প্রাইভেট কোচিং সঠিক জ্ঞানার্জনের পথে অন্তরায় by মুহম্মদ মাছুম বিল্লাহ

দেশের আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ধরনের কোচিং সেন্টার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকে ধ্বংস করতে বসেছে। শুধু আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প নয়, বরং আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয়েছে এই শিক্ষাদানরূপী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে? নিশ্চয়ই সময়ের দাবিতে ও প্রয়োজনে। আমাদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে পারেনি এবং তাদের স্কুল ও কলেজের প্রতি আগ্রহী করতে পারেনি।


তাই ছাত্রছাত্রীরা ভিড় জমাচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলোতে। স্কুল-কলেজের ক্লাসরুম ফাঁকা অথচ ভিড় সব কোচিং সেন্টারে কিংবা শিক্ষকদের বাসায়। স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রী রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে_শারীরিক ও অর্থনৈতিক শাস্তি; তার পরও সন্তোষজনক উপস্থিতি নেই ক্লাসে। দিন দিন প্রতিযোগিতা বেড়ে যাচ্ছে এবং এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো যোগ্য করে গড়ে তুলতে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা পালন করতে পারেনি বিধায় অভিভাবক এবং ছাত্রছাত্রীরা কোচিংমুখী হয়েছে। ব্যতিক্রম ছাড়া কোচিংগুলো তাদের সে প্রত্যাশা পূরণে সফলও হয়েছে; আর তাই এই ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে। দিন দিন এর ভিত হয়েছে মজবুত ও শক্ত। কোচিং সেন্টারগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক বেকার তরুণ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকা। কোচিং সেন্টারগুলো যদি স্কুল ও কলেজের বিকল্প হয়, তাহলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কী ভূমিকা আছে? শুধু কি সার্টিফিকেট অর্জন করার মাধ্যম?
প্রাইভেটের প্রতি নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য আমরা বাস্তবমুখী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনটি টার্ম পরীক্ষা হবে। প্রতিটি টার্ম পরীক্ষার খাতা ইন্টার স্কুল এবং ইন্টার কলেজ শিক্ষকরা দেখবেন। নিজস্ব স্কুল কিংবা কলেজের শিক্ষক কোনো খাতা মূল্যায়ন করবেন না। খাতা মূল্যায়ন করার জন্য শিক্ষকদের সম্মানী থাকবে। তাহলে তাঁরা খাতাও ভালোভাবে দেখবেন এবং ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে; কারণ খাতা ভালোভাবে মূল্যায়ন করে ছাত্রছাত্রীদের দেখানো উচিত, যাতে তারা তাদের ভুলত্রুটি ধরতে পারে এবং শোধরাতে পারে যে কাজটি এখন অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই হয় না। আর খাতা মূল্যায়নও প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন, স্কুল ও কলেজের ওই শিক্ষকদের পেছনে ছাত্রছাত্রীরা ভিড় জমায়। আর যারা ভিড় জমায় তারাই ওই শিক্ষকের কাছে বেশি নম্বর পায়। অতএব শিক্ষার্থী ও অভিভাবক_সবাই ওই শিক্ষকদের পেছনে দৌড়ান। একই স্কুলের কিংবা কলেজের শিক্ষক প্রশ্নপত্রও প্রণয়ন করবেন না। অন্য স্কুল কিংবা কলেজের শিক্ষক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবেন। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা এক ধরনের দক্ষতা, এই দক্ষতা সবার থাকে না। প্রশ্ন করে করে শিক্ষকদের এই দক্ষতা অর্জন করতে হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ সম্মানী থাকবে। শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতে পড়াতে তাঁদের ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট করে ফেলেছেন। এখন তাঁরা প্রশ্নও তৈরি করতে পারেন না, প্রশ্ন হুবহু গাইড বই কিংবা টেস্ট পেপারস থেকে তুলে দেন। ইন্টারনাল পরীক্ষাগুলোতে এক স্কুল ও কলেজের শিক্ষকরা অন্য স্কুল ও কলেজে পরীক্ষা গ্রহণ করতে যাবেন। তাহলে একদিকে যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাঁদের কর্মপরিধিও বৃদ্ধি পাবে। এতে শিক্ষকদের মন উদার হবে এবং প্রাইভেট পড়ার প্রবণতাও কমে যাবে। শিক্ষকদেরও অর্থের প্রয়োজন আছে। যুগ পাল্টেছে। এখন আর সেই সময় নেই যে শিক্ষকরা বিনা পয়সায় ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞান দান করবেন। আবার এটিও ঠিক, শিক্ষকরা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হবেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে জ্ঞানের চর্চা হচ্ছে তার সঙ্গে পরিচিত হবেন। কিন্তু শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানোটাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছেন যে কোনোভাবেই তাঁদের আর তা করা হচ্ছে না। আর এই প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে কোনো কোনো শিক্ষক কিছুটা অসততার আশ্রয় নিচ্ছেন। যাঁরা নিচ্ছেন তাঁদের সংখ্যা খুব কম; কিন্তু দোষটা পড়ছে পুরো শিক্ষক সমাজের ওপর। তার চেয়েও বড় কথা হলো, যে উদ্দেশ্যে পরীক্ষা নেওয়া হয় সেই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। এই অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না।
কোচিং সেন্টারগুলোতে শিক্ষার্থীরা কঠিন বিষয়গুলো শিখতে একটি নির্দিষ্ট সময়, যেমন দুই মাস বা তিন মাস যেতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে কিংবা টিচারদের বাসায় পড়তে যাচ্ছে ১২ মাসই। তাদের মনে রাখতে হবে যে হাতুড়ে ডাক্তার দ্বারা যেমন কোনো চিকিৎসা হয় না, বরং রোগ বেড়ে যাওয়া বা বিপজ্জনক দিকে টার্ন করার আশঙ্কা থাকে; ঠিক একইভাবে তথাকথিত কোচিং সেন্টারগুলোতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কোনো শিক্ষক নেই। বিশাল বিশাল সাইনবোর্ড টাঙিয়ে এবং পত্রিকার পাতা ভর্তি করে বিজ্ঞাপন দিয়ে চলছে এদের রমরমা ব্যবসা। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না; কারণ এসব জায়গায় অন্তত কিছু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে_হয়তো এমন ভাবনা থেকেই।
ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকরা কোচিংয়ের শরণাপন্ন হন_কারণ স্কুল কিংবা কলেজে একই ক্লাসে অনেক ছাত্রছাত্রী থাকে বলে দুর্বল এবং অধিক মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী গুরুত্ব পায় না। তারা মনে করে, বিশেষ কোনো কোচিংয়ে গেলে তারা উপযুক্ত গুরুত্ব পাবে। কিন্তু কোচিংয়ে কী হয়? একই বিষয় চেপে ধরে বারবার মুখস্থ করানো হয় আর বারবার পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই বিষয় একেবারেই সৃজনশীল নয়।
লেখক : প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি, সাবেক ইংরেজি অধ্যাপক, সিলেট, কুমিল্লা ও মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ এবং রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ
mmbillah2000@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.