কালান্তরের কড়চা-রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ভালো, কিন্তু পন্থাটা কী? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
মাত্র গতকালই (সোমবার, ১৩ নভেম্বর) ঢাকার একটি দৈনিকে আমার 'নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একটি পোস্টমর্টেম' শীর্ষক লেখাটি বেরিয়েছে। সোমবার সকালেই (লন্ডন সময়) ঢাকা থেকে একাধিক টেলিফোন কল পেয়েছি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ রয়েছেন। তিনি ঢাকায় পরিচিত ব্যক্তিত্ব। নাম উল্লেখ করার অনুমতি না পাওয়ায় করলাম না।
কিন্তু তাঁর প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ জানিয়েছেন।ঢাকার অন্য একটি কাগজে সদ্য সমাপ্ত নাসিকের মেয়র নির্বাচন নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে হাসিনা-নেতৃত্বকে উচ্ছেদের জন্য যে একটি জোটবদ্ধ প্রয়াস চলছে এবং নাসিকের নির্বাচনেও তার প্রতিফলন ঘটেছে, সে কথা বিশদভাবে লিখেছি। লেখাটি পড়ে প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রশ্ন করেছেন, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সব সময়ই নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটে এবং তা ঘটা উচিত। এই নেতা পরিবর্তনের প্রচেষ্টা দলের ভেতর থেকেই হয়ে থাকে। তা কি অনুচিত, না কাম্য?
আমি তাঁকে টেলিফোনে সব কথা বলতে পারিনি। যেটুকু বলেছি তা হলো, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সব সময়ই নিয়মিত নেতা বদল হওয়া উচিত। তবে সব দেশে সব সময় তা হয় না। ব্রিটেনের মতো দেশে টোরি, লেবার বা লিবডেম পার্টিতে এক টার্ম, দুই টার্ম, বড় জোর তিন টার্মের বেশি কোনো নেতা নেতৃত্বে থাকেন না। দলের ভেতর থেকেই নতুন নেতা নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরনো নেতা অবসর নেন।
পশ্চিমা গণতন্ত্রের এই নীতি-নিয়মটি এশিয়া-আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে অনুসৃত হয়নি। ভারতে নেহরু ও ইন্দিরা আমৃত্যু দল ও সরকারের নেতা (দলের অপ্রকাশ্য) ছিলেন। বাংলাদেশে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী আজীবন দলীয় প্রধান ছিলেন। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রাধান্যের দরুন রাজনৈতিক নেতৃত্বও পীর-পুরোহিততন্ত্রের মতো বংশানুক্রমিক হয়ে রয়েছে। ফলে দলের ভেতর বিদ্রোহ হলে একই নামে পাল্টা দল হয় (যেমন ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর ন্যাপ), কিন্তু দলের মূল প্রধানকে সরানো যায় না।
প্রবীণ শিক্ষাবিদকে বলেছি, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রধান দলে ৩০ বছর ধরে নেতৃত্বে (বলতে গেলে সর্বময় কর্তৃত্বে) আছেন। এটা ইউরোপীয় দেশে সম্ভব ছিল না, সম্ভব নয়। এর ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। ভালো দিক হলো, শেখ হাসিনাকে ছাড়া আওয়ামী লীগ একটি ইউনিফায়েড এবং শক্তিশালী পার্টি হিসেবে টিকে থাকতে পারত না। তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হতো। শেখ হাসিনার শক্তির উৎস জনসমর্থন তো বটেই, কিন্তু সেই সমর্থন এসেছে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমা ও গণরাজনীতির উত্তরাধিকার সূত্রে।
আবার এই 'দীর্ঘ এবং অব্যাহত নেতৃত্বের' খারাপ দিক এই যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটা প্লুরালিস্টিক ভিত্তি থাকা দরকার। দলে দীর্ঘকাল একক নেতৃত্ব থাকলে সেই ভিত্তি নষ্ট হয় এবং গণতান্ত্রিক নেতাও একক কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে পারেন, যা দলের গণতান্ত্রিক বিকাশ ব্যাহত করে দলটিকে ক্রমশ দুর্বল ও গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থার দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা বোঝা যাবে।
আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক দলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা হওয়া উচিত। তাতে কারো আপত্তি করার কিছু নেই। প্রশ্ন হলো, নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার বা নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার পদ্ধতিটি কী হবে? আমি এই পাল্টা প্রশ্নটাই করেছি প্রবীণ শিক্ষাবিদকে। বিএনপির খালেদা জিয়াও তো সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, তিনি নতুনদের হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন। কিন্তু তার আগেভাগেই নিজের 'পলাতক সুপুত্র' তারেক রহমানকে দলের কাঁধে একক সিদ্ধান্তে চাপিয়ে দিয়ে তিনি যা বলেছেন, তার সত্যতা রক্ষার কি চেষ্টা করেছেন?
