঁচতারা হোটেলে খাবার নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
দু'জনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল মনমোহন সিংয়ের ঢাকা আগমন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক একটি বিশেষ জায়গায় চলে গেছে। তিনি সম্প্রতি ভারতের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের ঢাকা সফরের ঘটনাগুলো আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, এত অল্প সময়ে এত অধিকসংখ্যক মন্ত্রীর কোনো দেশ সফর নজিরবিহীন।
মনমোহন সিং ঢাকায় আসার আগে একটা এসএমএস পেলাম সেই সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে। তিনি আসছেন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে। আমরা এর আগেই জেনে গিয়েছিলাম, এ সফরে আর যাই হোক তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। ৬ সেপ্টেম্বর আমি হোটেল রূপসী বাংলায় দেখা করতে গেলাম সেই সাংবাদিকের সঙ্গে। ভয় ছিল, তিনি আমাকে দিলি্লর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, 'কী সফিকদা, কী বলেছিলাম?' প্রথম দেখাতেই যে ভয়টি করছিলাম, সেটি-ই ঘটল। তিনি বললেন, 'কি আমার কথা ঠিক হলো তো?' আমি বললাম, তখন বুঝতে পারিনি যে ঘটনা এ পর্যায়ে দাঁড়াবে। তার সঙ্গে পরে যখন নিচে লবিতে নামলাম, দেখা হলো কলকাতা থেকে আসা অনেক সাংবাদিকের সঙ্গে। তারাও মমতার ওপর বেজায় খ্যাপা। তাদের ভাষায়, এতদিনের প্রতীক্ষিত সফর মমতা ব্যানার্জির কারণে সফল হলো না! যাওয়ার আগে দিলি্লর সেই সাংবাদিক আমাকে বলে গেলেন, 'বুঝলেন, মমতা ভারতের রাজনীতি করেন না। উনি করেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে কী এলো কী গেল_ এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তার মাথাব্যথা কেবল পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে। এ লেখা লিখতে বসে আমার মনে পড়ে গেল গঙ্গা চুক্তির কথা। তখন বাংলাদেশের এক প্রবীণ সাংবাদিককে দেখা গিয়েছিল ঢাকা-কলকাতা ছোটাছুটি করতে এবং এক পর্যায়ে তিনি নাকি মমতার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। পাছে তিনি বিগড়ে যান, যদিও মমতা তখন কেবল তৃণমূল সভানেত্রী আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তখনকার বাংলাদেশের নেতৃত্ব চেয়েছিলেন সবদিক বজায় রেখে যাতে গঙ্গা চুক্তি হয়। হয়েছিলও তাই। গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির সময় আমি দিলি্লর ঐতিহাসিক হায়দ্রাবাদ হাউসে উপস্থিত ছিলাম এবং ঢাকায় তার প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলাম।
মমতা তার রাজনীতি করেছেন; কিন্তু আমরা কি আমাদের রাজনীতি করতে পেরেছি? গঙ্গা চুক্তির সময় আমরা যেভাবে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সেটা সফল করতে পেরেছিলাম, এবার কেন তা পারলাম না। আমার মনে হয়, আমরা সমস্যাটাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখিনি।
এত সবের পরও বাংলাদেশ সরকারের একটি পদক্ষেপ আমার খুব ভালো লেগেছে। সেটি হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেদিন ঢাকা এলেন সেই সকালেই ভারতের হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে বলে দেওয়া হলো, যেহেতু এ সফরে তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না, তাই বাংলাদেশ ট্রানজিট নিয়ে কোনো আলোচনা করবে না। বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ছোট রাষ্ট্র হতে পারে, তবে তার রয়েছে স্বাধীন সত্তা।
আমরা আশা করছি, দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তিস্তা পানি বণ্টনসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে একটি সমঝোতায় পেঁৗছবে। তবে সে কাজটি যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল। আর হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সফল নাও হতে পারে। কাজেই আলোচনা মমতার মতামত গুরুত্বসহকারে ভারত সরকার বিবেচনা করবে_ এ বিশ্বাস আমাদের আছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ ও ভারত তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করবে।
এম শফিকুল করিম :সাংবাদিক
