সুদিন তাহলে কার? by মাহবুব মোর্শেদ
বৃহস্পতিবারের দৈনিক সমকালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে 'লিটলম্যাগের দুর্দিন' শিরোনামে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সর্বশেষ পরিস্থিতিটি উঠে এসেছে। আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশে প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো।
সারা বছর ধরে ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেট মুখরিত থাকত লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক তরুণ সাহিত্যিকদের আড্ডায়-আলাপে। বহু লিটল ম্যাগাজিনের একাধিক সংখ্যা প্রকাশিত হতো বছরজুড়ে। আর বইমেলার সময় তো কথাই নেই। ডিসেম্বর-জানুয়ারি বা তারও আগে থেকে তোড়জোড় শুরু হতো। ক্রেতা ও পাঠকদের নজর থাকত মেলার দিকে। লিটল ম্যাগাজিনকে কেন্দ্র করে তরুণ লেখক, পাঠকদের এই বিশেষ আগ্রহের কারণেই বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বরটি একদা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। বহেড়া তলার লিটল ম্যাগ চত্বর ছিল আদিতে ছোট। পরে লিটল ম্যাগাজিনগুলোর চাহিদা অনুসারে পুরো চত্বরটার মূল সুর হয়ে ওঠে লিটল ম্যাগাজিন। বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষের উদারতায় লিটল ম্যাগাজিনের জন্য বরাদ্দ জায়গাটা বেড়ে যায়। কিন্তু জায়গা বাড়ার পরপরই লিটল ম্যাগাজিনের রমরমা অবস্থাটা পড়তির দিকে যায়, নব্বই দশকের শেষাশেষি কিংবা শূন্য দশকের প্রথম দিকেই। গত দু'তিন বছরে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন বলতে গেলে প্রায় স্তিমিতই হয়ে এসেছে। এবারের মেলায় ক'টি লিটল ম্যাগাজিন স্টলে নতুন পত্রিকা এসেছে, সেটি হাতে গুণে বলে দেওয়া যাবে। অধিকাংশ স্টলেই ম্যাগাজিনের লোকেরা ঠিকঠাক বসেননি বা নিয়মিত বসছেন না। বহেড়া তলার আড্ডা অবশ্য এখনও জমজমাট আছে। সেখানে তরুণ লেখকদের সমাবেশ কমবেশি দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, লিটল ম্যাগাজিনের এই দুর্দিনের পেছনে কী কারণ আছে? আজকাল কি তেমন উদ্যমী তরুণের সংখ্যা কমে যেতে বসেছে, যারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ম্যাগাজিনে নিজেদের লেখা প্রকাশ করবেন। নাকি লেখকই কমে গেছে? লিটল ম্যাগাজিনকে সমর্থন দেওয়ার মতো মানুষ কি নেই? হয়তো সবই সত্য। এও সত্য, তরুণদের মধ্যে লেখালেখির অভ্যাস এখন অনেক কম। আগে যেখানে শত শত তরুণের দেখা মিলত সেখানে এখন লেখালেখির জগতে নবাগতের সংখ্যা হাতেগোনা। অন্তত লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক সিরিয়াস লেখালেখির ক্ষেত্রে তরুণদের আনাগোনা কম। তাই স্বাভাবিক কারণেই লিটল ম্যাগাজিন বের হয় কম। কিন্তু তরুণরা লিখতে-পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন না, তা বোধহয় ঠিক পর্যবেক্ষণ নয়। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হচ্ছে না, সাহিত্য পত্রিকাগুলোকে ঘিরে বেড়ে উঠছে না লেখকগোষ্ঠী; কিন্তু প্রচুর তরুণ লিখছেন, প্রকাশও করছেন। সে লেখা লিটল ম্যাগাজিন আকারে আসছে না মেলায়। আসার উপায়ও নেই। গত এক দশকজুড়ে তৈরি হয়েছে লেখালেখির এক ভার্চুয়াল দুনিয়া। ব্লগ, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে লিখছেন অসংখ্য তরুণ। এখানে অনেকেই স্রেফ গালগল্প করেন। অনেকে সিরিয়াস মতপ্রকাশ করেন। কিন্তু তরুণ সাহিত্যিকদের অধিকাংশই এখন ব্লগেই প্রথম লেখাটা প্রকাশ করেন। সেখানেই গড়ে উঠছে নতুন লেখকদের নতুন বৃত্ত। স্বাভাবিক কারণেই আমরা লেখালেখির সে জগৎ সম্পর্কে অনবহিত। কিন্তু ব্লগে-ফেসবুকে লিখে লিখে বড় হচ্ছেন, এমন লেখকদের বইও বেরিয়ে যাচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিন বহুকাল এ দেশের লেখকদের কাছে বিকল্প মিডিয়া হিসেবে কার্যকর ছিল। এখন বিকল্প মিডিয়া আর ছাপা কাগজে নেই। বিকল্প মিডিয়া এখন পোর্টেবল, অনলাইন। একদিন হয়তো কোনো লিটল ম্যাগাজিনই আর প্রকাশিত হবে না। কিন্তু তরুণদের ভাবপ্রকাশ কি থেমে থাকবে? নতুন সাহিত্যিক কি আসবে না? আসবে। কোন মাধ্যমে আসবে সেটা খেয়াল রাখলেই হতাশা আর ঘিরে ধরবে না আমাদের।
No comments