খালেদা জিয়ার মতো শেখ হাসিনা পালকি চেপে সেজেগুঁজে দলের নেতৃত্বে আসেননি; আবার পালকি চেপে তাঁকে নেতৃত্ব ছেড়ে চলে যেতে হবে না। যেতে হলে অতীতে একটি সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পর তিনি যখন স্বেচ্ছায় দলের সভানেত্রীর পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন, তখনই তাঁর নেতৃত্বের ইতি ঘটত। কিন্তু দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর দাবিতে (বেগম সুফিয়া কামালও এই দাবি নিয়ে ছুটে এসেছিলেন) তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। যদি তখন নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটাতে হতো, তাহলে দলের প্রবীণ নেতারাই তো সাধারণ নেতা-কর্মীদের সম্মতি আদায় করে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে নিবৃত্ত করতে এবং নতুন নেতা নির্বাচন করতে পারতেন।
সেই উদ্যোগ গ্রহণের সাহস তাঁরা দেখাননি। কারণ তৃণমূল পর্যায় থেকে দলীয় সমর্থন ছিল শেখ হাসিনার দিকে। এই সমর্থনে চিড় ধরাতে না পেরে তাঁরা কেউ কেউ ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, দল ভাঙা, পাল্টা দল গঠনের উদ্যোগ নেন। তাতে তাঁরা কেউ সফল হননি; বরং দল এবং দেশের গুরুতর ক্ষতি করেছেন। তাঁরা যদি দলে থাকতেন, তাহলে দলের প্লুরালিস্টিক চরিত্র বজায় থাকত। দলীয় সিদ্ধান্তও হতো আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে। শীর্ষ নেতা বা নেত্রীর একক বা একতরফা সিদ্ধান্ত দ্বারা নয়। এই নেতারা অগণতান্ত্রিক পন্থায় হাসিনাকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরাতে চেয়ে, দল ভাঙাভাঙি করে, পাল্টা দল গঠন করতে গিয়ে শেখ হাসিনার একক কর্তৃত্বেই দলটাকে ঠেলে দিয়েছেন; নিজেরা রাজনীতিতে হারাধনের একটি ছেলে হয়ে গেছেন।
শেখ হাসিনা নিজের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেননি। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পর ড. কামাল হোসেন, আবদুস সামাদ আজাদ, আবদুল মালেক উকিলসহ প্রবীণ নেতারা এবং আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েলসহ তখনকার নবীন নেতারা যখন নিজেদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে দলের ঐক্য বজায় রাখা ও নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন, তখন বিদেশ থেকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় গৃহবধূ শেখ হাসিনাকে ডেকে এনে দলের নেতৃত্বে বসিয়ে তাঁরা দল এবং নিজেদের রক্ষা করেছিলেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, এটা হবে স্টপ গ্যাপ অ্যারেঞ্জমেন্ট। হাসিনাকে সামনে রেখে পথ সুগম করে তারপর এক দিন তাঁরা নেতৃত্বে বসবেন। তাঁদের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি বলে পরে তাঁরা কেউ কেউ একজনের পর আরেকজন দলত্যাগ করে পাল্টা দল গঠন করেছেন এবং গণরাজনীতিতে বুদবুদের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।
