বিষণ্নতা পাশে নিয়ে থাকবে শচীনের শততম
সবাই তাঁর শততম সেঞ্চুরির অপেক্ষায়। ইডেন টেস্টের প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ হলেও শচীন টেন্ডুলকার অচিরেই হয়তো পাবেন সেই সেঞ্চুরির দেখা। পুরস্কার আর প্রশংসায় ভাসবেন তখন। কিন্তু একটা 'পুরস্কার' আর পাওয়া হবে না টেন্ডুলকারের। তাঁর ওই ইনিংস নিয়ে পিটার রোবাকের লেখা। 'ক্রিকেট লিখিয়েদের টেন্ডুলকার' যে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিয়েছেন শনিবার! আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য-এর এ লেখা পিটার রোবাককে নিয়েই...
স্বয়ং মনসুর আলী খান পতৌদির মৃত্যুর পরও যখন ভারতের খেলা প্রথম টেস্টে কোনোরকম আনুষ্ঠানিক শোক জ্ঞাপন করেনি তাঁরই শহরের মাঠ কোটলা তখন পিটার রোবাকের মৃত্যুতে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুই দল ইডেনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, ভাবতেই পারছি না। ক্রিকেট প্রশাসকদের ঔদাসীন্যে অবশ্য এ মুহূর্তে কিছু এসে যাচ্ছে না। রোববার এমন ছুটির দিনেও রোবাক-মৃত্যু ঘিরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহলে যা বিস্ফোরণ, তাতে যাবতীয় ক্রিকেট প্রেস বঙ্সহ যেখানে যেখানে ক্রিকেট খেলা হয়, তার মেজাজ এমনিই অর্ধনমিত। বরেণ্য ক্রিকেটাররা পর্যন্ত হতচকিত এক ক্রিকেট সমালোচকের মৃত্যুতে। স্টিভ ওয়াহ থেকে ইয়ান চ্যাপেল সবাই একমত, আধুনিক ক্রিকেট তার সেরা লিখিয়েকে হারাল। মহেন্দ্র সিং ধোনির নিজের ব্যক্তিগতভাবে রোবাকের মর্মার্থ অনুসন্ধানে কোনো স্পৃহা থাকার কথা নয়, যদিও তাঁর জায়গায় অনিল কুম্বলে অধিনায়ক থাকলে কী হতো, কৌতূহল থেকে গেল। শেষ যেবার ভারত অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল, সাইমন্ডস-ভাজ্জি সংঘাত এবং ওই তীব্র উত্তপ্ত পরিবেশে ভারতের হয়ে গর্জন করেছিল রোবাকের কম্পিউটার। সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের প্রথম পাতায় রোবাক লিখেন, 'ওহে পন্টিং, ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের সম্মান। এবার গদি ছাড়ো।' যে সময়ের কথা তখন ভিডিও গেমসেও অস্ট্রেলিয়া ৪৭ অল আউট হয় না। পন্টিংরা তখন ক্রিকেট-বিশ্বে একই সঙ্গে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর। সেই সময় ভিনদেশের ক্রিকেট লিখিয়ে হিসেবে সিডনিতে চাকরি করে সিডনিবাসী পন্টিংকে ওই রকম আক্রমণ করা অকল্পনীয় বুকের পাটা দরকার। মাসখানেক পর ধোনিদের নতুন অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় আবার রোবাকের স্মৃতিজনিত বিষণ্নতা সিডনি-মেলবোর্নের প্রেস বঙ্কে আক্রমণ করতে বাধ্য। অঙ্ফোর্ডজাত ইংরেজ লেখকের সেটাই হবে সর্বোচ্চ শোকগাথা। রোবাক সমকামী ছিলেন না উভকামী? আত্মহত্যা করেছেন না চক্রান্ত? নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু? এগুলো তো অনুষঙ্গ। এ সত্যানুসন্ধানে কী আসে যায়। পিটার রোবাকের সেই ভিন্টেজ ল্যাপটপ আর গর্জন করবে না, এর চেয়ে মর্মান্তিক কোনো কিছুই হতে পারে না আধুনিক ক্রিকেট মিডিয়ায়। গুগলে রোববার রাতে একটা হেড লাইন দেখলাম। 'পিটার, উই হার্ডলি নিউ ইউ। বাট ইউ টোল্ড দ্য গেম লাইক নো আদার।' ভারতীয় সাংবাদিকরা যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁদের মনে হবে এর চেয়ে সত্যি কথা আর হয় না। অত্যন্ত ভালো ব্যবহার, সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, ভারত সম্পর্কে অপরিসীম আগ্রহ, অথচ কোথাও যেন মানুষটা নিঃসঙ্গ আর কিছুটা খেয়ালি ছিলেন। প্রেস বঙ্ েতিনি ঢোকামাত্র জমে যেত। কিন্তু রাতের কোনো আড্ডায় তাঁকে দেখেছি বলে মনেই করতে পারছি না। ১৯৯৯ সালে তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম কিছু শিশুকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ আসে। এর বছরখানেক পর ইয়ান বোথাম তাঁর বইতে লেখেন, 'রোবাক লোকটা সম্পূর্ণ অদ্ভুত। ওর বাড়িতে একবার আমায় ডেকেছিল। গিয়ে দেখি গেরুয়া পরে ধ্যান করছে। আর সেভাবে টানা বসেই রইল। আমি আসা সত্ত্বেও চোখের পাতা খুলল না।' রোবাককে তাঁর প্রাক্তন কাউন্টি-মেটের পর্যবেক্ষণ নিয়ে জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, 'বোথামের সমস্যা হলো গল্পগুলোও যথেষ্ট রংদার করতে পারে না।' যৌন হেনস্তা নিয়ে স্বভাবতই জিজ্ঞেস করা যায়নি। কিন্তু একটা জিনিস বরাবর লক্ষ করা গিয়েছে। জিম্বাবুয়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা এ দুটি দেশের অনাথ শিশুদের জন্য প্রচুর কাজকর্ম করেছেন রোবাক। আনন্দবাজারের খেলার পাতায় যখনই লিখেছেন, সেই টাকা অকাতরে দান করে দিয়েছেন শিশুদের চ্যারিটি তহবিলে। চোখের সামনে দেখা। রোববারও হর্ষ ভোগলে বলছিলেন, 'জিম্বাবুয়ে গেলে কখনো দেখে আসবেন রোবাক শিশুদের জন্য কত কাজকর্ম করেছেন।' এত কিছু দেখেশুনেটুনে সত্যিই প্রশ্ন জাগে, কোনটা সত্যি? আলো না আঁধার? নাকি দুটোই? একটা ব্যাপারে আলো-আঁধার নেই। আধুনিক ক্রিকেট লিখিয়েদের সংসারে বটগাছ উৎপাটিত হলো। নেভিল কার্ডাসের মতো ব্যক্তির মধ্যে জাতিকে দেখতেন রোবাক। ক্রিকেটীয় স্ট্রোকের মাধ্যমে খুঁজে নিতেন সেই দেশের ইতিহাসকে। শচীনের স্ট্রোকবাজি নিয়ে লিখতেন, 'শচীন হলো সুখী, স্বাধীন ভারতের অভিব্যক্তি। ও এমন একটা সময় খেলছে যখন ভারতের পারমাণবিক বোমা রয়েছে। বেশ কিছু বিলিওনেয়ার আছে। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু শচীনের পূর্বসূরি গাভাস্কারের আমলে মারমুখী ক্রিকেট সম্ভব ছিল না। গাভাস্কারকে যুগের প্রয়োজন মেটাতেই ভারতীয় ক্রিকেটের স্বাধীনতা সংগ্রামী হতে হয়েছে।' এই পর্যন্ত কোথাও যেন আধুনিক সময়ের কার্ডাস। কিন্তু এরপর তাঁকেও অতিক্রম করে যাচ্ছেন তিনটি বাড়তি দৃষ্টিকোণে।
সাহস। একনিষ্ঠ সত্যানুসন্ধান। গভীর ক্রিকেটীয় মনন।
সমারসেট ক্যাপ্টেন থাকার সময় যিনি ভিভ-বোথামের সম্মিলিত পাঙ্গা সহ্য করেছেন তাঁর ক্রিকেট লেখনী যে প্রবল খরস্রোতেও নির্ভীক থাকবে, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এটা সত্যিই অনবদ্য যে কাউন্টি ক্রিকেটে ১৮ হাজার রান, মৌসুমে ১২ বারের মধ্যে ৯ বার হাজার রান পূর্ণ করার অভিজ্ঞতা এবং ক্রিকেট সার্কিটে অবাধ ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও লেখায় কখনো তাঁর অবৈধ ছায়াপাত ঘটাননি। তিন মহাদেশ মিলিয়ে এত অগণিত পাঠকসংখ্যা কার্ডাসেরও ছিল না, যাঁরা প্রতি মুহূর্তে টিভি এবং নেট ঘেঁটে ঠিক কী ঘটেছিল জেনে নেওয়ার আর প্রত্যক্ষ দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা যদি হেলমেট-পূর্ব এবং উত্তর দুই ভাগে ক্রিকেট রেকর্ডকে বিভক্ত করার কথা বলেন, তাহলে ক্রিকেট সাংবাদিকতাকেও দুই ভাগে ভাগ করা উচিত। লাইভ টিভি-পূর্বক এবং পর।