দিলি্লর এক সাংবাদিক বন্ধুর সহায়তায় মমতার বিশেষ সহকারী রতনের সঙ্গে পরিচয় হয় তারই বাড়িতে। তিনি কথা দিয়েছিলেন, দিদি, দিলি্ল এলেই কোনো এক ফাঁকে আমাকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি, এমনকি পরবর্তী দেড় বছরেও তা হয়নি। আমার পক্ষে তখন কলকাতা যাওয়া সম্ভব ছিল না। কেননা কলকাতায় ছিলেন আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি। তবে হ্যাঁ, কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকা 'সংবাদ প্রতিদিন'-এর দিলি্ল ব্যুরো চিফ গৌতম লাহিড়ী এক ছুটির দিনে আমাকে প্রণব বাবুর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমবার যখন মমতা ব্যানার্জি দিলি্ল আসেন তখন দিলি্ল প্রেস ক্লাবে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মতবিনিময়ের জন্য। এর আগেও আরও যে ক'টি রাজ্যে নির্বাচন হয়েছিল, যেমন আসাম ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী যথাক্রমে তরুণ গগৈ এবং নিতীশ কুমারও এসেছিলেন এমনি আয়োজনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। আমি এ দুটি সংবাদ সম্মেলনেও উপস্থিত হয়েছিলাম এবং শুনেছিলাম তাদের কথা।
মমতা এসেছিলেন ২১ জুন। বাংলাদেশ থেকে আমি একমাত্র সাংবাদিক, যে কি-না এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটি ব্যাপারে মমতার ব্যাখ্যা নেওয়া। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি পশ্চিমবঙ্গের কী কী করবেন, তার একটা বিস্তারিত ফিরিস্তি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতেও তিনি পিছপা হলেন না। বিগত ৩৪ বছর বাম সরকার পশ্চিমবঙ্গকে কী অবস্থায় নিয়ে গেছে তার বিস্তারিত তুলে ধরলেন এ অনুষ্ঠানে।
দিলি্লর এ ধরনের মতবিনিময় ভাষা সব সময় ইংরেজি, যাতে সবাই সেটা বুঝতে পারেন। আমি অনেক আগেই হাত তুলে রেখেছিলাম প্রশ্ন করার জন্য। প্রেস ক্লাবের সভাপতি যিনি অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছিলেন, এক সময় আমাকে ডাকলেন প্রশ্ন করার জন্য। আমি আমার পরিচয় দিয়ে ইংরেজিতে মমতা ব্যানার্জির অনুমতি চাইলাম, উপস্থিত একমাত্র বাংলাদেশের সাংবাদিক হিসেবে আমি তাকে বাংলা প্রশ্ন করতে পারি কি-না। তিনি সহাস্যে অনুমতি দিলে জানতে চাইলাম, যখন তিনি রেলমন্ত্রী তখন ভারতের একটি সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক 'টাইমস অব ইন্ডিয়া'য় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, যেখানে লেখা ছিল, বাংলাদেশ যতই চিন্তা-ভাবনা করুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে যাবেন না। রিপোর্টটিতে একটি ইঙ্গিত ছিল, মমতার সায় ছাড়া তিস্তা চুক্তিও হবে না। আমার প্রশ্ন ছিল, 'এ রিপোর্ট ছাপার পরও আপনার মন্ত্রণালয় থেকে কোনো রকম প্রতিবাদ আসেনি। আপনি কি মনে করেন, রিপোর্টটি সঠিক ছিল?' অনেকের ধারণা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে আপনি বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। প্রশ্ন শুনে তিনি হাসলেন এবং বাংলাতেই উত্তর দিলেন_ 'বাংলাদেশ আমাদের বিশেষ বন্ধুপ্রতিম দেশ। বাংলাদেশ সরকার চাইলেই আমরা এ বিষয়ে আলাপ করব।' তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ এবং তার জনগণ রয়েছে আমার হৃদয়ে।' আমি অতি যত্নসহকারে এ রিপোর্টটি ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। মনে হয়েছে, মমতা ব্যানার্জি যেন আমার প্রশ্নটা এড়িয়েই গেলেন।
এ প্রসঙ্গে দিলি্লর এক সাংবাদিকের কথা আজ আমার বারবার মনে পড়ছে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, 'মমতাকে বোঝা বড় কঠিন। উনি কী বলেন আর কী করেন এ দুটোর মাঝে বিস্তর ফারাক।' তিনি আমাকে এও বলেছিলেন, 'দেখুন, তিস্তা নিয়ে কী হয়।' তিনি বলেছিলেন, 'আমি মমতাকে ছোটবেলা থেকে জানি, উনি খুব আনপ্রেডিক্টেবল।' বিশেষ করে দুটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফর নিয়ে প্রচুর বৈঠক করেছিলেন এবং সেসব বৈঠকের কিছু প্রতিবেদন আমি ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম। যেহেতু বিষয়বস্তু নিয়ে যারা আলাপ করছিলেন, তাদের ব্রিফিং পাইনি। ফলে আমার প্রতিবেদনগুলো কিছুটা অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। জানতাম, মনমোহন সিং ঢাকায় এলে অনেক কিছুই ঘটতে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, আমি যখন দিলি্লর পাট চুকিয়ে ঢাকায় রওনা দেব, সেই সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আমাকে দুপুরে একটি পাঁচতারা হোটেলে খাবার নিমন্ত্রণ করেছিলেন।
