আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬৩)-দুঃখের মধ্যেও হাসি by আলী যাকের
মিনিট কয়েকের মধ্যে পাকিস্তানের ক্ষুদ্র ও ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠল। সেগুলোর নিশানা ছিল রাজারবাগের পুলিশ লাইন। মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। তখন রাজারবাগের পুলিশ লাইনকে মালিবাগ, শান্তিনগর এবং মতিঝিল কলোনি_এই তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। মাঝেমধ্যে পুলিশের একটি কী দুটি ৩০৩ রাইফেলের
গুলির শব্দ পাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু প্রতিটি গুলির জবাবে শয়ে শয়ে গোলা সেই শব্দ লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল। গোলাগুলির শব্দ এতই প্রচণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আমরা সবাই প্রায় কানে তুলো গুঁজে দিলাম। আমাদের ওই বাড়িতে তখন আমার বোন এবং বোনাইও থাকত। আমার বোনাই এবং আমি অতি সাবধানে বাড়ির ছাদের ওপরে উঠে গেলাম। সেখানে ছাদের রেলিংয়ের আড়াল থেকে আমরা রাজারবাগের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশ দিয়ে অসংখ্য ট্রেসার বুলেট ভেসে যাচ্ছে। আকাশের তারা ম্লান হয়ে গেছে যেন। আর ভারী গোলার ভূ-পতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের হল্্কা উঠছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের স্থাপনাগুলো থেকে। রাত ২টার মধ্যে ওই প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ফলে রাজারবাগের বেড়ার তৈরি পুলিশ ব্যারাকগুলোতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। সেই আগুনের লেলিহান শিখা ২০০-৩০০ ফুট উঁচুতে পৌঁছে গেল এবং সেই আগুনের উষ্ণতা এতই তীব্র হয়ে উঠল যে আমরা দ্রুত নিচে নেমে এসে তোয়ালে কিংবা চাদর যা-ই হাতের কাছে পেলাম, তা ভিজিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিলাম। মনে হচ্ছিল, আমাদের শরীরের ত্বক যেন পুড়ে যাবে। ভোর সাড়ে ৪টা কি ৫টা হবে, গোলাগুলির শব্দ স্তিমিত হয়ে এসেছে; এমন সময় আমাদের সদর দরজায় হালকাভাবে কয়েকটি টোকার শব্দ পেলাম। দরজার পেছন থেকে পরিচয় জিজ্ঞেস করায় বাইরে থেকে জবাব এল, 'আমরা পুলিশ, ভাই।' আমি দরজা খুলতেই দেখলাম, সামনে দাঁড়িয়ে আছেন দুজন প্রায় উলঙ্গ মানুষ। দুজনেই মালকোচা করে লুঙ্গি পরে আছেন। তাঁদের মধ্যে একজন আমায় বললেন, 'ভাই আমাদের বুলেট শেষ। আমাদের অনেক বীর সহকর্মী মারা পড়েছেন এই যুদ্ধে। এই রাইফেল দুটো আপনি নিন। কোথাও লুকিয়ে ফেলবেন যেন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এগুলো খুঁজে না পায়। আমরা চলে যাচ্ছি। কোথায়, জানি না। তবে আমরা আবার ফিরে আসব এবং যুদ্ধ করে আমাদের দেশ স্বাধীন করব ইনশাল্লাহ্্। জয় বাংলা।' এই বলে তাঁরা অন্ধকারে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলেন। আমি সেই খোলা দরজার সামনে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। সম্বিৎ যখন ফিরল, তখন ভাবলাম একটি কর্ম এখনো বাকি আছে। রাইফেল দুটো কাঁধে করে অন্ধকারের মধ্যে আমাদের গলিতে দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে বাড়ির পেছনের জলাভূমিতে বিসর্জন দিলাম। তারপর কী হলো জানি না। চোখ বেয়ে এল বাঁধভাঙা কান্না। হাঁটু গেড়ে ওই জলার পাশে বসে পড়লাম। কতক্ষণ বসেছিলাম মনে নেই। পুব দিক যখন ফর্সা হয়ে এলো, সুদূর কোথাও থেকে ভেসে এল আজানের আওয়াজ। আমার হৃদয়ে তখন এক নতুন প্রত্যয় জন্ম নিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এই শহরে আর নয়। সত্বর এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। হাত মেলাতে হবে তাঁদের সঙ্গে, যাঁরা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশের স্বাধীনতা অর্জনের অঙ্গীকার করেছেন। তারপর বিজয়ীর বেশে এক দিন ফিরব আমার এই প্রিয় শহরে।