সেদিনই প্রাক্তন এক উইজডেন সম্পাদক বলছিলেন, এমট রবিনসনকে নিয়ে কার্ডাস মজার মজার কিছু ব্যক্তিগত কথা লিখেছিলেন। তা পড়ে রবিনসন সেই সম্পাদকের দাদাকে বলেন, 'লোকটাকে তো আমি চিনিই না। ও আমার সম্পর্কে এত কথা জানল কী করে?' কার্ডাসকে বলা হলো। উনি গম্ভীর হয়ে বললেন, 'অভিযোগ জানানোর কী আছে? চিনি বা না চিনি, আমি তো রবিনসন সম্পর্কে ভালো ভালো কথাই লিখেছি।'
আধুনিক ক্রিকেট দুনিয়া তাই কার্ডাসকে মহান ক্রিকেট-নাট্যকার বলে বিদ্রূপ করে। মহান ক্রিকেট লেখক বলে না। তাঁর আমলের সর্বোচ্চ বিতর্ক বডিলাইনের সম্পর্কে একটা লেখাতেও না রয়েছে কার্ডাসের সরব প্রতিবাদ, না সর্বোচ্চ প্রশংসা। বাকি লেখাতেও অতিরঞ্জন। ঘটনার চেয়ে নাটক এবং সাহিত্যের প্রতি অনর্গল ঝুঁকে থাকা।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক রোবাক লিখেছেন তুলনামূলকভাবে অনেক কঠিন সময়ে। যখন বিশ্বে খবরের দরজা খুলে গিয়েছে। অথচ মৃত্যুর পরেও দেখছি রোবাকের শ্রেষ্ঠত্বকে আক্রমণ করার কোনো ছিদ্র খোলা নেই। টেকনিক্যাল বুনন। স্টিভ ওয়াহর মতো মানুষ অকাতরে বলেছেন, ক্যাপ্টেন থাকার সময় তিনি মুগ্ধচিত্তে রোবাক পড়তেন দিনের খেলার খুঁটিনাটি দিকগুলো সম্পর্কে আরো অবহিত হওয়ার জন্য। শরীরী ভাষাগুলো আরো ভালো বোঝার জন্য। একই মত পোষণ করেন শেন ওয়ার্ন, যিনি বাকি ৯৯৯টা ব্যাপারে স্টিভের চেয়ে অন্য মেরুতে। ক্রিকেটারকে পরামর্শ। অপ্রিয় সত্য সটান বলা। কবিত্বের ছোঁয়ায় ৩০ বছরেরও বেশি ক্যাপটিভ অডিয়েন্স রক্ষা করে যাওয়া। ক্রিকেট সাংবাদিকতার শচীন তিনিই। এত নিশ্চিত যে, তর্কযোগ্য শব্দটা যোগ করার প্রয়োজনও দেখছি না। চ্যানেল নাইনের দেশের যুগন্ধর অধিনায়ক যদি বলেন, অমুকের লেখাটা পড়তাম দিনের খেলাটা আরো ভালো করে বোঝার জন্য, তার চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে?
কেপটাউনের সাদার্ন সান হোটেলে ছিলেন শুনে অবাক লাগছে। অথচ ভারতে ইচ্ছাকৃত সস্তার হোটেলে উঠতেন। রোবাকের যুক্তি ছিল, পাঁচ তারার বিলাসে তাঁর ভারতের আত্মা-উদ্ঘাটন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। প্রায়-ভাঙা একটা কম্পিউটার ছিল রোবাকের। মেলবোর্ন প্রেস বঙ্ েএকবার এই সাংবাদিকের হাতে লেগে পড়ে যাওয়ায় ওটা পুরো ভেঙে যায়। রোবাক এমন ভেঙে পড়েন যে সহকর্মীরা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছিল, ভালোই তো হলো, নতুনটার আগমন অবশ্যম্ভাবী হলো। রোবাক ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, 'অতীত ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলতে চাই না।' পরের দিন ওটাকেই মেরামতটেরামত করে ফিরিয়ে এনেছিলেন প্রেস বঙ্।ে আজ মনে হচ্ছে শচীনের ব্যাটের মতো ওটারও জায়গা হওয়া উচিত কোনো অভিজাত ক্রিকেট জাদুঘরে। টোয়েন্টি টোয়েন্টি কভার করতেন না রোবাক। দুই দেশের মধ্যে ওয়ানডে সিরিজ কখনো নয়। একমাত্র বিশ্বকাপ। আর গুরুত্বপূর্ণ সব টেস্ট। মাঠের বাইরে কি ঘটছে কখনো কর্ণপাত করেননি। ড্রেসিংরুমের ব্যাপারস্যাপারে আগ্রহ ছিল না। বলতেন, 'আমার কাছে ক্রিকেট সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দিনের পরবর্তী ৯০ ওভার পর্যন্ত। ওইটুকুই আমার সীমানা। ওটা দিয়ে যদি শচীন টেন্ডুলকারের জিনিয়াস ব্যাখ্যা করা যায়, বাকিদেরও যাবে!'
