কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা দরকার by আসিফ নজরুল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক,সংসদীয় কমিটির ক্ষমতা নির্ধারণের জন্য সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা বলা থাকলেও ৪০ বছরেও আইনটি হয়নি। মন্ত্রী-আমলাদের অনিচ্ছার কারণেই এটি হয়নি। সংসদীয় কমিটির সম্প্রতি নেওয়া এ-সংক্রান্ত উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। এ কারণে বাংলাদেশের সংসদে কমিটির কোনো ক্ষমতা নেই। অন্যদিকে বিরোধী দলের হেরে যাওয়া প্রার্থীরা দলীয় প্রধানকে সংসদে না যাওয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করেন। এটিই সংসদ বর্জনের অন্যতম কারণ।
আর এই সংসদ বর্জনের কারণে সংসদ তো অকার্য হয়ই, সংসদীয় কমিটিগুলোও অকার্যকর হয়ে পড়ে। সংসদ ও সংসদের বাইরে সরকারের জবাবদিহিতা কমে যায়। সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেটাও প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষতা হারিয়েছিল। এ কমিটিতে সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে একজন মন্ত্রীর স্বামীকে মতামত দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে। ফলে এই কমিটি স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের প্রমাণ দিয়েছে। সেই সঙ্গে সংসদীয় কমিটির ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে গোপনীয়তা ও তাড়াহুড়ার কিছু ছিল না। এর পরও কমিটি যেভাবে তাড়াহুড়া করছে, তাতে জনগণ শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। এখন প্রমাণিত হয়েছে সেই শঙ্কা অমূলক ছিল না। কমিটির চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান বিভিন্ন সময় নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করছেন। পুরো বিষয়টি নিয়ে তাঁরা লুকোচুরি খেলছেন। আমার মনে হয় সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত আসার কারণে সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি এমনটি করেছে। এর ফল হিসেবে আমরা দেখি, সংশোধিত সংবিধান সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে পারিনি। বর্তমান সংসদীয় কমিটি বিচার বিভাগের ওপর তাদের ক্ষমতা ফিরে পেতে চায়, যা বাহাত্তরের সংবিধানে উল্লেখ ছিল। কিন্তু সরকার সংসদীয় কমিটির এ দাবিও প্রত্যাখ্যান করেছে। সংবিধান সংশোধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য যে সংসদীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তা প্রকৃত অর্থে কতটুকু নিরপেক্ষ ছিল তা এখন দিবালোকের মতো সত্য। সংসদীয় কমিটি কার্যকর না হলে সংসদ কার্যকর বলা যাবে না। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই, যখন সংসদের সব দিক সঠিকভাবে কাজ করে। সংসদীয় কমিটিগুলো গঠিত হয়েছে সত্য। তারা বৈঠকও করছে। এভাবে বিধি রক্ষার জন্য নিয়মিত বৈঠক আর সুপারিশ করে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দেওয়া বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। কমিটির এখতিয়ার বাড়ানোর চেয়েও বেশি দরকার মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে কাজ করা। তারপর প্রয়োজনে কার্যপ্রণালি বিধি সংশোধন করা দরকার। নবম সংসদে নারী সংসদ সদসদের সংখ্যা ৪৩ জন। কিন্তু সংসদীয় কমিটিগুলোর মাত্র একজন নারী সভাপতি। সভাপতি হিসেবে নারীদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা দরকার। আমরা আশা করব, বর্তমান সরকারের মেয়াদেই সংসদীয় কমিটিগুলো পুনর্গঠন করে নারীদের সভাপতি হিসেবে বেশি করে নির্বাচিত করা হবে। কারণ এ দেশে যোগ্য নারীর অভাব নেই। আর যেসব সংসদ সদস্য কার্যপ্রণালি বিধি ভঙ্গ করে কমিটিতে আছেন তাঁদের সরিয়ে দিয়ে কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা দরকার। এর ফলে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্য হওয়ায় নিজ ব্যবসায়িক কাজে কমিটিকে ব্যবহার করা হবে_আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। তাই তাঁদের সরিয়ে দিলে সংসদীয় কমিটিগুলো নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না। কারণ সংসদীয় কমিটির অবৈধ সদস্যদের কর্মকাণ্ডও অবৈধ হবে। এতে কারো কোনো দ্বিমত নেই। এ ছাড়া সংসদীয় কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য আমলাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো আমাদের এ দেশের সংসদীয় কমিটিগুলো আরো ক্ষমতার অধিকারী হবে।
No comments