শেখ হাসিনার একটানা ৩০ বছরের এই নেতৃত্ব দলের সামনে, হাসিনাকে অপছন্দকারী নেতাদের সামনে বহু সুযোগ দিয়েছে তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর, দলে নেতৃত্ব পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়ার। নিজেদের সুযোগসন্ধানী ভূমিকার জন্য তাঁরা তা পারেননি। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের বোঝাতে পারেননি, দলে নেতৃত্বের পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্রিটেন, আমেরিকায় দলের ভেতর থেকে নেতা পরিবর্তনের উদ্যোগ শুরু হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থনে নতুন নেতা নির্বাচিত হন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা রাজি না হলে নতুন নেতা হতে ইচ্ছুক ব্যক্তি অপেক্ষা করেন এবং পরবর্তী সময়ে আবার চেষ্টা করেন। তাঁরা দল ছেড়ে যান না। দলের নেতৃত্বকে পেছন থেকে হটানোর চক্রান্তে যোগ দেন না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হয়েছে এর উল্টোটা। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীর সমর্থন নিয়ে হাসিনা নেতৃত্বকে অপসারণের চেষ্টা করা হলে সেটা হতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। আর সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বা হেরে গিয়ে পেছনে বসে তাঁর নেতৃত্বকে আঘাত করার, দল ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে চক্রান্ত। আওয়ামী লীগের ভেতরে গণতান্ত্রিক পন্থায় নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে অবশ্যই স্বাগত জানাব। কিন্তু চক্রান্ত করে, দল ভাঙাভাঙি করে এই নেতৃত্বকে ধ্বংস করার চক্রান্তকে অবশ্যই নিন্দা জানাব। ঢাকায় অন্য একটি কাগজের নিবন্ধে আমি এই চক্রান্তের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। নাসিকের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যার প্রকাশ ঘটেছিল।
দেশে সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন স্থায়ী করার ষড়যন্ত্রের আমলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবদুর রাজ্জাক (বর্তমানে তিনি গুরুতর অসুস্থ, আল্লাহ তাঁকে রোগমুক্ত ও দীর্ঘজীবী করুন) যে আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন, তা কি কোনো নীতিগত বিরোধের কারণে, না নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জন্য? তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকতে পারেননি; বরং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিকে বিভক্ত করে জে. এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনকে ১০ বছর স্থায়ী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
ড. কামাল হোসেন একজন প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ হয়েও কেবল ব্যক্তি অহমিকায় অন্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে গিয়ে গণফোরাম গঠন করে হাসিনা নেতৃত্বের পতন ঘটাতে পারেননি; কিন্তু দেশে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী আঁতাত গঠন ও তাদের অভ্যুত্থানের পথ সুগম করে দেন। এই কাণ্ড ঘটেছে ব্রিটেনেও। ড. কামাল হোসেনদের মতো ব্রিটেনের লেবার পার্টির ড. ডেভিড ওয়েনের মতো এক শ্রেণীর 'ইনটেলেকচুয়াল' নেতা হঠাৎ লেবার পার্টি ভেঙে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি (পরে লোকে নাম দিয়েছিল ক্রেডিট কার্ড পার্টি) গঠন করে দুই বছরও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেননি। মাঝখানে লেবার পার্টিকে দুর্বল করে টোরি পার্টিকে দীর্ঘ তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন।
