নৈতিকতা-আসুন, আমরা তাঁদের সম্মান দিই

এখানে লেখক হিসেবে যাঁদের নাম ছাপা হয়েছে, সেখানে যুক্ত হতে পারত মেহেরুন রুনি ও সাগর সরওয়ারের নাম। যুক্ত হয়নি, হবেও না আর কখনো। প্রিয় বন্ধু কিংবা সহকর্মীকে হারানো কতটা যন্ত্রণার, তা আমরা অনুভব করছি। আমাদের সহকর্মী মেহেরুন রুনি ও সাগর সরওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে।


এখনো তাঁদের হত্যাকারী বা হত্যাকারীদের খুঁজছে পুলিশ-গোয়েন্দারা। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা এর বিচার চাই।
এ ঘটনার পর পরই আমরা ভীষণ কষ্ট নিয়ে লক্ষ করছি, মেহেরুন রুনি ও সাগর সরওয়ার এবং তাঁদের একমাত্র সন্তান মেঘকে নিয়ে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক ও বিভিন্ন ব্লগে মুখরোচক গল্প ছাপা হচ্ছে। আমরা ক্ষুব্ধ। এটি আমাদের শোক-কষ্টকে কেবল উসকে দিচ্ছে না, সে সঙ্গে আমাদের পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা এর প্রতিবাদ করছি। আমাদের একটাই দাবি, যখন হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছে, তখন এই হত্যাকাণ্ডকে নিয়ে মুখরোচক কোনো গল্প তৈরি করা না হোক। আমরা তাদের পেশাগত সম্মানটুকু দিতে চাই।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোকে না হয় বাদই দিলাম। তাদের দায়বদ্ধতার স্থানটি সুনির্দিষ্ট নয়। কিন্তু মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোতে আমরা যা লিখছি, তাকে কোন ছাঁচে ফেলব? এটা কি শুধুই জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য? আততায়ীর হাতে সহকর্মীর মৃত্যুর পরও তাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মসলাদার গল্প লেখা কি কোনো সংবাদমাধ্যমের কাজ হতে পারে? আমরা বিশ্বাস করি, যাঁরা জনপ্রিয়তার প্রত্যাশায় রং চড়িয়ে এমন খবর প্রকাশ করছেন, তাঁদের জন্য এটি আত্মঘাতী হতে পারে। এমন ভিত্তিহীন, অসংবেদনশীল খবর তাদের তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করবে।
গত সোমবার মধ্যরাত থেকে প্রতিনিয়ত আমরা আসলে রুনিকে খুন করছি। সকালে কাগজের পাতার শিরোনাম—‘হত্যার কারণ কি রুনি?’ আমাদের প্রশ্ন, কেন এমন করে সংবাদ উপস্থাপন? এভাবে উপস্থাপনের দরকারটা পড়ছে কেন? যাঁরা লিখছেন তাঁদের যুক্তি, কোনো ঘটনা ঘটলে পাঠক-দর্শক সেটা বিস্তারিতভাবে জানতে চান। তাঁরা বলছেন, আমজনতার কথা চিন্তা করে তাঁরা তাঁদের আবেগ-অনুভূতি বিসর্জন দিয়েছেন। আমজনতা যেভাবে জানতে চাইছেন, সেভাবেই সংবাদমাধ্যমগুলো খবর প্রকাশ করছে বলে তাঁদের দাবি। সংবাদমাধ্যমের নীতি কি তাহলে আমজনতার কাঁধে বন্দুক রেখে অনুমাননির্ভর গল্প ফাঁদা?
বরাবরই দেখে আসছি, যখন কোনো একটা ঘটনা ঘটে এবং সেখানে একজন নারী থাকেন, তখন তাঁকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা থাকে। অনেক পত্রিকাই আন্দাজ করে বা পুরোটা না জেনে এ ধরনের কাজ অতীতে করেছে। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডও ব্যতিক্রম নয়। রুনিকে নিয়ে নানা ধরনের শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। আমরা এর তীব্র আপত্তি জানাই। জেন্ডার সংবেদনশীলতার মতো শব্দগুলো কি শুধু কেতাবেই থেকে যাবে? আমরা কখনো তার অনুশীলনে মনোযোগী হব না?
রুনি সংবাদকর্মী হিসেবে তাঁর কাজে খুঁত রাখেননি। আজ তিনি নেই। তাঁর ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে বলার এখতিয়ার, অভিযোগের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আছে শুধু তাঁরই। সে সুযোগ তাঁর নেই। আমরা আমাদের সহকর্মীকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কেন সাংবাদিকতার এই সাধারণ নীতিটুকু মেনে চলব না?
এ ধরনের গল্প তৈরি করে আমরা কি তদন্তকেও প্রভাবিত করছি না? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন। পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের উপকমিশনার ইমাম হোসেন বলেছেন, তদন্তের স্বার্থে অনেকের সঙ্গে তাঁদের কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু অনেকেরই মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি আমরা প্রকারান্তরে মামলার গতিকে ধীর করে দিচ্ছি?
আমাদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে সাংবাদিক সমাজের প্রতি মানুষের যে আস্থা, তার ভিত নড়ে যাবে। আর রুনি-সাগরের মৃত্যুর পর থেকে আমরা তো তাঁদের একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘকে দগ্ধ করেই চলেছি। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যেভাবে মেঘকে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে, তা সাংবাদিকতার সব নীতি-নৈতিকতার চরম লঙ্ঘন। এই মেঘ একদিন বড় হবে। মা-বাবার মৃত্যু সম্পর্কে কোথায় কী লেখা হয়েছিল, একদিন সে ঠিকই খুঁজে করবে। সংবাদমাধ্যমে যে শ্রদ্ধার আসনে তাঁরা ছিলেন, আমরা আমাদের লেখায়-বলায় মেঘের জন্য কি তা অটুট রাখতে পারলাম? আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ তো তিলে তিলে এই শিশুটিকে শেষ করে দেবে।
আসুন, আমরা এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসি। আমরা যেন রুনি-সরওয়ারকে অসম্মান না করি। রুনি-সরওয়ার আমাদের পেশায় ছিলেন। তাই এমন দেখে আমরা যন্ত্রণা বেশি পাচ্ছি। এমন অনেক চাঞ্চল্যকর, অমানবিক ও স্পর্শকাতর ঘটনায় আমরা যেন একই রকমভাবে যন্ত্রণা অনুভব করি।
সংবাদমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরা পেশাগত জায়গায় আমাদের কাছে আদর্শ। তাঁদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ব্যাপক। আজকের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে তাঁদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখকেরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.