সেই অনুযায়ী ২৯ মার্চ ঢাকা ছাড়লাম। ইতিমধ্যে ২৮ তারিখে কারফিউ উঠলে আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি। চারুকলার সামনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তারা আমাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিস করে ২৫ মার্চের রাতের ঘটনাবলি বলতে লাগল। সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা, বিশেষ করে জগন্নাথ হলে, শুনে শিহরিত হলাম। ওরা এসএম হল থেকে বেরিয়ে মাঝরাতের কাছাকাছি সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক অধ্যাপকের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এখন তারা ঢাকা ছাড়বে মনস্থির করে ফেলেছে। হলে গিয়ে ওদের জিনিসপত্র নিয়ে আসতে সাহস হয়নি। বস্তুতপক্ষে সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে রেখেছে পাকিস্তানি আর্মি। সেখানে কেউ ঢুকতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতে মগবাজার পর্যন্ত এলাম। চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন। বিশেষ করে দোকানপাটগুলোতে। আমাদের প্রতি রাতের আড্ডাস্থল ক্যাফে তাজ-এর সামনে এসে দেখলাম কোনো জনমানব নেই ভেতরে। সব আসবাবপত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টের বাইরে এক কোণে মলিন মুখে ক্যাফে তাজ-এর মালিক তাজুল সাহেব গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়েছিলেন। ভদ্রলোক ঢাকাইয়া। অল্প-বিস্তর উর্দু বলতে পারেন। তাই কোনোমতে প্রাণে বেঁচে গেছেন। তবে তাঁর রেস্টুরেন্টটি ভেঙেচুরে দেওয়া হয়েছে। ওই চরম বিপদের সময়ও আদি ও অকৃত্রিম ঢাকাইয়া ভাষায় তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন আমাদের। মাঝরাতে আর্মির কয়েকজন জোয়ান এসে তাঁকে যখন দোকানের দরজা বন্ধ করতে বলল, তিনি তখন তাদের বলেছিলেন যে এই হোটেলের কোনো দরজাই নেই। সেই যেদিন থেকে খোলা হয়েছে, সেদিন থেকে হোটেলটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। অতএব, দরজার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি জীবনেও। তিনি ওদের এও বলেছিলেন যে দরজার কোনোদিন প্রয়োজন হবে, এ কথা তাঁর মনেই আসেনি। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিল-থাপ্পড়-ঘুষি, তারপর শোকেস ভেঙে চুরমার, আসবাবপত্র আছড়ে কুপোকাৎ। তাঁর এই বর্ণনা প্রায় কমিক রিলিফের মতো শোনালো। ওই দুঃখের মধ্যেও না হেসে পারলাম না।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সেই অনুযায়ী ২৯ মার্চ ঢাকা ছাড়লাম। ইতিমধ্যে ২৮ তারিখে কারফিউ উঠলে আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারিনি। চারুকলার সামনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। তারা আমাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ফিসফিস করে ২৫ মার্চের রাতের ঘটনাবলি বলতে লাগল। সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা, বিশেষ করে জগন্নাথ হলে, শুনে শিহরিত হলাম। ওরা এসএম হল থেকে বেরিয়ে মাঝরাতের কাছাকাছি সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো এক অধ্যাপকের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এখন তারা ঢাকা ছাড়বে মনস্থির করে ফেলেছে। হলে গিয়ে ওদের জিনিসপত্র নিয়ে আসতে সাহস হয়নি। বস্তুতপক্ষে সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে রেখেছে পাকিস্তানি আর্মি। সেখানে কেউ ঢুকতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতে মগবাজার পর্যন্ত এলাম। চারদিকে ধ্বংসের চিহ্ন। বিশেষ করে দোকানপাটগুলোতে। আমাদের প্রতি রাতের আড্ডাস্থল ক্যাফে তাজ-এর সামনে এসে দেখলাম কোনো জনমানব নেই ভেতরে। সব আসবাবপত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টের বাইরে এক কোণে মলিন মুখে ক্যাফে তাজ-এর মালিক তাজুল সাহেব গেঞ্জি এবং লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়েছিলেন। ভদ্রলোক ঢাকাইয়া। অল্প-বিস্তর উর্দু বলতে পারেন। তাই কোনোমতে প্রাণে বেঁচে গেছেন। তবে তাঁর রেস্টুরেন্টটি ভেঙেচুরে দেওয়া হয়েছে। ওই চরম বিপদের সময়ও আদি ও অকৃত্রিম ঢাকাইয়া ভাষায় তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন আমাদের। মাঝরাতে আর্মির কয়েকজন জোয়ান এসে তাঁকে যখন দোকানের দরজা বন্ধ করতে বলল, তিনি তখন তাদের বলেছিলেন যে এই হোটেলের কোনো দরজাই নেই। সেই যেদিন থেকে খোলা হয়েছে, সেদিন থেকে হোটেলটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে। অতএব, দরজার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি জীবনেও। তিনি ওদের এও বলেছিলেন যে দরজার কোনোদিন প্রয়োজন হবে, এ কথা তাঁর মনেই আসেনি। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিল-থাপ্পড়-ঘুষি, তারপর শোকেস ভেঙে চুরমার, আসবাবপত্র আছড়ে কুপোকাৎ। তাঁর এই বর্ণনা প্রায় কমিক রিলিফের মতো শোনালো। ওই দুঃখের মধ্যেও না হেসে পারলাম না।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments