হুবহু-রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কের টানাপড়েনের ফলে সার্ক এগোতে পারেনি

রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি মালদ্বীপের আদ্দু দ্বীপে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (সার্ক)-এর ১৭তম শীর্ষ সম্মেলন প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন আমাদের সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (সার্ক) এই আঞ্চলিক সংস্থাটির প্রাপ্তি, সফলতা বা অসফলতা সম্পর্কে আপনার মতামত কী? ১৭তম সম্মেলন সফল হবে বলে কি আপনি মনে করেন?


প্রতিষ্ঠার ২৫ বছর পেরিয়ে ২৬-এ পড়েছে সার্ক। এখানে সার্কের ফলাফলকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এর একটি হলো বৈঠক, অন্যটি বৈঠকের ফলাফল। প্রতিটি শীর্ষ বৈঠককে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে নেওয়া হয়, গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে কিছু এজেন্ডা থাকে, আলোচনা হয়, কয়েকটি চুক্তি সই হয়। তবে গত ২৫ বছরের শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংস্থাটি। সার্ক এ অঞ্চলের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তাই সার্কের কাছে এ অঞ্চলের মানুষের যে প্রত্যাশা, তা আজও প্রায় অপূর্ণই থেকে গেছে। তবে একটি প্রশ্ন হলো_যদি সার্ক না থাকত তাহলে কী হতো? সার্ক এ অঞ্চলের জন্য খুবই প্রয়োজন। সার্ক সফল করতে হলে মূল কাজ করতে হবে রাষ্ট্রগুলোকে। জনগণের অংশগ্রহণ আরো বাড়াতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বেড়াজালে আটকা পড়ে এবং রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্কের টানাপড়েনের ফলে সার্ক এগোতে পারেনি। শীর্ষ সম্মেলন প্রতিবছর হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। সার্কের চালিকাশক্তি হলো এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার আন্তরিকতা। অন্যান্য আঞ্চলিক সংস্থা যেভাবে এগিয়ে গেছে, সার্ক সেভাবে এগোতে পারেনি। এর কারণ, সার্কের ভেতর ও বাইরে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর যে ধরনের ভূমিকা পালন করার কথা, তা তারা করেনি। সদস্য দেশগুলোর নিজেদের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক সার্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বাস দিয়েছেন তিস্তা চুক্তি দ্রুত সই করতে ভারত চেষ্টা চালাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী ভাবছেন?
আমার মনে হয় বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে সঠিকভাবে উপস্থাপন হয়নি। এটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বৈঠকে আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায়, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আরো বিলম্বিত হবে। কারণ মনমোহন সিং বলেছেন, তিস্তা চুক্তি করার জন্য ভারত সরকার ঐকমত্যের চেষ্টা চালাচ্ছে। এই ঐকমত্য করতে গিয়ে চুক্তিটি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তবে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অল্প সময়ে দুইবার বৈঠক হওয়া একটি ইতিবাচক বিষয়। এ বৈঠক দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করবে। আস্থা সৃষ্টি হবে। তবে তিস্তা চুক্তি করতে দেরি হবে। কারণ মনমোহনের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি দেশের ভেতরে ঐকমত্য সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। এর মানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। আরো অনেক নেতাকে এ বিষয়ে বোঝাতে হবে।

সম্প্রতি বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, চীনকে তিনি সার্কের সদস্য হিসেবে দেখতে চান। এটি কি আসলে সম্ভব?
খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তাঁর এ মন্তব্য অপরিপক্বতার শামিল। চীনকে সার্কের সদস্য করার জন্য সার্ক মোটেই প্রস্তুত নয়। সার্ক এখনো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়নি। এ মুহূর্তে চীনকে সদস্য করা হলে সার্ক আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চীনকে সদস্য করার জন্য ভারতের কোনো সমর্থন থাকবে না। তবে চীনকে অন্য কোনো ফর্মে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বাংলাদেশ ও ভারতও আসিয়ান দেশের সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে, কিন্তু পারেনি। তারা ডায়ালগ পার্টনার। চীনকেও সার্কের ডায়ালগ পার্টনার করা যায়।

সার্ক অঞ্চলের আন্তআঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ। এত দিনেও এই বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়নি কেন?
আসলে কাগজে-কলমে আন্তআঞ্চলিক বাণিজ্যের পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ দেখানো হলেও এর পরিমাণ আরো কম। এ জন্য সার্ক নয়, এর দেশগুলো দায়ী। যে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পারস্পরিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করা সম্ভব সেসব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। নেগেটিভ লিস্ট উন্মুক্ত করে বাণিজ্য হচ্ছে না বলে এর পরিমাণ কম। প্রতিটি সামিটে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; কিন্তু বাস্তবায়নের সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রাধান্য পায়। বর্তমানে ইউরো জোন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে অর্থনৈতিক সংকট তথা বিশ্বমন্দার কারণে আঞ্চলিক সহযোগিতা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। ভারতে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে, সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর একটি প্রভাব পড়ে থাকে। সার্ক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। অনেক দেশই এখন সার্কে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা পেতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। সার্ক আঞ্চলিক সংস্থা হলেও বাইরের শক্তিও এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য এ সংস্থাকে এগিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই।

সার্ক বাস্তবায়নের প্রধান বাধাগুলো কী বলে আপনি মনে করেন?
অনেকের মতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক সার্কের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। ইদানীং এ দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন লক্ষ করা যাচ্ছে। পাকিস্তান সম্প্রতি ভারতকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের (এমএফএন) মর্যাদা দিয়েছে। গত দুই-আড়াই বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেও সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এসব বিষয় আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে। সার্ককে অর্থবহ করতে আরো কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। শুধু শীর্ষ সম্মেলন করলেই হবে না, বৈঠকে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যে কমিটিগুলো রয়েছে সেগুলোকে কার্যকর করতে হবে। প্রয়োজনে সার্ক সনদে সংশোধনী আনতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ঐকমত্যের বাধ্যবাধকতা সার্কের একটি কাঠামোগত দুর্বলতা। সার্কে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ না থাকলেও শীর্ষ সম্মেলনের সময় সাইডলাইনে অনানুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের আলোচনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এটা এ অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে এক ধরনের পরিহাসের শামিল। আমি মনে করি, পরীক্ষামূলকভাবে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ দেওয়া উচিত।
সাক্ষাৎকার গ্রহণে : সফেদ সিরাজ

No comments

Powered by Blogger.