আমরা স্তাবক নই, ষড়যন্ত্রকারীও নই-প্রতিক্রিয়া by নূরে আলম সিদ্দিকী
সম্প্রতি দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমার সাক্ষাৎকারের প্রতিক্রিয়ায় দৈনিক সমকালে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একটি লেখা আমি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেছি। আমি মর্মাহত হলেও বিস্মিত বা আশ্চর্যান্বিত হইনি এই কারণে যে, ১৯৬২ সাল থেকে রাজনীতির পথপরিক্রমণকালে চরম ডানপন্থি এবং বিভ্রান্ত বামপন্থিদের পক্ষ থেকে অনেক কটাক্ষ ও তীক্ষষ্ট মন্তব্য আমাকে সহ্য করতে হয়েছে।
শুধু আমি নই, আমাদের স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক, রাজনৈতিক পদচারণার সেই শুরু থেকে যাকে আমি হৃদয়ের সিংহাসনে আদর্শের মূর্ত প্রতীক হিসেবে বসিয়েছিলাম তাকে ভারতের অনুচর, সিআইএর দালাল ইত্যাদি গালাগালি শুনতে হয়েছে। আমি আজীবন গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিশ্বাস করি ও সেই লক্ষ্যেই ডানপন্থি যারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন এবং বিভ্রান্ত বামপন্থি যারা বাংলাদেশে বসে আমাদের সংকীর্ণতার পূজারি, ভারতের অনুচর ও সিআইএর দালাল বলতেন, তাদের উভয়ের বিরোধের মুখে, বিশেষ করে ৬ দফা দেওয়ার পর আমরা স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথে যখন পরিক্রমণ শুরু করলাম, তখন আমাদের সংগ্রাম-সাধনার বিরুদ্ধে যেসব কথা তারা উচ্চারণ করেছে এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যেসব কটূক্তি করেছে আমার দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে সেগুলোরই উলেল্গখ ছিল। যার কোনো সদুত্তর বা যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা গাফ্ফার সাহেব তার লেখায় দেননি। বাঙালি জাতীয় চেতনার যে স্বরলিপি বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে লেখা ছিল সেটাকেই সুরের মূর্ছনা দিয়ে সারা বাংলাদেশে ছাত্রলীগের কর্মী ও নেতারা বাউলের মতো, চারণের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে বলেই তার একক নেতৃত্ব আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। এটিই ইতিহাস, এটিই বাস্তব। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন উপলব্ধি করতেন, তাই কখন কী কথা বললে মানুষ সেটা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করবে সেটি ঠিক বুঝতে পারতেন। আর তার সে কথাটিই ছাত্রলীগের কর্মীরা গণমানুষের কাছে তুলে ধরেছে তখন। অন্য কোনো সংগঠন নয় ছাত্রলীগই এই গৌরবের দাবিদার। বঙ্গবন্ধুর শুধু স্নেহধন্যই ছিলাম না, '৬৯-এর পরে নির্বাচনকালে এবং '৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের কারণে আল্লাহর রহমতে আমি আমাকে বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশে বিকশিত করতে পেরেছি, উদ্ভাসিত করতে পেরেছি। সেই বঙ্গবন্ধুও যখন বিভ্রান্ত বামের, আদর্শবিচ্যুত বামের ইন্ধনে, উস্কানিতে সুদূরপ্রসারী একটি কল্পনাবিলাসী চিন্তার শিকার হয়ে একদল গঠন করলেন বা সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনী আনলেন, তখন সংসদে তার সামনে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে আমি বলেছিলাম, 'আপনি চোখ চাইলে দু'চোখ রক্তজবার মতো আপনার পায়ের তলায় অর্ঘ্য দিয়ে দেব, রক্ত চাইলে সমস্ত বুকের রক্ত উজাড় করে বাংলার মাটিকে লাল করে দেব, কিন্তু বঙ্গবন্ধু আপনি আজ যে পথে যাচ্ছেন সেটি ভুল পথ। আপনি গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক, বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ থেকে শুরু করে তার বিকাশ, তার ব্যাপ্তি, তার সফলতা পর্যন্ত আপনিই তার নেতা। সমাজতান্ত্রিক শেখ মুজিব আপনি নন, কমরেড আপনি নন, আপনি বাংলার মানুষের বঙ্গবন্ধু, আপনি জাতির জনক। বাংলাদেশ যদি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য স্বাধীন হতো, তাহলে মণি সিংহ অথবা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে হতো, আপনার নেতৃত্বে নয়।'
