চার বছরেও শুকায়নি সিডরের ক্ষত-আজ ভয়াল ১৫ নভেম্বর by আলতাব হোসেন ও পুলক চ্যাটার্জি

চার বছরেও কান্না থামেনি প্রলয়ঙ্করী সিডর তাণ্ডবে বিধ্বস্ত উপকূলবাসীর। আজ সেই ভয়াল ১৫ নভেম্বর। ২০০৭ সালের এ দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। স্মরণকালের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়গুলোর অন্যতম সিডরের তাণ্ডবে লাখ লাখ ঘরবাড়ি ধংসস্তূপে পরিণত হয়। প্রাণহানি ঘটে তিন হাজার ৩৪৭ জনের। সর্বাধিক এক হাজার ৩৪৫ জনের প্রাণহানি ঘটে বরগুনা জেলায়।


উপকূলজুড়ে এখনও শুকায়নি সিডরের ক্ষত।সিডরের চার বছর পরও দক্ষিণাঞ্চলের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ পুরোপুরি সংস্কার হয়নি। সাইক্লোন শেল্টারের সংখ্যাও অপ্রতুল। ফলে এখনও ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করছে বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর উপকূলের অর্ধকোটি মানুষ। এখনও সাগর বা পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বরে জোয়ার এলে প্লাবিত হয় উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। গত পূর্ণিমার জোয়ারে ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে নিমজ্জিত হয়েছে পাথরঘাটা পৌর এলাকার দুই নম্বর ওয়ার্ডের শতাধিক বাড়িঘর। ফলে আবারও বিপর্যয়ের আশঙ্কায়
আতঙ্কিত দিন যাপন
করছে উপকূলের মানুষ। সিডরদুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের দাবি_ দ্রুত বাঁধ মেরামত করা হোক। না হয় নতুন করে তারা আবার নিঃস্ব হতে পারেন।
সিডরে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলোর বেশির ভাগ এখনও আগের মতোই আছে। বিকল্প বাঁধগুলো দিয়ে জোয়ারের পানিতে এখনও তলিয়ে যায় ফসলের জমি ও জনবসতি। মিঠাপানির সব উৎসও পুনঃস্থাপন হয়নি। সিডরকবলিত শরনখোলা, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, বরগুনা, তালতলী, কলাপাড়া, গলাচিপা, চরখালীসহ অন্যান্য এলাকায় এখনও বহু মানুষ ঘর পায়নি। তারা এখনও বেড়িবাঁধের ওপর বাস করছে। জেলেদের অবস্থা আরও করুণ। তারা যে জাল ও ট্রলার সাহায্য হিসেবে পেয়েছিল তার বেশির ভাগই ব্যবহার করতে না পেরে বিক্রি করে দিয়েছে। সুপেয় পানিরও রয়েছে তীব্র সংকট।
বাঁধ সংস্কারে বিলম্বের কারণ সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণ জোনের প্রধান প্রকৌশলী মাহতাবউদ্দিন সমকালকে বলেছেন, সিডরের পরপরই পাউবোর রাজস্ব খাতের টাকা দিয়ে জরুরিভিত্তিতে কিছু বাঁধ মেরামত করা হয়েছে। বাঁধ সংস্কার কাজ এখনও চলছে। তিনি জানান, ইমার্জেন্সি সাইক্লোন রিকভারি অ্যান্ড রোস্টারেজ প্রজেক্টের (ইসিআরআরপি) আওতায় বিশ্বব্যাংক বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুরের বাঁধ সংস্কারের জন্য ২৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের তহবিল পরিবেশ ছাড়পত্র, ছিন্নমূলের তালিকা, জমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর পাওয়া যায়। ফলে তহবিল পেতে প্রায় ২-৩ বছর পার হয়ে গেছে। পাউবোর বরগুনার নির্বাহী প্রকৌশলী জহিরউদ্দিন আহম্মেদ সমকালকে জানান, ১৯টি প্যাকেজে বিভক্ত করে বরগুনাসহ উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। তিনি জানান, চলতি শুকনো মৌসুমে শুরু হওয়া এ বাঁধ সংস্কার কাজ শেষ হতে আগামী শুকনো মৌসুম পর্যন্ত সময় লাগবে। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ এখনও পুরোপুরি সংস্কার না হওয়ায় উপকূলের বাসিন্দারা এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, সুপার সাইক্লোন সিডরে দক্ষিণের ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত হয়। যার মধ্যে একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে ৩৯১ কিলোমিটার বাঁধ। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সূত্র জানায়, সিডরের পর ওই বাঁধ মেরামতের জন্য পাউবো ৭২২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার চাহিদাপত্র পাঠালেও ১০ ভাগের একভাগও বরাদ্দ আসেনি। ফলে উপকূলের জনজীবনে ফিরে আসছে না নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর মুহূর্তের ধ্বংসলীলায় বিধ্বস্ত হয় ৬ লাখ মানুষের বসতবাড়ি। স্বজনহারা মানুষের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। মৃত, আহত আর ক্ষুধার মতো ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি ঘূর্ণি হাওয়া আর জলোচ্ছ্বাসের ছোবলে বিধ্বস্ত হয় সড়ক, নৌ, বিদ্যুৎ এবং টেলিযোগাযোগসহ সার্বিক অবকাঠামো। ফসলের ক্ষেত, বাড়ির উঠান, ঘরের চালা আর পথে-প্রান্তরে পড়ে থাকে মানুষের লাশ। চার বছরেও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন সম্ভব হয়নি। বহু এলাকায় নির্মিত হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ ও ক্লোজার। অনেক গ্রামে চলছে খাবার পানির তীব্র সংকট। ঘরবাড়ি হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে লাখখানেক মানুষ। এর মধ্যেই চলছে উপকূলবাসীর বাঁচার লড়াই।