শততম সেঞ্চুরি হলে অনেক উপঢৌকন বাড়তি পাবেন শচীন। কিন্তু কোথাও মনে হচ্ছে সেগুলো সবই টাকার মূল্যে কিনতে পাওয়া যায়। টাকা কিনতে পারবে না এমন একটা উপহার কিন্তু তিনি হারালেন।
কীর্তি-পরবর্তী রোবাকের একটা লেখা! যা ক্রিকেট-বিশ্বে এত বেশি পাঠকের গোগ্রাসে গেলার বস্তু ছিল যে, মর্মান্তিক ক্ষতি। মহাকীর্তিটা তাই থেকেই যাবে বিষণ্নতার একটা ভাঙা টুকরোকে পাশে নিয়ে। যার নাম রোবাক।
সাহস। একনিষ্ঠ সত্যানুসন্ধান। গভীর ক্রিকেটীয় মনন।
সমারসেট ক্যাপ্টেন থাকার সময় যিনি ভিভ-বোথামের সম্মিলিত পাঙ্গা সহ্য করেছেন তাঁর ক্রিকেট লেখনী যে প্রবল খরস্রোতেও নির্ভীক থাকবে, খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এটা সত্যিই অনবদ্য যে কাউন্টি ক্রিকেটে ১৮ হাজার রান, মৌসুমে ১২ বারের মধ্যে ৯ বার হাজার রান পূর্ণ করার অভিজ্ঞতা এবং ক্রিকেট সার্কিটে অবাধ ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও লেখায় কখনো তাঁর অবৈধ ছায়াপাত ঘটাননি। তিন মহাদেশ মিলিয়ে এত অগণিত পাঠকসংখ্যা কার্ডাসেরও ছিল না, যাঁরা প্রতি মুহূর্তে টিভি এবং নেট ঘেঁটে ঠিক কী ঘটেছিল জেনে নেওয়ার আর প্রত্যক্ষ দেখার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রাক্তন ক্রিকেটাররা যদি হেলমেট-পূর্ব এবং উত্তর দুই ভাগে ক্রিকেট রেকর্ডকে বিভক্ত করার কথা বলেন, তাহলে ক্রিকেট সাংবাদিকতাকেও দুই ভাগে ভাগ করা উচিত। লাইভ টিভি-পূর্বক এবং পর।
সেদিনই প্রাক্তন এক উইজডেন সম্পাদক বলছিলেন, এমট রবিনসনকে নিয়ে কার্ডাস মজার মজার কিছু ব্যক্তিগত কথা লিখেছিলেন। তা পড়ে রবিনসন সেই সম্পাদকের দাদাকে বলেন, 'লোকটাকে তো আমি চিনিই না। ও আমার সম্পর্কে এত কথা জানল কী করে?' কার্ডাসকে বলা হলো। উনি গম্ভীর হয়ে বললেন, 'অভিযোগ জানানোর কী আছে? চিনি বা না চিনি, আমি তো রবিনসন সম্পর্কে ভালো ভালো কথাই লিখেছি।'
আধুনিক ক্রিকেট দুনিয়া তাই কার্ডাসকে মহান ক্রিকেট-নাট্যকার বলে বিদ্রূপ করে। মহান ক্রিকেট লেখক বলে না। তাঁর আমলের সর্বোচ্চ বিতর্ক বডিলাইনের সম্পর্কে একটা লেখাতেও না রয়েছে কার্ডাসের সরব প্রতিবাদ, না সর্বোচ্চ প্রশংসা। বাকি লেখাতেও অতিরঞ্জন। ঘটনার চেয়ে নাটক এবং সাহিত্যের প্রতি অনর্গল ঝুঁকে থাকা।