সংসদে দাঁড়িয়ে আমি বাকশালের বিরোধিতা করায় এই কিছুদিন আগে একটি লেখায় আপনি আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন এবং আপনার এ প্রবন্ধেও আপনি বলেছেন যে, মোশতাক সাহেব দেরি না করে অনতিবিলম্বে বাকশাল প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহিত করেছিলেন, ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। কিন্তু যে সত্য কথাটি আপনি লেখেননি তা এই যে, আমার বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, 'তোমার লাই পেয়ে এই ছেলেটি এত বড় ঔদ্ধত্য দেখাল।' আমি স্বীকার করি, বঙ্গবন্ধুর আশকারা বা স্নেহসিক্ত প্রশ্রয় না থাকলে আমি সংসদে সেদিন ২ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেতাম না।
আমি এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দ যারা নির্মোহচিত্তে সৃজনশীল মানসিকতা নিয়ে আওয়ামী লীগের যে অর্জন, যে সফলতা, যে আদর্শ সেখানে যেন বিন্দুমাত্র চিড় না ধরে তার জন্যই সত্য কথাটি শেখ হাসিনার সামনে কোনো লোভ-লালসা, প্রাপ্তি-প্রত্যাশা থেকে নয়, বরং তাকে সংশোধন করে দেওয়ার জন্য একাদিক্রমে বলে চলেছি। আমি স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে নির্বাসন নিয়েছি। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক, এমএ জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু তারা তো সমস্ত জান-প্রাণ-নিষ্ঠা দিয়ে, আন্তরিকতা দিয়ে আজও আওয়ামী লীগ করছেন অনেক অপমান-অবহেলা নীরবে সহ্য করে। তারা আজ নিজ ঘরে পরবাসী। অনুগ্রহ-অনুকম্পায় যারা আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনোরকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন তারা আজ অবহেলার দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয়তার দহনে দগ্ধীভূত। এই যে মস্কোপন্থি রাজনীতিকরা বিভ্রান্ত চিন্তার যে দেয়াল জনগণ ও শেখ হাসিনার মধ্যে তৈরি করছে, আমরা সে দেয়ালটি যেন তৈরি না হয় তার জন্য কথা বলছি।
আমাদের ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের ৩টি আদর্শ। একটি হচ্ছে স্বাধীনতা, দ্বিতীয়টি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি বা পিতা, আরেকটি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এখানে তিনি মোশতাকের প্রেতাত্মার গন্ধ কোথায় পেলেন? খুনি মোশতাককে আমি সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করি। তার কিংবা তার ডেমোক্রেটিক লীগের অথবা বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে পারলে যে কোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। অথচ সেদিন ক্ষমতার লোভে যারা বিপল্গবের কথা, সমাজতন্ত্রের কথা তারস্বরে চিৎকার করে বলতেন, বিপল্গবের প্রসব যন্ত্রণায় যারা ছটফট করতেন, তারা সকলেই ভোল পাল্টে দল পরিবর্তন করে জিয়া-এরশাদের সঙ্গে এমনকি হাসিনার সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নিয়েছেন। গাফ্ফার সাহেব, প্রস্তাবনা, প্রলোভন আমার কাছেও ছিল। আপনি এ কথাটি উলেল্গখ করলে খুশি হতাম যে, মোশতাক-জিয়ার আমলে আমি কারারুদ্ধ হই। দীর্ঘদিন সেনানিবাসে আমাকে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর পর সেখানেও অনেক দিন আমাকে ফাঁসির সেলে রাখা হয়েছিল। সে সময়ের যেসব সংসদ সদস্য জীবিত আছেন তাদের কাছ থেকে খুনি মোশতাকের উপস্থিতিতে আমি যা বলেছিলাম তা জেনে নিতে পারেন। বঙ্গভবনে তিনি আওয়ামী নেতৃত্বের যে সভা ডেকেছিলেন, সেখানে আমি তাকে বলেছিলাম, 'আপনার সাহস থাকলে আপনি সংসদে যান।' তারপরই আমি গ্রেফতার হয়ে যাই। আবদুল মান্নান (টাঙ্গাইল) আমার বক্তৃতা শোনার পরে বলেছিলেন, 'বাকশালের বিরোধিতা করার সময় মনে করেছিলাম তোমার মাথায় ছিট আছে, কিন্তু আজকে যে দুঃসাহসিক কথা তুমি বললে, যে চ্যালেঞ্জ তুমি ছুড়ে দিলে তাতে মনে হচ্ছে তুমি বদ্ধ উন্মাদ।' সবাই যখন জীবনের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত তখন মোশতাককে আমি আরও বলেছিলাম, 'আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার না করলে ২৪ ঘণ্টার বেশি বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকার শক্তি আপনার নেই। আপনার যদি সাহস থাকে তাহলে অভ্যুত্থানের নেতা হিসেবে দাঁড়ান। আপনাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। কারণ আমরা টিক্কা খান, নিয়াজিকে মোকাবেলা করেছি।' গাফ্ফার চৌধুরী বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে' চাপিয়ে আপনি যেভাবে ফরমায়েশি লেখা লিখেছেন তাতে বলব, আপনার লেখার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ কোনো উপাদান থাকে না। আপনি আমার বাড়ি সম্পর্কেও অতিরঞ্জিত কথা বলেছেন। ডলার-পাউন্ড দিয়ে আমার ব্যবসার শুরু। আজ আমি বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত শিল্পপতি। আমার শিল্প প্রতিষ্ঠান সন্ত্রাসের অথবা চাঁদার টাকায় গড়ে ওঠেনি। এটা রাতারাতিও হয়নি। আল্লাহর অশেষ রহমত এবং নিরলস পরিশ্রম, ব্যবসায়িক কমিটমেন্ট, আমার ভাবমূর্তি ও মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা আমাকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আপনি একটি বাড়ির কথা উলেল্গখ করেছেন। আপনি এনবিআরে যোগাযোগ করলেই জানতে পারবেন ঢাকা শহরে আমার কয়টি বাড়ি রয়েছে এবং আমি কতগুলো শিল্প পরিচালনা করি।
সবশেষে বলতে চাই, নিজ ঘরে পরবাসী ছাত্রলীগের নেতৃত্বের মূল্যবোধের অবক্ষয় তৈরির যে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমি আমৃত্যু তার বিরোধিতা করে যাব। কোনো হুমকি, কোনো অপপ্রচার, কোনো চোখ রাঙানি আমাকে সেখান থেকে নিবৃ্ত্ত করতে পারবে না। যারা প্রকাশ্য প্রতিবাদ করে, যারা সৃজনশীল সমালোচনা করে, যারা মোসাহেবি বা স্তাবকতা করে না, তারা কখনোই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে থাকে না। আমি মানুষের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত নই। আমার ঝিনাইদহে আজও মানুষ যেভাবে আমাকে ভালোবাসে তা দেখে যে কেউ বিমুগ্ধ হবেন। গাফ্ফার সাহেব সাত সমুদ্র তের নদীর পার থেকে কখনও আপনি নসিহত করেন, কখনও আপনি উপদেশ খয়রাত করেন। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন আপনি উপলব্ধি করেন না। আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, ভবিষ্যতে যে কোনো লেখায় আপনি তথ্যভিত্তিক হবেন, আপনি বাস্তব দৃষ্টিসম্পন্ন হবেন। রোষবশে বা ফরমায়েশে আপনি এই ধরনের অযৌক্তিক ভিত্তিহীন মিথ্যাচার করবেন না। এ রকম ক্ষেত্রে মানহানির মামলা করাই সঙ্গত। তবে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করলাম না দুটি কারণে। এক. আমি গণতন্ত্রের সহনশীলতায় বিশ্বাস করি; দুই. আপনি বয়োবৃদ্ধ এবং প্রবাসী।
ইতিহাস একদিন প্রমাণ করবে আমরা বিশ্বাসঘাতক নই, আমরা স্তাবক নই, আমরা মোসাহেব নই, আমরা আওয়ামী লীগের সৃজনশীল সমালোচক এবং আওয়ামী লীগকে তার স্বকীয় চিন্তাধারায় নিজস্ব আদর্শের পাদপিঠে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চাই এবং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র, ছাত্রলীগের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমণকে বিলুপ্ত করার যে ষড়যন্ত্র, ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মূল্যবোধের অবক্ষয় তৈরি করার যে ষড়যন্ত্র তার বিরুদ্ধে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে যাব ও এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যাব যে, কোনো প্রাপ্তি-প্রত্যাশা নয়, সত্যকে সত্য বলার সাহসের অভাব আমার কোনো দিন ছিল না।
ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যারা আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে টিকিয়ে রেখেছিলেন সেই আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল প্রমুখ এখন দলে উপেক্ষিত, অবহেলিত ও জীবন্মৃত অবস্থায় নিদারুণ অন্তর্জ্বালা বহন করে চলেছেন। আবার অনেক প্রবীণ নেতাসহ যেসব প্রতিশ্রুতিশীল ও সম্ভাবনাময় নেতা আজ দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কোনোরকমে সংগঠনে রয়েছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতার, সুলতান মনসুর, খ ম জাহাঙ্গীর উলেল্গখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিকে যারা শক্তি সঞ্চার করে এ দেশের আপামর গণমানুষের মুক্তির সোপান রচনা করেও আজ বিতাড়িত, তাদের মধ্যে আছেন সৈয়দ মোযাহারুল হক বাকী, এমএ রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, মোস্তফা মহসীন মন্টু, কাজী ফিরোজ রশীদ, শেখ শহীদুল ইসলাম ও এমএ রশীদসহ অগণিত নেতাকর্মী।
প্রাক্তন ছাত্রলীগের সব নেতৃত্বকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অবমূল্যায়নে যাদের রক্তক্ষরণ ঘটে, তারা দল-মত নির্বিশেষে ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। অপপ্রচারে একে ধ্বংস করতে না পারলে শেখ হাসিনাকে জনবিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ করে রাখতে পারবেন না বিধায় আদর্শবিচ্যুত বামরা আজ উঠেপড়ে লেগেছে।
নূরে আলম সিদ্দিকী : বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং আহ্বায়ক, ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন
সংসদে দাঁড়িয়ে আমি বাকশালের বিরোধিতা করায় এই কিছুদিন আগে একটি লেখায় আপনি আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন এবং আপনার এ প্রবন্ধেও আপনি বলেছেন যে, মোশতাক সাহেব দেরি না করে অনতিবিলম্বে বাকশাল প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহিত করেছিলেন, ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। কিন্তু যে সত্য কথাটি আপনি লেখেননি তা এই যে, আমার বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, 'তোমার লাই পেয়ে এই ছেলেটি এত বড় ঔদ্ধত্য দেখাল।' আমি স্বীকার করি, বঙ্গবন্ধুর আশকারা বা স্নেহসিক্ত প্রশ্রয় না থাকলে আমি সংসদে সেদিন ২ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেতাম না।
আমি এবং ছাত্রলীগের সাবেক নেতৃবৃন্দ যারা নির্মোহচিত্তে সৃজনশীল মানসিকতা নিয়ে আওয়ামী লীগের যে অর্জন, যে সফলতা, যে আদর্শ সেখানে যেন বিন্দুমাত্র চিড় না ধরে তার জন্যই সত্য কথাটি শেখ হাসিনার সামনে কোনো লোভ-লালসা, প্রাপ্তি-প্রত্যাশা থেকে নয়, বরং তাকে সংশোধন করে দেওয়ার জন্য একাদিক্রমে বলে চলেছি। আমি স্বেচ্ছায় রাজনীতি থেকে নির্বাসন নিয়েছি। কিন্তু আবদুর রাজ্জাক, এমএ জলিল, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু তারা তো সমস্ত জান-প্রাণ-নিষ্ঠা দিয়ে, আন্তরিকতা দিয়ে আজও আওয়ামী লীগ করছেন অনেক অপমান-অবহেলা নীরবে সহ্য করে। তারা আজ নিজ ঘরে পরবাসী। অনুগ্রহ-অনুকম্পায় যারা আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনোরকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন তারা আজ অবহেলার দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয়তার দহনে দগ্ধীভূত। এই যে মস্কোপন্থি রাজনীতিকরা বিভ্রান্ত চিন্তার যে দেয়াল জনগণ ও শেখ হাসিনার মধ্যে তৈরি করছে, আমরা সে দেয়ালটি যেন তৈরি না হয় তার জন্য কথা বলছি।
