জাতীয় নিরাপত্তার কী হবে?-টেরেস্ট্রিয়াল লাইসেন্স by জাকারিয়া স্বপন

বাংলাদেশ সরকার অতি সম্প্রতি ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে টেরেস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার লাইসেন্স দিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে যদিও পরিকল্পনা ছিল তিনটি প্রতিষ্ঠানকে এই লাইসেন্স দেওয়ার। কিন্তু যতদূর জানা গেছে, রাজনৈতিক চাপের কারণে মোট ছয়টিকে এই লাইসেন্স দিতে হচ্ছে।


সেই ছয়টি প্রতিষ্ঠান হলো_ ক. নভোকম (বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভয়েস কল আদান-প্রদানের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নভোটেলের মালিকানাধীন); খ. ওয়ান এশিয়া (দৃক আইটি এবং অন্যান্য পার্টনার); গ. বিডিলিংক কমিউনিকেশন (জীবনধারা নামের মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির মালিকাধীন); ঘ. ম্যাংগো টেলিসার্ভিসেস (বর্তমানে একমাত্র বেসরকারি ইন্টারনেট গেটওয়ের মালিকাধীন); ঙ. সামিট কমিউনিকেশনস (সামিট গ্রুপের মালিকাধীন ও এনটিটিএন লাইসেন্সধারী) এবং চ. ফাইবার অ্যাট হোম (বর্তমানে এনটিটিএন লাইসেন্সধারী)।
এই ছয়টি প্রতিষ্ঠান ভূমির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশকে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত করবে। তিনটি নয়, ছয়টি প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন ছয়টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেল সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমাদের সবার সামনে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি উঠে আসা উচিত সেটা হলো_ জাতীয় নিরাপত্তা; এটির কী হবে?
সাধারণের বোঝার জন্য আরেকটু ব্যাখ্যা করি।
১. বাংলাদেশ বর্তমানে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দু'ভাবে যুক্ত। প্রথমটি হলো স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে এসেছে। দ্বিতীয়টি হলো সাবমেরিন কেবল, যা সাগরের নিচ দিয়ে চলে গেছে। এ দুই মাধ্যমেই আমাদের দেশ থেকে বিদেশের সঙ্গে সব ধরনের ডাটা-তথ্য আদান-প্রদান হয়ে থাকে।
২. আমরা দিনরাত যত ইন্টারনেট ব্যবহার করি, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ফাইল চালাচালি করে, তাদের ওয়েবসাইট যখন কেউ ভিজিট করে, এই সবকিছুই হয় এ দুটি মাধ্যম দিয়ে। স্যাটেলাইটে ব্যান্ডউইথ কম, কিন্তু সাবমেরিন কেবল হলো ফাইবার অপটিক; তাই ব্যান্ডউইথ অনেক বেশি। ফলে ডাটা আদান-প্রদানের পরিমাণও বেশি।
৩. সাবমেরিন কেবল বসানো হয়েছে ১৬টি সদস্য মিলে একটি কনসোর্টিয়াম করে। সেই ১৬টি সদস্য হলো_ আলজেরিয়া টেলিকম (আলজেরিয়া), ভারতী ইনফোটেল (ভারত), বাংলাদেশ, ক্যাট টেলিকম (থাইল্যান্ড), ইতিসালাত (সংযুক্ত আরব আমিরাত), ফ্রান্স টেলিকম (ফ্রান্স), এমসিআই (ইংল্যান্ড), পাকিস্তান টেলিকম (পাকিস্তান), সিঙ্গাপুর টেলিকম (সিঙ্গাপুর), শ্রীলংকা টেলিকম (শ্রীলংকা), সৌদি টেলিকম (সৌদি আরব), টেলিকম ইজিপ্ট (মিসর), টেলিকম ইতালিয়া (ইতালি), টেলিকম মালয়েশিয়া (মালয়েশিয়া), তিউনিসি টেলিকম (তিউনিসিয়া) এবং টাটা কমিউনিকেশন (ভারত)। ১৮ হাজার ৮০০ কিলোমিটারের এই লম্বা ফাইবার অপটিক কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপকে যুক্ত করেছে।