আবদুর রাজ্জাকের রাজনীতি তবু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিকড়ে শক্তভাবে প্রোথিত বলে তিনি নিজের ভুল সংশোধন করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসতে পেরেছেন। ড. কামাল হোসেন তা পারেননি। তিনি দীর্ঘকাল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটিতে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিকড়ে তাঁর রাজনীতি ও মনমানসিকতা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত নয়। ফলে অনেক বিদ্যাবুদ্ধি, পাণ্ডিত্য ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এখন ত্রিশঙ্কু মহারাজ।
শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর বিরাগ এখন বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। হাসিনা-বিদ্বেষে অন্ধ হয়েই সম্ভবত তিনি গণফোরামকে কোনো রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে না পেরে, এমনকি নিজের শক্তিতেও আস্থা রাখতে না পেরে এমন সব ব্যক্তির সঙ্গে গিয়ে রাজনৈতিক আঁতাত গড়ার চেষ্টা করেছেন, যাঁরা হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিবিরের সম্পূর্ণ বিরোধী লোক অথবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন মৃত সৈনিক।
কিছুকাল আগে ড. কামাল হোসেন ও ডা. বি. চৌধুরীর তথা গণফোরাম ও বিকল্পধারার আঁতাত অনেকটাই ছিল দুই বিপরীত শিবিরের দুই সেনাপতির (যাঁদের কোনো সৈন্যবাহিনী নেই) ম্যারেজ অব কনভিনিয়েন্স। ম্যারেজটি বেশি দিন টেকেনি। হাসিনাকে জব্দ করার জন্য তিনি কাদের সিদ্দিকীর মতো মরা বাঘের ঘাড়েও সওয়ার হয়েছিলেন। সেই গামছার বাঁধনও বেশি দিন টেকেনি। ড. কামাল হোসেন মনমানসিকতায় একজন প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্রের মানুষ। সামরিক ও স্বৈরশাসনেরও তিনি ঘোর বিরোধী। এই সুনামটুকুও এই প্রাজ্ঞ মানুষটি এক-এগারোর সময় হারিয়েছেন।
এক-এগারোর শাসনেরও লক্ষ্য ছিল মাইনাস টু'র নামে মাইনাস ওয়ান (মাইনাস হাসিনা) থিওরি কার্যকর করা। সম্ভবত এই কারণেই ড. কামাল হোসেন এক-এগারোকে কৌশলী সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু সে চেষ্টাও সফল হয়নি। এক-এগারো এখন ভাঙা রঙ্গমঞ্চ।
মনে হয়েছিল, হাসিনা-বিদ্বেষীর দল (আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে তথাকথিত সুশীল সমাজ ও একটি 'নিরপেক্ষ' মিডিয়া গ্রুপসহ) তাদের বারংবার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেবে এবং গ্রিনরুম কনস্পিরেসির রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত হবে। কিন্তু তারা যে তা হয়নি, তা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনের সময় তাদের ভূমিকা থেকেও বোঝা গেল। ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর নির্বাচন জয়ে ড. কামাল এতই উত্তেজিত যে নিজের বাড়িতে মতবিনিময়সভা ডেকে বলে ফেলেছেন, 'জেলায় জেলায় আইভীবাহিনী চাই। আমি তরুণ হলে তাঁর দলের কর্মী হিসেবে নাম লেখাতাম।'
বুঝতে কষ্ট হয় না ডা. বি. চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী প্রমুখের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে যে হাসিনা-বধ অভিযান তিনি সফল করতে পারেননি, এখন নারায়ণগঞ্জের বিজয়ী মেয়রের কাঁধে চেপে সেই ইচ্ছা সফল করতে চান। ডা. আইভীর ঘনিষ্ঠ ঢাকার এক প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু আমাকে জানিয়েছেন যে এই বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী মেয়র শিশু নন যে তিনি চাটুকারিতায় মুগ্ধ বা বিভ্রান্ত হবেন। তিনি তাঁর শক্তি ও জনপ্রিয়তার শিকড় কোথায়, তা জানেন। ওই প্রবীণ সাংবাদিকই আমাকে জানিয়েছেন, ডা. আইভীকে পটানো না যাক, তাঁর নির্বাচনী সাফল্যকে মূলধন করে আওয়ামী লীগের হাসিনা-বিদ্বেষী প্রবীণ ও নবীন নেতাদের একটা গ্রুপ 'তৃণমূল আওয়ামী লীগ' গঠনের পাঁয়তারা করছে।