দু'জনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল মনমোহন সিংয়ের ঢাকা আগমন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক একটি বিশেষ জায়গায় চলে গেছে। তিনি সম্প্রতি ভারতের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের ঢাকা সফরের ঘটনাগুলো আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, এত অল্প সময়ে এত অধিকসংখ্যক মন্ত্রীর কোনো দেশ সফর নজিরবিহীন।
মনমোহন সিং ঢাকায় আসার আগে একটা এসএমএস পেলাম সেই সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে। তিনি আসছেন প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে। আমরা এর আগেই জেনে গিয়েছিলাম, এ সফরে আর যাই হোক তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। ৬ সেপ্টেম্বর আমি হোটেল রূপসী বাংলায় দেখা করতে গেলাম সেই সাংবাদিকের সঙ্গে। ভয় ছিল, তিনি আমাকে দিলি্লর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, 'কী সফিকদা, কী বলেছিলাম?' প্রথম দেখাতেই যে ভয়টি করছিলাম, সেটি-ই ঘটল। তিনি বললেন, 'কি আমার কথা ঠিক হলো তো?' আমি বললাম, তখন বুঝতে পারিনি যে ঘটনা এ পর্যায়ে দাঁড়াবে। তার সঙ্গে পরে যখন নিচে লবিতে নামলাম, দেখা হলো কলকাতা থেকে আসা অনেক সাংবাদিকের সঙ্গে। তারাও মমতার ওপর বেজায় খ্যাপা। তাদের ভাষায়, এতদিনের প্রতীক্ষিত সফর মমতা ব্যানার্জির কারণে সফল হলো না! যাওয়ার আগে দিলি্লর সেই সাংবাদিক আমাকে বলে গেলেন, 'বুঝলেন, মমতা ভারতের রাজনীতি করেন না। উনি করেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। কোনো দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে কী এলো কী গেল_ এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। তার মাথাব্যথা কেবল পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে। এ লেখা লিখতে বসে আমার মনে পড়ে গেল গঙ্গা চুক্তির কথা। তখন বাংলাদেশের এক প্রবীণ সাংবাদিককে দেখা গিয়েছিল ঢাকা-কলকাতা ছোটাছুটি করতে এবং এক পর্যায়ে তিনি নাকি মমতার সঙ্গেও দেখা করেছিলেন। পাছে তিনি বিগড়ে যান, যদিও মমতা তখন কেবল তৃণমূল সভানেত্রী আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তখনকার বাংলাদেশের নেতৃত্ব চেয়েছিলেন সবদিক বজায় রেখে যাতে গঙ্গা চুক্তি হয়। হয়েছিলও তাই। গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির সময় আমি দিলি্লর ঐতিহাসিক হায়দ্রাবাদ হাউসে উপস্থিত ছিলাম এবং ঢাকায় তার প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলাম।
মমতা তার রাজনীতি করেছেন; কিন্তু আমরা কি আমাদের রাজনীতি করতে পেরেছি? গঙ্গা চুক্তির সময় আমরা যেভাবে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সেটা সফল করতে পেরেছিলাম, এবার কেন তা পারলাম না। আমার মনে হয়, আমরা সমস্যাটাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখিনি।
এত সবের পরও বাংলাদেশ সরকারের একটি পদক্ষেপ আমার খুব ভালো লেগেছে। সেটি হলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী যেদিন ঢাকা এলেন সেই সকালেই ভারতের হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে বলে দেওয়া হলো, যেহেতু এ সফরে তিস্তা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না, তাই বাংলাদেশ ট্রানজিট নিয়ে কোনো আলোচনা করবে না। বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ছোট রাষ্ট্র হতে পারে, তবে তার রয়েছে স্বাধীন সত্তা।
আমরা আশা করছি, দুটি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তিস্তা পানি বণ্টনসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানে একটি সমঝোতায় পেঁৗছবে। তবে সে কাজটি যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল। আর হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গকে বাদ দিয়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সফল নাও হতে পারে। কাজেই আলোচনা মমতার মতামত গুরুত্বসহকারে ভারত সরকার বিবেচনা করবে_ এ বিশ্বাস আমাদের আছে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ ও ভারত তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করবে।
এম শফিকুল করিম :সাংবাদিক
No comments