শ্রদ্ধাঞ্জলি-ফটোসাংবাদিকতার স্তম্ভ রশীদ তালুকদার

সবাইকে রূপান্তরিত হতে হয় পর্যায়ক্রমে, তেমনই রূপান্তরিত হলেন আমাদের সবার প্রিয় রশীদ তালুকদার। সবাই তাঁকে চিনি একজন সুদক্ষ ও পেশাদার ফটোসাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু তিনি একজন সার্থক আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে বিশ্বের অসংখ্য দেশে আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের জন্য অনেক সুনাম বয়ে এনেছেন;


সঙ্গে পুরস্কার তো রয়েছেই। এ ছাড়া সে সময়কার আর্ট ফটোগ্রাফির প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষ। প্রয়াত আলোকচিত্রাচার্য মঞ্জুর আলম বেগের পাশে মাসিক সভায় যখন রশীদ তালুকদার এসে বসতেন, তখন প্রাণোজ্জ্বল এক পরিবেশের সৃষ্টি হতো এলিফ্যান্ট রোডের বিপিএস কক্ষে। তাঁর তারুণ্যদীপ্ত বক্তব্য উজ্জীবিত করত তরুণ আলোকচিত্রীদের। যখন প্রাণ খুলে উচ্চ স্বরে কথা বলতেন, সে কথার মধ্যে তখন থাকত সবার জন্য অনুপ্রেরণা আর সাহস।
আমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে ১৯৭৭ সাল থেকে। তখন আমি নিয়মিত ফটোগ্রাফির চর্চা করি; নিজে নিজে এনলার্জার মেশিনে প্রিন্ট করি। তখন সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। তিন মাস ছুটি। ভর্তি হলাম মঞ্জুর আলম বেগের ‘বেগ আর্ট-ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটে’। কোর্স শেষে প্রথম রিল তুললাম ৩৫ মিলিমিটার ফিল্মে। বেগ স্যার কনটাক্ট প্রিন্ট দেখে বললেন, ‘এই তিনটি ফটো আপনি ১র্০ র্ × ১র্২র্ মাপে প্রিন্ট করে আমার কাছে জমা দিন। আমি একটা প্রদর্শনীতে পাঠাব।’
তাঁর আদেশ অনুযায়ী কাজ করলাম। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর বেগ স্যার বললেন, ‘আজ বিকেলে প্রেসক্লাবে আসুন, প্রদর্শনীর উদ্বোধন হবে। আপনার ফটো প্রদর্শনীতে থাকবে।’ সেই বিকেলে প্রথম আমার প্রেসক্লাবে প্রবেশ। বুকটা টিপটিপ করছিল। আমি তখন ১৬ বছরের তরুণ। প্রেসক্লাবে প্রবেশ করতেই বেগ স্যারকে পেয়ে গেলাম। স্যার তাঁর সহকারী শহীদ ভাইকে বললেন, ‘মিঠুকে নিয়ে প্রথম সারিতে বসতে দাও।’
অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমি তখন এসবের কিছুই জানি না, বুঝি না। প্রথম অভিজ্ঞতা। দেখছি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। রশীদ তালুকদার পেলেন প্রথম পুরস্কার; দ্বিতীয় পুরস্কার পেলেন আল মাজি। তৃতীয় পুরস্কারের সময় শুনলাম, আমার নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। আমি হতভম্ব। মঞ্চে যেতে হবে কি না, তা-ও জানি না।
যা-ই হোক, সেই থেকে রশীদ তালুকদারকে কাছে পাওয়া, পরিচয়। বন্ধুত্ব দ্রুত বেড়ে ওঠে। ওই দিন বেগ স্যার বললেন, ‘মিঠু, আমরা আগামীরোববার সাভার বাজারে নদীর ওই পারে আউটিংয়ে যাব। আপনিও যাবেন। কমপক্ষে ১০ রিল ফিল্ম কিনে নিয়েন।’ সেই রোববার আমাকে কনিষ্ঠ পেয়ে এক পরম ভালোবাসায় আদর করে রশীদ তালুকদার তাঁর ভেসপার পেছনে উঠিয়ে নিলেন। এভাবে প্রায় পাঁচটি মোটরবাইকে ১০ জন এবং একটি প্রাইভেটকারে ছয়জন আলোকচিত্রী একত্রে গিয়েছিলাম। সেবার সঙ্গী হলাম বিখ্যাত যেসব আলোকচিত্রীর, তাঁরা হলেন: গোলাম মোস্তফা (বিটিভি), বিজন সরকার, নুরুল ইসলাম, দেবব্রত চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন, জাম্মু ভাই, মিজান ভাই প্রমুখ।