এরা ইতিহাস থেকে কোনো অভিজ্ঞতাই অর্জন করেনি।
লন্ডন, ১৪ নভেম্বর, সোমবার, ২০১১
আমি তাঁকে টেলিফোনে সব কথা বলতে পারিনি। যেটুকু বলেছি তা হলো, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সব সময়ই নিয়মিত নেতা বদল হওয়া উচিত। তবে সব দেশে সব সময় তা হয় না। ব্রিটেনের মতো দেশে টোরি, লেবার বা লিবডেম পার্টিতে এক টার্ম, দুই টার্ম, বড় জোর তিন টার্মের বেশি কোনো নেতা নেতৃত্বে থাকেন না। দলের ভেতর থেকেই নতুন নেতা নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরনো নেতা অবসর নেন।
পশ্চিমা গণতন্ত্রের এই নীতি-নিয়মটি এশিয়া-আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে অনুসৃত হয়নি। ভারতে নেহরু ও ইন্দিরা আমৃত্যু দল ও সরকারের নেতা (দলের অপ্রকাশ্য) ছিলেন। বাংলাদেশে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী আজীবন দলীয় প্রধান ছিলেন। আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রাধান্যের দরুন রাজনৈতিক নেতৃত্বও পীর-পুরোহিততন্ত্রের মতো বংশানুক্রমিক হয়ে রয়েছে। ফলে দলের ভেতর বিদ্রোহ হলে একই নামে পাল্টা দল হয় (যেমন ভাসানী ন্যাপ, মোজাফফর ন্যাপ), কিন্তু দলের মূল প্রধানকে সরানো যায় না।
প্রবীণ শিক্ষাবিদকে বলেছি, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের মতো একটি প্রধান দলে ৩০ বছর ধরে নেতৃত্বে (বলতে গেলে সর্বময় কর্তৃত্বে) আছেন। এটা ইউরোপীয় দেশে সম্ভব ছিল না, সম্ভব নয়। এর ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। ভালো দিক হলো, শেখ হাসিনাকে ছাড়া আওয়ামী লীগ একটি ইউনিফায়েড এবং শক্তিশালী পার্টি হিসেবে টিকে থাকতে পারত না। তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হতো। শেখ হাসিনার শক্তির উৎস জনসমর্থন তো বটেই, কিন্তু সেই সমর্থন এসেছে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমা ও গণরাজনীতির উত্তরাধিকার সূত্রে।
আবার এই 'দীর্ঘ এবং অব্যাহত নেতৃত্বের' খারাপ দিক এই যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটা প্লুরালিস্টিক ভিত্তি থাকা দরকার। দলে দীর্ঘকাল একক নেতৃত্ব থাকলে সেই ভিত্তি নষ্ট হয় এবং গণতান্ত্রিক নেতাও একক কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে পারেন, যা দলের গণতান্ত্রিক বিকাশ ব্যাহত করে দলটিকে ক্রমশ দুর্বল ও গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থার দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা বোঝা যাবে।
আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক দলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা হওয়া উচিত। তাতে কারো আপত্তি করার কিছু নেই। প্রশ্ন হলো, নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার বা নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার পদ্ধতিটি কী হবে? আমি এই পাল্টা প্রশ্নটাই করেছি প্রবীণ শিক্ষাবিদকে। বিএনপির খালেদা জিয়াও তো সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, তিনি নতুনদের হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন। কিন্তু তার আগেভাগেই নিজের 'পলাতক সুপুত্র' তারেক রহমানকে দলের কাঁধে একক সিদ্ধান্তে চাপিয়ে দিয়ে তিনি যা বলেছেন, তার সত্যতা রক্ষার কি চেষ্টা করেছেন?
খালেদা জিয়ার মতো শেখ হাসিনা পালকি চেপে সেজেগুঁজে দলের নেতৃত্বে আসেননি; আবার পালকি চেপে তাঁকে নেতৃত্ব ছেড়ে চলে যেতে হবে না। যেতে হলে অতীতে একটি সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পর তিনি যখন স্বেচ্ছায় দলের সভানেত্রীর পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন, তখনই তাঁর নেতৃত্বের ইতি ঘটত। কিন্তু দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর দাবিতে (বেগম সুফিয়া কামালও এই দাবি নিয়ে ছুটে এসেছিলেন) তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। যদি তখন নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটাতে হতো, তাহলে দলের প্রবীণ নেতারাই তো সাধারণ নেতা-কর্মীদের সম্মতি আদায় করে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে নিবৃত্ত করতে এবং নতুন নেতা নির্বাচন করতে পারতেন।
সেই উদ্যোগ গ্রহণের সাহস তাঁরা দেখাননি। কারণ তৃণমূল পর্যায় থেকে দলীয় সমর্থন ছিল শেখ হাসিনার দিকে। এই সমর্থনে চিড় ধরাতে না পেরে তাঁরা কেউ কেউ ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, দল ভাঙা, পাল্টা দল গঠনের উদ্যোগ নেন। তাতে তাঁরা কেউ সফল হননি; বরং দল এবং দেশের গুরুতর ক্ষতি করেছেন। তাঁরা যদি দলে থাকতেন, তাহলে দলের প্লুরালিস্টিক চরিত্র বজায় থাকত। দলীয় সিদ্ধান্তও হতো আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে। শীর্ষ নেতা বা নেত্রীর একক বা একতরফা সিদ্ধান্ত দ্বারা নয়। এই নেতারা অগণতান্ত্রিক পন্থায় হাসিনাকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরাতে চেয়ে, দল ভাঙাভাঙি করে, পাল্টা দল গঠন করতে গিয়ে শেখ হাসিনার একক কর্তৃত্বেই দলটাকে ঠেলে দিয়েছেন; নিজেরা রাজনীতিতে হারাধনের একটি ছেলে হয়ে গেছেন।
শেখ হাসিনা নিজের ইচ্ছায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেননি। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের পর ড. কামাল হোসেন, আবদুস সামাদ আজাদ, আবদুল মালেক উকিলসহ প্রবীণ নেতারা এবং আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েলসহ তখনকার নবীন নেতারা যখন নিজেদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে দলের ঐক্য বজায় রাখা ও নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন, তখন বিদেশ থেকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় গৃহবধূ শেখ হাসিনাকে ডেকে এনে দলের নেতৃত্বে বসিয়ে তাঁরা দল এবং নিজেদের রক্ষা করেছিলেন। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, এটা হবে স্টপ গ্যাপ অ্যারেঞ্জমেন্ট। হাসিনাকে সামনে রেখে পথ সুগম করে তারপর এক দিন তাঁরা নেতৃত্বে বসবেন। তাঁদের সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি বলে পরে তাঁরা কেউ কেউ একজনের পর আরেকজন দলত্যাগ করে পাল্টা দল গঠন করেছেন এবং গণরাজনীতিতে বুদবুদের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন।
শেখ হাসিনার একটানা ৩০ বছরের এই নেতৃত্ব দলের সামনে, হাসিনাকে অপছন্দকারী নেতাদের সামনে বহু সুযোগ দিয়েছে তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর, দলে নেতৃত্ব পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়ার। নিজেদের সুযোগসন্ধানী ভূমিকার জন্য তাঁরা তা পারেননি। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের বোঝাতে পারেননি, দলে নেতৃত্বের পরিবর্তন প্রয়োজন। ব্রিটেন, আমেরিকায় দলের ভেতর থেকে নেতা পরিবর্তনের উদ্যোগ শুরু হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠদের সমর্থনে নতুন নেতা নির্বাচিত হন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা রাজি না হলে নতুন নেতা হতে ইচ্ছুক ব্যক্তি অপেক্ষা করেন এবং পরবর্তী সময়ে আবার চেষ্টা করেন। তাঁরা দল ছেড়ে যান না। দলের নেতৃত্বকে পেছন থেকে হটানোর চক্রান্তে যোগ দেন না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হয়েছে এর উল্টোটা। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীর সমর্থন নিয়ে হাসিনা নেতৃত্বকে অপসারণের চেষ্টা করা হলে সেটা হতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। আর সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বা হেরে গিয়ে পেছনে বসে তাঁর নেতৃত্বকে আঘাত করার, দল ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে চক্রান্ত। আওয়ামী লীগের ভেতরে গণতান্ত্রিক পন্থায় নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে অবশ্যই স্বাগত জানাব। কিন্তু চক্রান্ত করে, দল ভাঙাভাঙি করে এই নেতৃত্বকে ধ্বংস করার চক্রান্তকে অবশ্যই নিন্দা জানাব। ঢাকায় অন্য একটি কাগজের নিবন্ধে আমি এই চক্রান্তের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। নাসিকের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যার প্রকাশ ঘটেছিল।
দেশে সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন স্থায়ী করার ষড়যন্ত্রের আমলে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আবদুর রাজ্জাক (বর্তমানে তিনি গুরুতর অসুস্থ, আল্লাহ তাঁকে রোগমুক্ত ও দীর্ঘজীবী করুন) যে আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন, তা কি কোনো নীতিগত বিরোধের কারণে, না নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের জন্য? তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টিকতে পারেননি; বরং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিকে বিভক্ত করে জে. এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনকে ১০ বছর স্থায়ী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
ড. কামাল হোসেন একজন প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ হয়েও কেবল ব্যক্তি অহমিকায় অন্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে গিয়ে গণফোরাম গঠন করে হাসিনা নেতৃত্বের পতন ঘটাতে পারেননি; কিন্তু দেশে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী আঁতাত গঠন ও তাদের অভ্যুত্থানের পথ সুগম করে দেন। এই কাণ্ড ঘটেছে ব্রিটেনেও। ড. কামাল হোসেনদের মতো ব্রিটেনের লেবার পার্টির ড. ডেভিড ওয়েনের মতো এক শ্রেণীর 'ইনটেলেকচুয়াল' নেতা হঠাৎ লেবার পার্টি ভেঙে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টি (পরে লোকে নাম দিয়েছিল ক্রেডিট কার্ড পার্টি) গঠন করে দুই বছরও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেননি। মাঝখানে লেবার পার্টিকে দুর্বল করে টোরি পার্টিকে দীর্ঘ তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন।
আবদুর রাজ্জাকের রাজনীতি তবু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিকড়ে শক্তভাবে প্রোথিত বলে তিনি নিজের ভুল সংশোধন করে আওয়ামী লীগে ফিরে আসতে পেরেছেন। ড. কামাল হোসেন তা পারেননি। তিনি দীর্ঘকাল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটিতে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিকড়ে তাঁর রাজনীতি ও মনমানসিকতা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত নয়। ফলে অনেক বিদ্যাবুদ্ধি, পাণ্ডিত্য ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এখন ত্রিশঙ্কু মহারাজ।