দীর্ঘ সময়েও তেমন একটা বদলায়নি সিডর এলাকার পরিস্থিতি। এখনও মানুষকে চলতে হয় ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে। ফসলের জমি প্লাবিত করে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে ঢোকা সাগরের নোনা পানি। মেরামত না হওয়ায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে পটুয়াখালী এবং বরগুনার ২৮টি গ্রামে। প্রকৃতির নিদারুণ রোষে কৃষক থেকে জেলেতে পরিণত হয়েছে বহু মানুষ। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ৬ লাখ বাড়িঘরের অধিকাংশ এখনও রয়েছে আগের অবস্থায়। দুর্গত মানুষের জন্য কিছু বাড়িঘরের বরাদ্দ হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল।
সাগর ও নদীবেষ্টিত উপকূলীয় জেলা বরগুনায় এখনও জোয়ারের পানি সামান্য বেড়ে গেলেই নিম্নাঞ্চলসহ বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসকারীদের বাড়িঘর, ফসলি জমি তলিয়ে যায়। আশ্রয় নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নেই। মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বরগুনার উপকূলীয় এলাকার মানুষ বসবাস করছে। বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, সিডর ও আইলায় বরগুনার ৪৮৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। তখন সরকারের কাছ থেকে ৯ কোটি টাকা দিয়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। এছাড়া ১ হাজার ৪৪৮ টন গমের মাধ্যমে ১০ দশমিক ৬৫৮ কিলোমিটার বাঁধ (অস্থায়ী প্রতিরক্ষা) মেরামত করা হয়েছে। পুরনো আদলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হলে দেড়শ' কোটি টাকা দরকার।
এদিকে বরগুনা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপপরিচালক হাফিজ আহম্মেদ জানান, বরগুনায় ১৯৩টি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। যেখানে সর্বোচ্চ ২ লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারে। জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে বরগুনার বাকি ১০ লক্ষাধিক মানুষের আশ্রয় নেওয়ার কোনো স্থাপনা নেই। তার মতে বরগুনায় আরও ৪শ' সাইক্লোন শেল্টার দরকার।
সিডর ও আইলায় পটুয়াখালী জেলার ক্ষতিগ্রস্ত ২৮৫ কিলোমিটার বাঁধ আজও সম্পন্ন হয়নি। পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, জেলার ১২টি পোল্ডারের অধীনে মির্জাগঞ্জ, গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলায় ৬০ কিলোমিটার বাঁধ এখনও অরক্ষিত।
২০০৭ সালের পিরোজপুরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সুপার সাইক্লোন সিডরে জেলার ২২০ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ এবং আংশিক বিধ্বস্ত হয়। গত ৪ বছরে এসব ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের মধ্যে মঠবাড়িয়া, ভাণ্ডারিয়া ও জিয়ানগর উপজেলার ১৭৭ কিলোমিটার বাঁধ বিভিন্ন সময়ে সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হলেও তার বেশিরভাগ আবার নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এসব এলাকার লোকজন চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জমি ও পানির লবণাক্ততা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সঙ্গে অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, অতিরিক্ত জোয়ারের পানিতে জমি প্লাবিত হওয়ায় সিডর ও আইলাবিধস্ত এলাকার লক্ষাধিক একর আবাদি জমিতে আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট জেলার সমুদ্র-উপকূলবর্তী এলাকার জমি ও পানিতে অধিক লবণাক্ততায় এ জমি অনাবাদি থাকছে।
সিডরবিধ্বস্ত এলাকার প্রায় এক হাজার মানুষ এখনও নিখোঁজ। ২৪০ কিলোমিটার বেগের তীব্র ঝড়ের সঙ্গে স্থানভেদে ২০-৩০ ফুট উঁচু সেই জলোচ্ছ্বাসে সরকারিভাবে মোট ১৫ লাখ ৭২ হাজার ৪৯৫টি পরিবারের ৬৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫৬ জনকে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চার লাখ ৬১ হাজার ৩৯৯ একর জমির ফসল সম্পূর্ণ এবং ১২ লাখ ২৫ হাজার ৩০৪ একর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিধ্বস্ত হয় আড়াই হাজার কিলোমিটার বাঁধ।
আইলা তা বের পর নানাভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও রাষ্ট্র। ওইসব প্রতিশ্রুতির সিকিভাগও পায়নি বাংলাদেশ সরকার। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৬শ' ঘরবাড়ি আর দুটি মডেল গ্রাম তৈরি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল ভারত। এখনও তা ঘোষণাতেই রয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় অর্থের এক-দশমাংশও বরাদ্দ পায়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড। বিধ্বস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া অর্থ-সহায়তার পরিমাণও খুবই নগণ্য। খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দাতারা পুনর্বাসনে প্রতিশ্রুতি দিয়েও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.