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের স্নাতক রোবাক লিখেছেন তুলনামূলকভাবে অনেক কঠিন সময়ে। যখন বিশ্বে খবরের দরজা খুলে গিয়েছে। অথচ মৃত্যুর পরেও দেখছি রোবাকের শ্রেষ্ঠত্বকে আক্রমণ করার কোনো ছিদ্র খোলা নেই। টেকনিক্যাল বুনন। স্টিভ ওয়াহর মতো মানুষ অকাতরে বলেছেন, ক্যাপ্টেন থাকার সময় তিনি মুগ্ধচিত্তে রোবাক পড়তেন দিনের খেলার খুঁটিনাটি দিকগুলো সম্পর্কে আরো অবহিত হওয়ার জন্য। শরীরী ভাষাগুলো আরো ভালো বোঝার জন্য। একই মত পোষণ করেন শেন ওয়ার্ন, যিনি বাকি ৯৯৯টা ব্যাপারে স্টিভের চেয়ে অন্য মেরুতে। ক্রিকেটারকে পরামর্শ। অপ্রিয় সত্য সটান বলা। কবিত্বের ছোঁয়ায় ৩০ বছরেরও বেশি ক্যাপটিভ অডিয়েন্স রক্ষা করে যাওয়া। ক্রিকেট সাংবাদিকতার শচীন তিনিই। এত নিশ্চিত যে, তর্কযোগ্য শব্দটা যোগ করার প্রয়োজনও দেখছি না। চ্যানেল নাইনের দেশের যুগন্ধর অধিনায়ক যদি বলেন, অমুকের লেখাটা পড়তাম দিনের খেলাটা আরো ভালো করে বোঝার জন্য, তার চেয়ে বড় প্রশংসা আর কী হতে পারে?
কেপটাউনের সাদার্ন সান হোটেলে ছিলেন শুনে অবাক লাগছে। অথচ ভারতে ইচ্ছাকৃত সস্তার হোটেলে উঠতেন। রোবাকের যুক্তি ছিল, পাঁচ তারার বিলাসে তাঁর ভারতের আত্মা-উদ্ঘাটন বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। প্রায়-ভাঙা একটা কম্পিউটার ছিল রোবাকের। মেলবোর্ন প্রেস বঙ্ েএকবার এই সাংবাদিকের হাতে লেগে পড়ে যাওয়ায় ওটা পুরো ভেঙে যায়। রোবাক এমন ভেঙে পড়েন যে সহকর্মীরা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছিল, ভালোই তো হলো, নতুনটার আগমন অবশ্যম্ভাবী হলো। রোবাক ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, 'অতীত ঐতিহ্য ঝেড়ে ফেলতে চাই না।' পরের দিন ওটাকেই মেরামতটেরামত করে ফিরিয়ে এনেছিলেন প্রেস বঙ্।ে আজ মনে হচ্ছে শচীনের ব্যাটের মতো ওটারও জায়গা হওয়া উচিত কোনো অভিজাত ক্রিকেট জাদুঘরে। টোয়েন্টি টোয়েন্টি কভার করতেন না রোবাক। দুই দেশের মধ্যে ওয়ানডে সিরিজ কখনো নয়। একমাত্র বিশ্বকাপ। আর গুরুত্বপূর্ণ সব টেস্ট। মাঠের বাইরে কি ঘটছে কখনো কর্ণপাত করেননি। ড্রেসিংরুমের ব্যাপারস্যাপারে আগ্রহ ছিল না। বলতেন, 'আমার কাছে ক্রিকেট সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দিনের পরবর্তী ৯০ ওভার পর্যন্ত। ওইটুকুই আমার সীমানা। ওটা দিয়ে যদি শচীন টেন্ডুলকারের জিনিয়াস ব্যাখ্যা করা যায়, বাকিদেরও যাবে!'
শততম সেঞ্চুরি হলে অনেক উপঢৌকন বাড়তি পাবেন শচীন। কিন্তু কোথাও মনে হচ্ছে সেগুলো সবই টাকার মূল্যে কিনতে পাওয়া যায়। টাকা কিনতে পারবে না এমন একটা উপহার কিন্তু তিনি হারালেন।
কীর্তি-পরবর্তী রোবাকের একটা লেখা! যা ক্রিকেট-বিশ্বে এত বেশি পাঠকের গোগ্রাসে গেলার বস্তু ছিল যে, মর্মান্তিক ক্ষতি। মহাকীর্তিটা তাই থেকেই যাবে বিষণ্নতার একটা ভাঙা টুকরোকে পাশে নিয়ে। যার নাম রোবাক।
No comments