পরিবেশ-দীর্ঘ জলাবদ্ধতায় বঞ্চিত জীবন by মুশফিকুর রহমান

আকস্মিক বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরে আমরা যত বিচলিত হই, দীর্ঘ জলাবদ্ধতার খবরে ততটা হই না। একই কারণে হয়তো প্রলম্বিত জলাবদ্ধতার ভোগান্তির চিত্র সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ হারায়। কেবল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু উদ্যোগী সংগঠন মাঝেমধ্যে মানববন্ধন, সেমিনার-সভা করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, কী কষ্টে দিন কাটছে যশোর, খুলনার নিম্নাঞ্চল ও সাতক্ষীরা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার অসংখ্য জলবন্দী মানুষ।


আমার সুযোগ হয়েছিল এবার শরতের শেষে সাতক্ষীরার তালা ও যশোরের সাগরদাঁড়ি ঘুরে দেখার।
সুন্দরবনসংলগ্ন জেলা সাতক্ষীরার অধিবাসীদের প্রলম্বিত ও ভারী বর্ষায় সাময়িক জলাবদ্ধতার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, প্রকৃতির রুদ্ররোষ যেন বা বহুমাত্রিক ও তীব্রতর হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার দেশে বর্ষা ছিল ভারী এবং প্রলম্বিত। সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় এর পরিণতি হয়েছে অভূতপূর্ব ও বিপর্যয়কর। বর্ষা শেষ হওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বৃষ্টির জমে থাকা জল ও নদ-নদীর দুই কূল উপচে চারপাশের জনপদ প্লাবিত করা জল এখনো সরে যায়নি; বরং কপোতাক্ষ নদের দুই পাশে দৃষ্টি প্রসারিত করে বুঝে ওঠা বেশ কঠিন, কোথায় নদের সীমানা বা পাড়। নদীর প্লাবনভূমি, চারপাশের ফসলের খেত, লোকালয়, গ্রাম, হাটবাজার—সবই দীর্ঘদিন ধরে জলমগ্ন। মানুষ বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে নিকটবর্তী সড়ক, বাঁধ, স্কুল বা কলেজের বারান্দাসংলগ্ন মাঠে। ছোট্ট ঝুপড়িঘর তুলে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির সঙ্গে কোনোরকম দিন যাপন করছে। অধিকাংশ মাঠেই আটকে থাকা জলের নিচে পচে গেছে ফসল। মাটি বা বেড়ার তৈরি ঘরবাড়ি ধসে পড়েছে। পানের বরজ, সবজির খেত, হলুদ, কলার খেত, আমের বাগান জলমগ্ন হয়ে হয়ে পচে গেছে অথবা বিবর্ণ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মানুষের প্রচলিত জীবিকা ও কাজের জায়গাগুলো অপরিচিত হয়ে উঠেছে। অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত কিছু ত্রাণসাহায্য এখন বাস্তুচ্যুত অধিকাংশ মানুষের অবলম্বন। এমনই এক সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র তালা উপজেলার মাঝিয়াড়া; পথের পাশে গড়ে ওঠা সারি সারি ঘর। শিশু কোলে খাদিজা নামের অল্প বয়সী এক মা বলছিলেন, তাঁর তিন মাস বয়সী শিশুর দিন কেমন কাটছে। কোলের শিশুটির জন্ম এই পথের ধারে পলিথিনে মোড়ানো একটুকরো ‘ঘরে’। এখানে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের কিছুই নেই।
গ্রামে হাঁটু বা কোমরসমান পানির মধ্যে এখনো যাঁদের বসতবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তাঁরা ঘরদোর ও আসবাব দেখভাল করতে নোংরা জল ভেঙে মাঝেমধ্যে বাড়িতে যাচ্ছেন। কেউ কেউ মাচা বানিয়ে জলে ডোবা ঘর পাহারা দিচ্ছেন। দীর্ঘ জলাবদ্ধতায় মানুষ কেবল ঘরছাড়া হয়েছে তা-ই নয়, কাজ হারিয়ে উপার্জনের উপায়ও হারিয়েছে। অনেকেই খেয়া জাল নিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন। কারও কারও জন্য এরই মধ্যে মাছ ধরাই হয়ে উঠেছে পেশা।
ইসলামকাটি গ্রামের নিলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গে কথা হলো। তাঁর শ্বশুর সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, স্বামী স্থানীয় কলেজের কম্পিউটার অপারেটর। জলাবদ্ধতার কারণে নিজেদের পাকা বাড়ি ছেড়ে সন্তানকে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো পড়েছে উভয় সংকটে। তারা না পারছে হাত পাততে, না পারছে এই দীর্ঘ অনিশ্চিত জলাবদ্ধ জীবনে বিকল্প উপার্জনের পথ খুঁজতে। নিলুফার বলেন, ‘আমরা সাহায্য চাই না। এই জমে থাকা জল সরানোর ব্যবস্থা করেন।’
উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার বলেন, উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ তিন মাস ধরে পানিবন্দী। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে যে ত্রাণ-সহায়তা দেওয়া হচ্ছে, তা অপ্রতুল। প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি যাদের সাহায্য দরকার, তাদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা কঠিন। সরকারি ত্রাণের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিভিন্ন আশ্রয়স্থলে সীমিত পরিমাণ খাদ্য, ‘ঘর’ নির্মাণের জন্য পলিথিনের শিট ও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কিছু ওষুধ অনিয়মিতভাবে বিতরণ করছে। পানি সরবরাহের জন্য কিছু টিউবওয়েল ও পায়খানা স্থাপন করেছে রাস্তার পাশে।
সাতক্ষীরা অঞ্চলের জলাবদ্ধতা একদিনে এ অবস্থায় আসেনি। কপোতাক্ষ নদ, বেতনাও শালিখা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে উঠেছে। নদীর পাড় দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, প্লাবনভূমিতে অপরিকল্পিত মাছের খামার, উপকূলে বেড়িবাঁধ তৈরিসহ মানুষের বিভিন্ন অপরিণামদর্শী তৎপরতা জলাবদ্ধতা সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করেছে। তা ছাড়া নিয়মিত এবং পরিকল্পিত নদী খনন বা ড্রেজিং না করার কথাও স্থানীয় মানুষ বলছেন।
পানিবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত মনে করেন, উজানের নদীগুলোর পানিপ্রবাহ ক্ষীণ হয়ে আসা, উপকূলজুড়ে বেড়িবাঁধ তৈরি, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের নদীগুলোর প্রবাহ হ্রাস এবং নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে ওঠা এর প্রধান কারণ। ড্রেজিং সাময়িক সুফল দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যার সমাধান নয়। সরকার কপোতাক্ষ নদ খনন করার উদ্যোগ নিয়েছে। কেবল খাল-নদী খনন করার উদ্যোগ নয়, ব্যয়বহুল এ জাতীয় উদ্যোগের যথাযথ সমন্বয় ও কারিগরি দিক থেকে দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করা জরুরি। অতীতে নদী খনন ও বাঁধ নির্মাণ কর্মকাণ্ড লক্ষ্য অর্জনে কেন সমর্থ হয়নি—সে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি কাজের মান, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা না থাকার কথাও এখানকার ভুক্তভোগী মানুষ বলছেন। সাতক্ষীরা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমানও বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে অতীতে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কাজের মান মনিটরিং করার সমন্বিত কোনো ব্যবস্থা কার্যকর করা যায়নি।
দীর্ঘ জলাবদ্ধতা যে অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের কারণ হয়েছে, তার কি কোনো সহজ সমাধান আছে? একসময়ের খরস্রোতের গভীর জলধারা কপোতাক্ষ নদ খননের যে উদ্যোগ সরকারিভাবে নেওয়া হয়েছে, তা ফলপ্রসূ করতে নদীপাড়ের মানুষের জীবনকে পরস্পর নির্ভরতার বন্ধনে বিকশিত হতে দেওয়া জরুরি। উদ্যোগ দরকার নদীর পানিপ্রবাহ বাড়ানোর। বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ বিশেষায়িত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নদ-নদীর ব্যবস্থাপনা করা গেলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।
ড. মুশফিকুর রহমান: পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.