আমাদের ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের ৩টি আদর্শ। একটি হচ্ছে স্বাধীনতা, দ্বিতীয়টি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্থপতি বা পিতা, আরেকটি হচ্ছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এখানে তিনি মোশতাকের প্রেতাত্মার গন্ধ কোথায় পেলেন? খুনি মোশতাককে আমি সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা করি। তার কিংবা তার ডেমোক্রেটিক লীগের অথবা বিএনপি বা জাতীয় পার্টির সঙ্গে আমার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে পারলে যে কোনো শাস্তি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। অথচ সেদিন ক্ষমতার লোভে যারা বিপল্গবের কথা, সমাজতন্ত্রের কথা তারস্বরে চিৎকার করে বলতেন, বিপল্গবের প্রসব যন্ত্রণায় যারা ছটফট করতেন, তারা সকলেই ভোল পাল্টে দল পরিবর্তন করে জিয়া-এরশাদের সঙ্গে এমনকি হাসিনার সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নিয়েছেন। গাফ্ফার সাহেব, প্রস্তাবনা, প্রলোভন আমার কাছেও ছিল। আপনি এ কথাটি উলেল্গখ করলে খুশি হতাম যে, মোশতাক-জিয়ার আমলে আমি কারারুদ্ধ হই। দীর্ঘদিন সেনানিবাসে আমাকে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর পর সেখানেও অনেক দিন আমাকে ফাঁসির সেলে রাখা হয়েছিল। সে সময়ের যেসব সংসদ সদস্য জীবিত আছেন তাদের কাছ থেকে খুনি মোশতাকের উপস্থিতিতে আমি যা বলেছিলাম তা জেনে নিতে পারেন। বঙ্গভবনে তিনি আওয়ামী নেতৃত্বের যে সভা ডেকেছিলেন, সেখানে আমি তাকে বলেছিলাম, 'আপনার সাহস থাকলে আপনি সংসদে যান।' তারপরই আমি গ্রেফতার হয়ে যাই। আবদুল মান্নান (টাঙ্গাইল) আমার বক্তৃতা শোনার পরে বলেছিলেন, 'বাকশালের বিরোধিতা করার সময় মনে করেছিলাম তোমার মাথায় ছিট আছে, কিন্তু আজকে যে দুঃসাহসিক কথা তুমি বললে, যে চ্যালেঞ্জ তুমি ছুড়ে দিলে তাতে মনে হচ্ছে তুমি বদ্ধ উন্মাদ।' সবাই যখন জীবনের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত তখন মোশতাককে আমি আরও বলেছিলাম, 'আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার না করলে ২৪ ঘণ্টার বেশি বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকার শক্তি আপনার নেই। আপনার যদি সাহস থাকে তাহলে অভ্যুত্থানের নেতা হিসেবে দাঁড়ান। আপনাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করা হবে। কারণ আমরা টিক্কা খান, নিয়াজিকে মোকাবেলা করেছি।' গাফ্ফার চৌধুরী বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে 'উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে' চাপিয়ে আপনি যেভাবে ফরমায়েশি লেখা লিখেছেন তাতে বলব, আপনার লেখার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ কোনো উপাদান থাকে না। আপনি আমার বাড়ি সম্পর্কেও অতিরঞ্জিত কথা বলেছেন। ডলার-পাউন্ড দিয়ে আমার ব্যবসার শুরু। আজ আমি বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত শিল্পপতি। আমার শিল্প প্রতিষ্ঠান সন্ত্রাসের অথবা চাঁদার টাকায় গড়ে ওঠেনি। এটা রাতারাতিও হয়নি। আল্লাহর অশেষ রহমত এবং নিরলস পরিশ্রম, ব্যবসায়িক কমিটমেন্ট, আমার ভাবমূর্তি ও মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা আমাকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আপনি একটি বাড়ির কথা উলেল্গখ করেছেন। আপনি এনবিআরে যোগাযোগ করলেই জানতে পারবেন ঢাকা শহরে আমার কয়টি বাড়ি রয়েছে এবং আমি কতগুলো শিল্প পরিচালনা করি।
