শিবের গীত-তরুণ নেতৃত্ব ও মুক্তিযুদ্ধ by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
তরুণ নেতৃত্বের কাছে ভবিষ্যতে ক্ষমতা যাচ্ছে, বুড়োদের দিন শেষ হচ্ছে, এ রকম একটি ঘোষণা শুনে আমাদের মতো ষাটোত্তীর্ণরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেও তরুণ দল দারুণ আনন্দিত। তারা এতটাই উৎফুল্ল যে আমার কাছে এ রকমও বলেছে, ‘স্যার, সারা বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলিকণা তরুণ নেতৃত্বের জন্য হাহাকার করছে।
আপনি দেখবেন, শিগগিরই তরুণ নেতৃত্ব আমাদের মাঝে ফিরে এসে দেশের হাল ধরবে।’ তবে তরুণ নেতৃত্ব বলতে ঠিক কোন বয়সের নেতৃত্বকে বোঝানো হয়েছে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা সংশয় রয়ে গেছে। তরুণ কি তিনি, যিনি মুক্তিযুদ্ধের আগে জন্মেছেন; নাকি তিনি, যার জন্ম মুক্তিযুদ্ধের পরে? আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তরুণ দলটি অবশ্য মুক্তিযুদ্ধকে আগাগোড়া ‘গন্ডগোলের বছর’ই বলল। আমার তাতে আপত্তি থাকার কথা, কিন্তু আমাকে মানতে হলো, আগামী দুই-আড়াই বছরের মধ্যে যদি তরুণ নেতৃত্ব ক্ষমতায় যায়, তাহলে সরকারিভাবেই হয়তো মুক্তিযুদ্ধকে ‘গন্ডগোল’ এবং একাত্তরকে ‘গন্ডগোলের বছর’ হিসেবে গণ্য করা হবে। তখন আমি-আপনি আপত্তি করলে তাতে কার কী যাবে-আসবে? ফলে আমি তরুণ-এর সংজ্ঞাগত সমস্যাটি সমাধানের দিকেই বরং মনোযোগী হলাম। আমি ব্যক্তিগত একটি উদাহরণ দিয়ে জানালাম, একবার এক আলোচনা অনুষ্ঠানে আমি এবং মাহমুদুর রহমান মান্না উপস্থিত ছিলাম। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক আমাকে পরিচিত করালেন, ‘প্রবীণ অধ্যাপক’ হিসেবে এবং মান্নাকে অভিহিত করলেন ‘তরুণ রাজনীতিবিদ’ হিসেবে। অথচ মান্না ও আমি সমবয়সী! ‘রাজনীতিতে ষাট বছরের হিসাবটাও তারুণ্যের মধ্যে পড়ে’, আমি তাদের বললাম। তাতে তরুণ দলটি জোরে একটা হাততালি দিল। কিন্তু উল্লাস করতে গিয়ে হঠাৎ তাদের গলার জোরটা একটু কমে গেল। কারণ জিজ্ঞেস করতে তারা জানাল, জনসভায় বলা হয়েছে, তরুণ ও ‘শিক্ষিত’ নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হবে। ‘তরুণ’-এর বর্ণনা নিয়ে তাদের খটকাটা মিটলেও ‘শিক্ষিত’ বিষয়টি তারা কীভাবে মোকাবিলা করে? ‘শিক্ষিত বলতে কি স্যার এমএ, পিএইচডি বোঝানো হয়েছে, নাকি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার?’ তরুণ দলটি জানতে চাইল। ওর উত্তরে আমি বললাম, ‘এখানেও সমস্যা নেই।’ বহুপরিচিত একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আমি বললাম, যে গাড়িচালক গরু-ছাগলের পার্থক্য বোঝেন, তাঁকে যদি শিক্ষিত বলা যায়, তাহলে ওই তরুণ নেতৃত্বের শিক্ষা নিয়ে তাদের চিন্তাটা নেহাত অমূলক। একটা দেশ চালানো একটা গাড়ি চালানো থেকে কঠিন কিছু নয়, আমি তাদের বললাম, শুধু গরু-ছাগলের সঙ্গে আরও কিছু প্রাণীকে চিনতে পারলেই এখানে চলবে, যেমন সাপ ও শিয়াল, যাদের বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন হতে পারে। একই সঙ্গে দেশে বিনিয়োগের জন্য কোনটা টাকা এবং বিদেশে বিনিয়োগের জন্য কোনটা ডলার, এই পার্থক্যটা করে যেতে পারলেও শিক্ষার মানদণ্ডে তরুণ নেতৃত্ব ভালো পাস দিতে পারবে। আমার ব্যাখ্যা তরুণ দলের মনঃপূত হলো। একজন একটুখানি যোগ করে বলল, ‘স্যার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত স্যাররা তরুণ নেতৃত্বের সামনে দাঁড়ালে, তাঁদের সারা অবয়বে একটা গদগদ ভাব জেগে ওঠে, তাহলে কি প্রমাণিত হয় না, তরুণ নেতৃত্ব অনেক বেশি শিক্ষিত? স্যাররা যখন তরুণ নেতৃত্বকে এতটা ভক্তি করেন, সে নিশ্চয় সেই নেতৃত্বের শিক্ষার জন্য, ক্ষমতার জন্য নয়। ক্ষমতার জন্য তো তোয়াজ করবে পাড়ার ক্যাডাররা; কী বলেন, স্যার?’
