জলবায়ু সহায়তায় শর্ত গ্রহণযোগ্য নয়-সিভিএফ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় দ্রুত ও শর্তহীন সহায়তা দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, জলবায়ু সহায়তায় শর্ত গ্রহণযোগ্য নয়। সক্ষম দেশগুলোর কাছ থেকে সহজে ও সরাসরি অর্থ এবং প্রযুক্তি সহায়তা পাওয়ার কোনো লক্ষণ আমরা দেখছি না। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবেলায় তহবিল ছাড়ে ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।


রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল সোমবার ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ)-২০১১-এর দু'দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির ভাষণদানকালে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। একই সঙ্গে তিনি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে ঝুঁকি এবং সামর্থ্যের ঘাটতিকে বিবেচনায় নিয়ে একটি মানদণ্ড তৈরির আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, 'এ ছাড়া যেসব শর্ত দেওয়া হচ্ছে তা স্বল্পোন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে।' প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জাতীয় অভিযোজন কর্মসূচির ক্ষেত্রেও সহায়তার সুুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এ ছাড়া 'দ্রুত অর্থায়ন' কর্মসূচির কর্মপদ্ধতির ওপর আস্থা রাখা যাচ্ছে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে সিভিএফ ফোরামের সভাপতি ও কোস্টারিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসে মারিয়া ফিগোয়ার্স ওলস্যান, মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ নাসিম, কিরিবাতির শিক্ষামন্ত্রী তোয়াকাই কোরিওরইন্তিতাকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং পরিবেশ ও বন প্রতিমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন এখনও বেড়েই চলেছে। এ ধারা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে বাংলাদেশসহ মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে এমন দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, 'জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। উন্নয়নমূলক কর্মকা ের ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোনো কোনো দেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। অথচ এ জন্য আমরা মোটেই দায়ী নই। চরম অবিচারের শিকার আমরা। বিশ্বকে এটি স্বীকার করতে হবে। এর সংশোধন ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও দ্রুত গ্রহণ করতে হবে।'
দ্বিতীয় সিভিএফ বৈঠকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস স্বাগত বক্তব্য এবং পরিবেশ সচিব মেসবাহ-উল আলম ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ডিএআরএ ও অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারের প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় পররাষ্ট্র এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।
সিভিএফ ফোরামের সদস্য দেশগুলো হলো_ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, কোস্টারিকা, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, ঘানা, কেনিয়া, কিরিবাতি, মাদাগাস্কার, মালদ্বীপ, নেপাল, ফিলিপাইন, সেইন্ট লুসিয়া, তাঞ্জানিয়া, তিমুর লেসতি, তুভালু, ভানুয়াতু এবং ভিয়েতনাম।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দরিদ্রদের দুঃখ-দুর্দশা দিন দিন বাড়ছে। শুধু এর প্রভাবে গত বছর অতিরিক্ত তিন লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু ঘটে এবং ১৩ হাজার কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি সম্পদ বিনষ্ট হয়। সময়মতো পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিতে না পারলে ক্ষতি আরও বাড়বে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ডারবানে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈঠকের আগে ঢাকায় সিভিএফের দ্বিতীয় বৈঠকের ফলে দুর্গত দেশগুলোর সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে এ ব্যাপারে সম্মিলিতভাবে করণীয় নির্ধারণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৯ সালের নভেম্বরে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে ফোরামের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, এই সিভিএফ বৈঠকের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান হুমকি কার্যকরভাবে মোকাবেলা ও একটি কার্যকর অংশীদারিত্ব গড়তে আমাদের অঙ্গীকারেরও প্রতিফলন ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু তহবিল ও প্রযুক্তির ব্যাপারে 'যেসব শর্ত ও মানদণ্ড দেওয়া হয়েছে তা সক্ষম দেশগুলোর পক্ষে গেছে বলে মনে করেন।'
জলবায়ু পরিবর্তনের সহায়তার সঙ্গে উন্নয়ন সাহায্যকে মিলিয়ে ফেলার প্রবণতার ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, উন্নয়ন সহায়তা ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত ব্যয় মেটাতে আমাদের নতুন ও অতিরিক্ত সাহায্য দিতে হবে।
তিনি বলেন, 'কানকুনে গৃহীত ২০১১-১২ সালের জন্য তহবিল সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি পূরণের বিষয়টি সুদূরপরাহত। একইভাবে আমরা লক্ষ্য করছি, 'গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড' চালুর মাধ্যমে ২০১২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত তহবিল সংগ্রহের বিষয়টিও বিশ্ব সম্প্রদায় স্পষ্ট করছে না।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বড় বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে চরম অনীহা দেখাচ্ছে। বাধ্যতামূলক ও স্বতঃপ্রণোদিত প্রতিকারের ব্যবস্থা না নেওয়ায় কিয়োটো প্রটোকলের আশানুরূপ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এ উদাসীনতা বিশ্ব জলবায়ুকে তছনছ এবং বিভিন্ন দেশকে আরও সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোকে তাদের ঐতিহাসিক দায়-দায়িত্ব পালন ও সহনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, একইভাবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোরও নৈতিক দায়িত্ব আছে এবং সক্ষমতা ও সামর্থ্যের ভিত্তিতে তাদেরও স্বপ্রণোদিতভাবে এগিয়ে আসা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি বহুল স্বীকৃত যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রতিঘাতে মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। বৈশ্বিক আলোচনায় সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি ও মরুকরণ প্রক্রিয়া কম গুরুত্ব পাচ্ছে। বাস্তুচ্যুতদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের পুনর্বাসন ও চাহিদা পূরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তার জন্য একটি যথোপযুক্ত রূপরেখা প্রণয়নে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড অ্যাক্ট-২০১০-এর উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্ব কী করবে, সে আশায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর বসে থাকার সুযোগ নেই। শেখ হাসিনা বলেন, ডারবানে সিওপি ১৭ সম্মেলনের আগে আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর সমন্বিত উদ্বেগের বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে।
তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জকে সবুজ উন্নয়নের দিশারিতে পরিণত করার আহ্বান জানান এবং বলেন, 'উন্নয়ন সহযোগীরা জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রযুুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসবে।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামকে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে, যাতে বিশেষ করে জি-৮, জি-২০, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো আমাদের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা এবং চ্যালেঞ্জগুলো সার্বিকভাবে অনুধাবন করতে পারে।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের দ্বিতীয় দিনের সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। রোববার কারিগরি অধিবেশনে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েসের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক নিল ওয়াকার, বন ও পরিবেশ সচিব মেজবাহ-উল আলম।
জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন দেশগুলোর নেতৃত্বে ২০০৯ সালে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম গঠিত হয়। মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে এর সর্বপ্রথম সম্মেলন হয়। এবার হচ্ছে সিভিএফের তৃতীয় সম্মেলন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন, ডারবানেই গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের তহবিল সংগ্রহ শুরু করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও নিম্ন কার্বন নিঃসরণ উন্নয়ন পথে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বাড়লে বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.