৪. ১৬টি প্রতিষ্ঠান মিলে এই বিশাল ফাইবার অপটিককে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করে থাকে। এর ওপর এককভাবে কারও কোনো কর্তৃত্ব নেই। এই কনসোর্টিয়ামে থাকার ফলে সবাইকে একটি নীতিমালা মেনে চলতে হয়, যেমনটা করতে হয় জাতিসংঘে। কোনো দেশ সেই নীতিমালা ভাঙার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর যদি করেও থাকে, তাহলে সেটা ঠেকানোর ব্যবস্থাও রয়েছে।
৫. বাংলাদেশে নতুন যে লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, সেটাও হবে ফাইবার অপটিক দিয়ে; তবে সাগরের নিচ দিয়ে নয়, এটা হবে মাটির নিচ বা ওপর দিয়ে। ফলে এর ব্যান্ডউইথও হবে অনেক বেশি। ডাটা আদান-প্রদানের পরিমাণও হবে অনেক বেশি এবং কিছু ক্ষেত্রে সাবমেরিন কেবলের চেয়েও বেশি হতে পারে। সরকার বলেছে, আমাদের যেহেতু একটাই সাবমেরিন কেবল, ওটায় কোনো সমস্যা হলে আমাদের দেশ একদম অন্ধকারে এবং সেটা যে হয়নি, তা কিন্তু নয়। তাই ব্যাকআপ হিসেবে এই নতুন পন্থা।
৬. উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। দেশের অর্থনীতি বাড়ছে, তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, ইন্টারনেটের ওপর চাপ বেশি পড়ছে, জীবন দ্রুতগামী হচ্ছে_ আমাদের বহুবিধ মাধ্যমে যুক্ত হতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সারা পৃথিবী এগিয়ে যাবে, আর আমরা একটা দ্বীপ বানিয়ে বসে থাকব, সেটা তো হতে পারে না। সরকার ব্যক্তিমালিকানায় দ্বিতীয় আরেকটি সাবমেরিন কেবলের জন্য চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু কোনো ব্যবসায়ী সেটিতে বিনিয়োগ করতে চাননি। তাই হয়তো এই বিকল্প রাস্তা।
৭. রাস্তা তৈরি হোক। কিন্তু এবার একটু ম্যাপ নিয়ে বসে দেখি, রাস্তাটা যাবে কোন দিক দিয়ে। আপনারা যদি ম্যাপটি ভালো করে খেয়াল করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, বাংলাদেশ যদি ভূমির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, তাহলে সেটা একমাত্র হবে ভারত। আমাদের সব সীমানা হলো ভারতের সঙ্গে। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সামান্য সীমানা আছে সত্যি, কিন্তু সেটা দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কেউ ইন্টারনেট সংযোগ নিতে যাবে, সেটা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়। বাংলাদেশের কাছের দুটি দেশ হলো নেপাল এবং ভুটান। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো ভূমি সংযোগ নেই। ভারত কখনোই আমাদের নেপাল কিংবা ভুটানের সঙ্গে যুক্ত হতে দেবে না। আর চীনের সঙ্গে তো নয়ই। তাহলে মূল কথা হলো_ এই সংযোগটি হবে ভারতের সঙ্গে।
৮. যেহেতু এখানে কোনো কনসোর্টিয়াম নেই, তাই এই চুক্তিগুলো হবে দ্বিপক্ষীয়; অর্থাৎ ভারতের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের ছয়টি কোম্পানির। আর যদি ভারতের বাইরের কোনো দেশের সঙ্গে যুক্ত হতেও হয়, সেটাও হতে হবে ভারতের মাটির ওপর দিয়ে, ভারতের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। যেমন ধরুন, কেউ বলল, আমি সরাসরি দুবাইয়ের সঙ্গে যুক্ত করব। দুবাইওয়ালারা তো আর বেনাপোল পর্যন্ত ফাইবার টেনে আনতে পারবে না। তাদের ভারতের কোনো নেটওয়ার্কের ওপর দিয়েই আসতে হবে।