এরপর হাজার দিন একত্রে ছবি তুলেছি, বিদেশে পাঠিয়েছি; ওয়ার্কশপ করিয়েছি। একত্রে বহুবার রশীদ ভাইয়ের সঙ্গে ফটোগ্রাফির বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছি। কথাগুলো এ জন্য বললাম, যাতে করে বোঝানো যায় যে আমি বয়সে নবীন হলেও বয়োজ্যেষ্ঠদের হূদয়ের মধ্যে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিলাম। ফলে রশীদ তালুকদারের মতো বিশাল মনের মানুষকে বুঝতে পেরেছিলাম।
আমাদের দেশে তো প্রায়ই বন্যা হয়। সরকার তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য। সেবার আমাদের সবচেয়ে প্রবীণ ফটোগ্রাফার গোলাম কাশেম ড্যাডির ইন্দিরা রোডের বাসায় আমরা অনেকেই জড়ো হয়েছিলাম ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাবের বার্ষিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায়। সেদিন ড্যাডি বলেছিলেন, ‘এ বছর বন্যায় বাংলাদেশ সরকার অনেক সাহায্য পেয়েছে। কারণ, আমাদের রশীদ তালুকদারের তোলা বন্যার সার্থক ছবি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ও মন কেড়েছে।’
যে মানুষটির তোলা ছবি দেশের কল্যাণে অসহায় মানুষের অন্তর্নিহিত কথা বলার জন্য লক্ষ-কোটি শব্দের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাঁর এসব অমর সৃষ্টি কি সংরক্ষণ করবে কেউ?
একাত্তর-পরবর্তী প্রেক্ষাপটের দুর্লভ ফটোগুলোর মাধ্যমে যে ইতিহাস রশীদ ভাই তাঁর ক্যামেরায় বন্দী করে গিয়েছেন এবং যেসব আর্ট-ফটোগ্রাফি সে আমলে সার্থকতার সঙ্গে পরস্ফুিটন করেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয়। এমনিভাবে ইতিহাসের পাতায় আরও অনেক নামকরা আলোকচিত্রী এসেছিলেন, আবার চলেও গেছেন। বর্তমান প্রজন্মের সামনে আমরা সেসব সৃষ্টি কীভাবে তুলে ধরব?
সরকারের কাছে দাবি, একটি জাতীয় আলোকচিত্র জাদুঘর তৈরি করার, যা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তবেই হয়তো একজন রশীদ তালুকদার, একজন মঞ্জুর আলম বেগ, গোলাম কাশেম ড্যাডিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব; তাঁদের সম্মানিত করতে পারব।
আমার চলচ্চিত্র গহীনে শব্দতে রশীদ তালুকদারের জীবনকে কেন্দ্র করে একটি চরিত্র লিখেছিলাম—তালুকদার, যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেকজন গুণী শিল্পী আরিফুল হক। রশীদ ভাই অসুস্থ থাকায় প্রিমিয়ার শোতে উপস্থিত থাকতে পারেননি। প্রায় এক বছর পর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ছোট সিনেমা হলে রশীদ ভাই ও শিল্পী শাহাবুদ্দীনের সম্মানে একটা বিশেষ প্রদর্শনী করি।
রশীদ ভাই সিনেমা দেখার পর কেঁদেছিলেন, অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন। শিল্পী শাহাবুদ্দীন প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বলতে পারেননি। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের যে মূল্যবোধ প্রতিটি দৃশ্যে সূক্ষ্মভাবে গাঁথা ছিল, তা তাঁদের স্পর্শ করেছিল।
দেশকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবাসতেন রশীদ ভাই। আমাকে বলা তাঁর শেষ কথা ছিল—‘মিঠু, আপনি গহীনে শব্দতে আমার চরিত্রটি লিখে যেভাবে সম্মানিত করেছেন, এটা শুধু রশীদ তালুকদারই নয়, সব ফটোগ্রাফারকেই সম্মান করেছেন। আমি খুব খুশি। মন ভরে আপনার জন্য দোয়া করি, যেন অনেক ভালো ভালো কাজ করতে পারেন।’
শহীদ মিনারে রশীদ ভাইকে শেষ মুহূর্তের জন্য দেখতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ একটি কথা শুনতে পেলাম। স্বনামধন্য একজন বলছিলেন, ‘ওহ! রশীদ ভাইকে তো এখনো একুশে পদক দেওয়া হয়নি! খুব ভুল হয়ে গেল। আর আমরা কতকাল এ ভুল করব? মরণোত্তর পুরস্কারের বেড়াজাল থেকে কবে আমরা মুক্তি পাব?’
খালিদ মাহমুদ মিঠু

No comments

Powered by Blogger.