কেন তিনি এলেন না? by শর্মিষ্ঠা সাহা

জীবন-জীবিকা ও প্রয়োজনের তাগিদে শেকড়ের বন্ধন ছেড়ে প্রবাসে চলে যায় মানুষ। পেছনে ফেলে যায় আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, ভাষা-সংস্কৃতি আর সবচেয়ে বড় জন্মভূমির মায়া। সময়ের ব্যবধানে প্রবাসীরা অভিযোজিত হয়ে যান নতুন ভূখণ্ডের জীবনধারায়। অনেক কিছুই বদলায়, তবে শেকড়ের টান থেকে যায় আমৃত্যু। সহজাত প্রবৃত্তির টানে প্রবাসীরা চান নিজের ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐত্যিহ্যের ধারাবাহিকতা প্রবাহিত হোক পরবর্র্তী প্রজন্মের মধ্যে।


সেই তাগিদেই গড়ে ওঠে বাংলা স্কুল, আয়োজন করা হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের, উদযাপিত হয় জাতীয় দিবসগুলো। ঈদ, পূজা, বৌদ্ধপূর্ণিমা উদযাপনের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন নিজস্ব ধর্মীয় সংসৃ্কতির ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়; অন্যদিকে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ়তর হয়।
যেকোনো উৎসব-আয়োজনে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের মনের নিভৃত কোণে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসা আরো জোরদার হয়। দেশের যা কিছু গৌরবগাথা, সন্তানের হৃদয়ে স্থাপন করার অবিরাম প্রয়াসের অংশ হিসেবেই প্রবাসী বাংলাদেশি বাঙালিদের সংগঠন 'বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া (ইঅঅডঅ)' কমনওয়েলথ সম্মেলন উপলক্ষে পার্থে আগত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদানের উদ্যোগ নেয়। অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিও মেলে। দিন ঠিক হয় ৩০ অক্টোবর রবিবার রাতে। প্রথম বিশ্বের ব্যস্ততম জীবনের মধ্যেও এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলতে থাকে পুরোদমে। এ সময় হঠাৎ খবর আসে, প্রধানমন্ত্রী ৩০ অক্টোবর বিকেল ৪টায় অস্ট্রেলিয়া ত্যাগ করবেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বাতিল হয়। মন ভেঙে যায় পার্থবাসী বাঙালিদের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আবার সময় দেন ২৯ অক্টোবর শনিবার বিকেল ৩টায়। আশাহতরা আবার পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে যাওয়ার জন্য আশায় বুক বাঁধেন বহু প্রবাসী। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা এবং আসন সীমাবদ্ধতার কারণে প্রবেশপত্র তৈরি করা হয়। দ্রুত শেষ হয়ে যায় ছয় শতাধিক প্রবেশপত্র। ইঅঅডঅ দলমত-নির্বিশেষে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের শুরুতে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু সদস্যের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের জন্ম নেয়। তাঁদের যুক্তি ছিল_প্রধানমন্ত্রী একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁকে সংবর্ধনা দিয়ে ইঅঅডঅ তার অরাজনৈতিক গঠনতন্ত্রের অবমাননা করছে কি না। কিন্তু এসব দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেছনে ফেলে প্রবাসীরা একমত হন সংবর্ধনার সপক্ষে। কেননা যেকোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান বিদেশের মাটিতে সে দেশের মুখপাত্র। কমনওয়েলথ সম্মেলনে শেখ হাসিনা যোগ দিতে এসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী হিসেবে নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের এই বলিষ্ঠ মতামতের কাছে ধোপে টেকেনি স্বল্পসংখ্যক দ্বিধান্বিতের সংকীর্ণতা। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পার্থবাসী বাঙালিরা যখন প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন, ঠিক তখন অনুষ্ঠানের মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগে খবর এল_তিনি আসবেন না। যা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। ইঅঅডঅ-এর সভাপতি চরম বিব্রত হলেন আশাভঙ্গের খবর ই-মেইলে সবাইকে জানাতে গিয়ে। আর ঘরে ঘরে মা-বাবা বিপাকে পড়লেন নিজের অবুঝ সন্তানদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে। 'কেন শেষ সময়ে অনুষ্ঠান বাতিল হলো?' এমন প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কেউ জানেন না, জবাব দেবেন কী করে! তবে অবুঝ শিশুদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হলেও অন্তরে সবাই জেনে গেলেন, প্রধানমন্ত্রী সংবর্ধনায় না এসে সেই স্বল্পসংখ্যক দ্বিধান্বিতের সংকীর্ণতাকে সত্য প্রমাণিত করলেন। তিনি বিদেশে বাংলাদেশের মুখপাত্র না হয়ে নিজেকে কিছু সুযোগসন্ধানী স্বার্থান্বেষীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরোধিতা যে সংবর্ধনা আটকাতে পারেনি কোনো অজানা আপত্তির মুখে, তিনি বঞ্চিত হলেন সেই সংবর্ধনা থেকে। তাই তো পার্থবাসীর কাছে সে প্রশ্ন থেকেই গেল, কেন তিনি শেষ পর্যন্ত এলেন না?
লেখক : প্রকৌশলী, পার্থ, অস্ট্রেলিয়া।

No comments

Powered by Blogger.