৯. ভৌগোলিক কারণে, আমরা যেহেতু নিচের দিকে, তাই ভারত আমাদের দিকে কোনো ডাটা পাঠাবে না (ভারতের সেটা প্রয়োজন নেই)। মূলত আমাদের সব ডাটা যাবে ভারতের ওপর দিয়ে। এটা অনেকটা ডাটা ট্রানজিট। ট্রাকে করে পণ্য যাওয়া, আর ফাইবারে করে ডাটা যাওয়ার ভেতর তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
১০. আমাদের সব ডাটা যদি যায় ভারতের ওপর দিয়ে, তবে সেই ডাটা নিত্যদিন দেখতে পাওয়া কি কঠিন কোনো বিষয়? আমাদের ই-মেইলের একটি কপি, আমার পাসওয়ার্ড, সরকারি কোনো ই-মেইল, গোপনীয় ফাইলের অ্যাটাচমেন্ট, আমেরিকা কিংবা চীনের সঙ্গে আমাদের সামরিক বাহিনীর কোনো যোগাযোগ_ আরও কিছু কি বলতে হবে? আর শুধু কি ডাটা? টেলিফোন কলও তো যাবে এর ওপর দিয়ে!
১১. বাংলাদেশে যতগুলো বিদেশি অ্যাম্বাসি আছে, তারা কেউ বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহার করে না। নিরাপত্তার কারণে তারা তাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে। এই নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকার পরও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ (উইকিলিকস) যে খেলা দেখাচ্ছেন, তারপর কি আর খুলে বলার প্রয়োজন আছে?
১২. বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি ওয়েবসাইট কিছুদিন পরপর হ্যাক হয়। আপনার কি ধারণা, এ যাবতীয় হ্যাকিং বাংলাদেশের মাটি থেকেই হচ্ছে? পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে এরা এসে হাজির হতে পারে। এই তো গত সপ্তাহেই জাপানের সবচেয়ে বড় ডিফেন্স কনট্রাক্টর মিতসুবিশির নেটওয়ার্ক হ্যাক হয়েছিল এবং ৮০টি কম্পিউটার থেকে ডাটা চুরি করে নিয়ে গেছে চাইনিজ হ্যাকাররা। আর সেখানে আমাদের নেটওয়ার্কগুলোর তো নিরাপত্তা বলে কোনো কনসেপ্টই নেই।
আমি বলছি না যে, এই লাইসেন্স দেওয়া যাবে না। আমি বলছি না যে, আমরা বাড়তি কানেকটিভিটি নেব না। তবে আন্তর্জাতিক কানেকটিভিটির বিষয়ে অবশ্য অবশ্যই কোনো না কোনো কনসোর্টিয়ামের ভেতর দিয়ে যাওয়াটা নিরাপদ। আজ দেশের পরিবহন ট্রানজিট নিয়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, এটা তার চেয়েও বড় ভয়াবহ ইস্যু_ এটা আরও বড় বিতর্কের জন্ম দিতে যাচ্ছে। আমাদের যে নিত্যদিন কেউ চোখে চোখে রাখবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
পরিশেষে বলব, এই লাইসেন্স ইস্যু করার আগে পাবলিক হিয়ারিং এবং জনমত যাচাইয়ের প্রয়োজনীতা রয়েছে। মিডিয়ায় এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। পাশাপাশি দেখতে হবে, দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত সংস্থাগুলো এই বিষয়ে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে কি-না? যেহেতু একটি দ্বিপক্ষীয় তথ্য আদান-প্রদানের চুক্তি হতে যাচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আরেকটু চিন্তা-ভাবনার বিষয় রয়ে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

জাকারিয়া স্বপন :তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
zs@priyo.com

No comments

Powered by Blogger.