একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-সিয়েরা লিওনে সরকারি ভাষা বাংলা by মুহাম্মদ লুৎফুল হক

২০০২ সালে আমাদের ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়, ঠিক ওই বছরই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে তাদের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়। সিয়েরা লিওন পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ। আয়তন ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ।


সিয়েরা লিওনে বাস করে ১৬টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, যাদের সবার নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি আছে। সাধারণভাবে অধিকাংশ মানুষ নিজেদের মধ্যে ইংরেজির সঙ্গে স্থানীয় ভাষাগুলোর সম্মিলনে সৃষ্ট ক্রিও নামের একটি সংকর ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে। সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি।
১৯৬১ সালে সিয়েরা লিওন স্বাধীনতা পায়। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর দুর্নীতি, অপশাসন, অযোগ্যতার কারণে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো সিয়েরা লিওনের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হলে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশ সিয়েরা লিওনে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে যোগ দেয়। বাংলাদেশ থেকে ৭৭৫ জন সেনার প্রথম দলটি সিয়েরা লিওনের দক্ষিণ অঞ্চলে লুঙ্গি নামক স্থানে দায়িত্ব নেয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে আরও সেনা সিয়েরা লিওন যান এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। একপর্যায়ে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার ৩০০ জন সেনা একত্রে সিয়েরা লিওনে কর্মরত ছিলেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ দল ২০০৫ সালে ফিরে আসে। সর্বমোট প্রায় ১২ হাজার সেনা সিয়েরা লিওনে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ সেনাদল তাদের নিয়মিত সামরিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরিয়ে আনার জন্য বিবদমান বিভিন্ন জাতির মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সাধারণ সেনারা ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করতে থাকেন। বাংলা ভাষা স্থানীয় লোকজনের অপরিচিত হওয়ায় বাঙালি সেনারা তাদের ধৈর্যের সঙ্গে তা শেখাতে শুরু করেন। সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করে খুব আগ্রহের সঙ্গে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকে। লক্ষ করা যায়, ২০০২ সালের মধ্যে যেখানেই বাংলাদেশি সেনাদল আছে, সেখানেই স্থানীয়রা বিশেষত তরুণ-তরুণীরা বাংলায় কথা বলতে পারছে। বিভিন্ন সভায় স্থানীয়রা বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয়দের বাঙালি নাচ ও গান পরিবেশন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ সেনাদলের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষা জনপ্রিয়তা পায়। স্থানীয়রা কাজ চালানোর মতো বাংলা ভাষা শিখে নেওয়ার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশ পুনর্গঠনে বাংলাদেশ সেনাদল অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে যায়।
সিয়েরা লিওনে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ৩১টি দেশের সেনাদল কর্মরত ছিল। প্রায় প্রতিটি দেশের সেনাদল যুদ্ধরত বিভিন্ন বিদ্রোহী দলের আক্রমণের মুখোমুখি হলেও বাংলাদেশ সেনাদল এ বিষয়ে ছিল ব্যতিক্রম; কারণ, বাংলাদেশি সেনাদল তাদের দায়িত্বের প্রতি সব সময় নিষ্ঠাবান ছিল, উপরন্তু সাধারণ মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করত। ফলে বাঙালি সেনাদের বাংলা ভাষাকে স্থানীয়দের মধ্যে প্রচারের উদ্যোগটি সহজেই সফলতা পায়।
শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং দেশ গঠনে বাঙালি সেনাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালের ১২ ডিসেম্বর সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বা বাংলা ভাষাকে সিয়েরা লিওনের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি রাজ্য ব্যতীত আর কোথাও বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে এই প্রথম স্বীকৃতি পায়। প্রেসিডেন্ট কাব্বা বাংলাদেশ সেনাদলের নির্মিত ৫৪ কিলোমিটার সড়ক উদ্বোধনকালে এই ঘোষণা দেন। বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ওলুয়েমি আদেনজি, জাতিসংঘ বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল ড্যানিয়েল ইসমায়েল ওপান্ডেসহ আরও অনেকে। বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট কাব্বা ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর তিন দিনের জন্য বাংলাদেশ সফরে আসেন।
সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা ঘোষণা দেওয়ায় বাংলা ভাষা একটি ভিন্ন মাত্রা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, যদিও তা কাজে লাগানো হয়নি। সিয়েরা লিওন এগিয়ে এলেও আমাদের তরফ থেকে বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসারে সিয়েরা লিওনের সঙ্গে যে পরিমাণ সাংস্কৃতিক বিনিময় হওয়া প্রয়োজন ছিল তা হয়নি, তবে সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.