শেখ হাসিনার প্রতি তাঁর বিরাগ এখন বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। হাসিনা-বিদ্বেষে অন্ধ হয়েই সম্ভবত তিনি গণফোরামকে কোনো রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে না পেরে, এমনকি নিজের শক্তিতেও আস্থা রাখতে না পেরে এমন সব ব্যক্তির সঙ্গে গিয়ে রাজনৈতিক আঁতাত গড়ার চেষ্টা করেছেন, যাঁরা হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিবিরের সম্পূর্ণ বিরোধী লোক অথবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন মৃত সৈনিক।
কিছুকাল আগে ড. কামাল হোসেন ও ডা. বি. চৌধুরীর তথা গণফোরাম ও বিকল্পধারার আঁতাত অনেকটাই ছিল দুই বিপরীত শিবিরের দুই সেনাপতির (যাঁদের কোনো সৈন্যবাহিনী নেই) ম্যারেজ অব কনভিনিয়েন্স। ম্যারেজটি বেশি দিন টেকেনি। হাসিনাকে জব্দ করার জন্য তিনি কাদের সিদ্দিকীর মতো মরা বাঘের ঘাড়েও সওয়ার হয়েছিলেন। সেই গামছার বাঁধনও বেশি দিন টেকেনি। ড. কামাল হোসেন মনমানসিকতায় একজন প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্রের মানুষ। সামরিক ও স্বৈরশাসনেরও তিনি ঘোর বিরোধী। এই সুনামটুকুও এই প্রাজ্ঞ মানুষটি এক-এগারোর সময় হারিয়েছেন।
এক-এগারোর শাসনেরও লক্ষ্য ছিল মাইনাস টু'র নামে মাইনাস ওয়ান (মাইনাস হাসিনা) থিওরি কার্যকর করা। সম্ভবত এই কারণেই ড. কামাল হোসেন এক-এগারোকে কৌশলী সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু সে চেষ্টাও সফল হয়নি। এক-এগারো এখন ভাঙা রঙ্গমঞ্চ।
মনে হয়েছিল, হাসিনা-বিদ্বেষীর দল (আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে তথাকথিত সুশীল সমাজ ও একটি 'নিরপেক্ষ' মিডিয়া গ্রুপসহ) তাদের বারংবার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেবে এবং গ্রিনরুম কনস্পিরেসির রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত হবে। কিন্তু তারা যে তা হয়নি, তা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনের সময় তাদের ভূমিকা থেকেও বোঝা গেল। ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর নির্বাচন জয়ে ড. কামাল এতই উত্তেজিত যে নিজের বাড়িতে মতবিনিময়সভা ডেকে বলে ফেলেছেন, 'জেলায় জেলায় আইভীবাহিনী চাই। আমি তরুণ হলে তাঁর দলের কর্মী হিসেবে নাম লেখাতাম।'
বুঝতে কষ্ট হয় না ডা. বি. চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী প্রমুখের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে যে হাসিনা-বধ অভিযান তিনি সফল করতে পারেননি, এখন নারায়ণগঞ্জের বিজয়ী মেয়রের কাঁধে চেপে সেই ইচ্ছা সফল করতে চান। ডা. আইভীর ঘনিষ্ঠ ঢাকার এক প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু আমাকে জানিয়েছেন যে এই বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী মেয়র শিশু নন যে তিনি চাটুকারিতায় মুগ্ধ বা বিভ্রান্ত হবেন। তিনি তাঁর শক্তি ও জনপ্রিয়তার শিকড় কোথায়, তা জানেন। ওই প্রবীণ সাংবাদিকই আমাকে জানিয়েছেন, ডা. আইভীকে পটানো না যাক, তাঁর নির্বাচনী সাফল্যকে মূলধন করে আওয়ামী লীগের হাসিনা-বিদ্বেষী প্রবীণ ও নবীন নেতাদের একটা গ্রুপ 'তৃণমূল আওয়ামী লীগ' গঠনের পাঁয়তারা করছে।
এরা ইতিহাস থেকে কোনো অভিজ্ঞতাই অর্জন করেনি।
লন্ডন, ১৪ নভেম্বর, সোমবার, ২০১১
No comments