সবশেষে বলতে চাই, নিজ ঘরে পরবাসী ছাত্রলীগের নেতৃত্বের মূল্যবোধের অবক্ষয় তৈরির যে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমি আমৃত্যু তার বিরোধিতা করে যাব। কোনো হুমকি, কোনো অপপ্রচার, কোনো চোখ রাঙানি আমাকে সেখান থেকে নিবৃ্ত্ত করতে পারবে না। যারা প্রকাশ্য প্রতিবাদ করে, যারা সৃজনশীল সমালোচনা করে, যারা মোসাহেবি বা স্তাবকতা করে না, তারা কখনোই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে থাকে না। আমি মানুষের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত নই। আমার ঝিনাইদহে আজও মানুষ যেভাবে আমাকে ভালোবাসে তা দেখে যে কেউ বিমুগ্ধ হবেন। গাফ্ফার সাহেব সাত সমুদ্র তের নদীর পার থেকে কখনও আপনি নসিহত করেন, কখনও আপনি উপদেশ খয়রাত করেন। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন আপনি উপলব্ধি করেন না। আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, ভবিষ্যতে যে কোনো লেখায় আপনি তথ্যভিত্তিক হবেন, আপনি বাস্তব দৃষ্টিসম্পন্ন হবেন। রোষবশে বা ফরমায়েশে আপনি এই ধরনের অযৌক্তিক ভিত্তিহীন মিথ্যাচার করবেন না। এ রকম ক্ষেত্রে মানহানির মামলা করাই সঙ্গত। তবে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করলাম না দুটি কারণে। এক. আমি গণতন্ত্রের সহনশীলতায় বিশ্বাস করি; দুই. আপনি বয়োবৃদ্ধ এবং প্রবাসী।
ইতিহাস একদিন প্রমাণ করবে আমরা বিশ্বাসঘাতক নই, আমরা স্তাবক নই, আমরা মোসাহেব নই, আমরা আওয়ামী লীগের সৃজনশীল সমালোচক এবং আওয়ামী লীগকে তার স্বকীয় চিন্তাধারায় নিজস্ব আদর্শের পাদপিঠে প্রতিষ্ঠিত রাখতে চাই এবং ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র, ছাত্রলীগের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথপরিক্রমণকে বিলুপ্ত করার যে ষড়যন্ত্র, ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মূল্যবোধের অবক্ষয় তৈরি করার যে ষড়যন্ত্র তার বিরুদ্ধে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত লড়ে যাব ও এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যাব যে, কোনো প্রাপ্তি-প্রত্যাশা নয়, সত্যকে সত্য বলার সাহসের অভাব আমার কোনো দিন ছিল না।
ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যারা আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে টিকিয়ে রেখেছিলেন সেই আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল প্রমুখ এখন দলে উপেক্ষিত, অবহেলিত ও জীবন্মৃত অবস্থায় নিদারুণ অন্তর্জ্বালা বহন করে চলেছেন। আবার অনেক প্রবীণ নেতাসহ যেসব প্রতিশ্রুতিশীল ও সম্ভাবনাময় নেতা আজ দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কোনোরকমে সংগঠনে রয়েছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতার, সুলতান মনসুর, খ ম জাহাঙ্গীর উলেল্গখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিকে যারা শক্তি সঞ্চার করে এ দেশের আপামর গণমানুষের মুক্তির সোপান রচনা করেও আজ বিতাড়িত, তাদের মধ্যে আছেন সৈয়দ মোযাহারুল হক বাকী, এমএ রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, মোস্তফা মহসীন মন্টু, কাজী ফিরোজ রশীদ, শেখ শহীদুল ইসলাম ও এমএ রশীদসহ অগণিত নেতাকর্মী।
প্রাক্তন ছাত্রলীগের সব নেতৃত্বকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অবমূল্যায়নে যাদের রক্তক্ষরণ ঘটে, তারা দল-মত নির্বিশেষে ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। অপপ্রচারে একে ধ্বংস করতে না পারলে শেখ হাসিনাকে জনবিচ্ছিন্ন ও অবরুদ্ধ করে রাখতে পারবেন না বিধায় আদর্শবিচ্যুত বামরা আজ উঠেপড়ে লেগেছে।
নূরে আলম সিদ্দিকী : বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এবং আহ্বায়ক, ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশন
No comments