তরুণ দলের যুক্তিটা অকাট্য মনে হলো। আমার মনে পড়ল, তরুণ নেতৃত্ব একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণে এলে এর তিন উচ্চ কর্মকর্তা সেই নেতৃত্বকে বরণ করার জন্য পড়ি তো মরি ছুটে গিয়েছিলেন। তাতে আমার মনে হয়েছিল, রোপণ করা ওই গাছটির নাম দেওয়া হোক ‘শিক্ষাবৃক্ষ’, যা শিগগিরই প্রকাণ্ড এক মহীরুহ হয়ে সকল আলোর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে ছায়া দিয়ে যাবে।
শিক্ষার বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার পর উজ্জীবিত তরুণ দলটি বলল, এবার গন্ডগোলের বছরের হিসাব ঠিক করতে হবে। তরুণ দলকে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের বন্দী করা হয়েছে, তারা মোটেও কোনো অপরাধ করেনি। তারাও সেটা বিশ্বাস করে। আমি একটু অবাক হয়ে তাকাতে তরুণ দলটি বলল, ‘গন্ডগোলের বছরে একটি দেশদ্রোহী দল তার দোসর ও কলাবরেটরদের সঙ্গে মিলে পাক-পবিত্র ওয়াতান ভেঙে ও আমাদের পাক-পবিত্রদের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল, সে জন্য তাঁরাই তো অপরাধী। সেই অপরাধের জন্য প্রথমে তাঁদের বিচার করতে হবে। আমাদের বন্দী প্রবীণ নেতৃত্ব যা করেছেন, তা ওই ওয়াতানের জন্যই। এ জন্য কেন তাঁরা অপরাধী হবেন?’
তরুণ সমাজের যুক্তিটা বেশ, এ কথা স্বীকার করতেই হলো। কিন্তু সবখানে গন্ডগোলের বছর বললেও এক জায়গায় যে মুক্তিযুদ্ধ কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের জন্য তরুণ সমাজকে প্রস্তুত থাকতে হবে, তার একটা ব্যাখ্যা আমি তাদের কাছে চাইলাম। তারা চোখে-মুখে প্রত্যয় নিয়ে বলল, ‘পাক-ওয়াতানের সঙ্গে আমাদের যে বিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছিল, তার বিপরীতে একটা নতুন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পুনর্বার সেই ওয়াতানের সঙ্গে যুক্ত হব। তাহলে একে মুক্তিযুদ্ধ না বলে কী বলব, স্যার, আপনিই বলুন?’
‘তা বটে’, আমি বললাম। তবে আমার উত্তর শোনার জন্য তরুণ দলটি বসে ছিল না। তারা সবাই ছুটছে সঙ্গে আনা গাড়িগুলোর দিকে। তাদের অনেক কাজ। পথে নামতে হবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তরুণ দলের যুক্তিটা অকাট্য মনে হলো। আমার মনে পড়ল, তরুণ নেতৃত্ব একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষরোপণে এলে এর তিন উচ্চ কর্মকর্তা সেই নেতৃত্বকে বরণ করার জন্য পড়ি তো মরি ছুটে গিয়েছিলেন। তাতে আমার মনে হয়েছিল, রোপণ করা ওই গাছটির নাম দেওয়া হোক ‘শিক্ষাবৃক্ষ’, যা শিগগিরই প্রকাণ্ড এক মহীরুহ হয়ে সকল আলোর বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে ছায়া দিয়ে যাবে।
শিক্ষার বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার পর উজ্জীবিত তরুণ দলটি বলল, এবার গন্ডগোলের বছরের হিসাব ঠিক করতে হবে। তরুণ দলকে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের বন্দী করা হয়েছে, তারা মোটেও কোনো অপরাধ করেনি। তারাও সেটা বিশ্বাস করে। আমি একটু অবাক হয়ে তাকাতে তরুণ দলটি বলল, ‘গন্ডগোলের বছরে একটি দেশদ্রোহী দল তার দোসর ও কলাবরেটরদের সঙ্গে মিলে পাক-পবিত্র ওয়াতান ভেঙে ও আমাদের পাক-পবিত্রদের মধ্যে যে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল, সে জন্য তাঁরাই তো অপরাধী। সেই অপরাধের জন্য প্রথমে তাঁদের বিচার করতে হবে। আমাদের বন্দী প্রবীণ নেতৃত্ব যা করেছেন, তা ওই ওয়াতানের জন্যই। এ জন্য কেন তাঁরা অপরাধী হবেন?’
তরুণ সমাজের যুক্তিটা বেশ, এ কথা স্বীকার করতেই হলো। কিন্তু সবখানে গন্ডগোলের বছর বললেও এক জায়গায় যে মুক্তিযুদ্ধ কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, আরেকটা মুক্তিযুদ্ধের জন্য তরুণ সমাজকে প্রস্তুত থাকতে হবে, তার একটা ব্যাখ্যা আমি তাদের কাছে চাইলাম। তারা চোখে-মুখে প্রত্যয় নিয়ে বলল, ‘পাক-ওয়াতানের সঙ্গে আমাদের যে বিচ্ছেদ ঘটানো হয়েছিল, তার বিপরীতে একটা নতুন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পুনর্বার সেই ওয়াতানের সঙ্গে যুক্ত হব। তাহলে একে মুক্তিযুদ্ধ না বলে কী বলব, স্যার, আপনিই বলুন?’
‘তা বটে’, আমি বললাম। তবে আমার উত্তর শোনার জন্য তরুণ দলটি বসে ছিল না। তারা সবাই ছুটছে সঙ্গে আনা গাড়িগুলোর দিকে। তাদের অনেক কাজ। পথে নামতে হবে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments