প্রযুক্তি ও আমাদের প্রগতি by লুৎফর রহমান রনো
মানুষ দিন দিন গতিসম্পন্ন হয়ে উঠছে। আক্ষরিক অর্থেই গতি এসেছে জীবনে। গতিশীল মানুষ বলতে মানুষের পায়ে চাকা গজায় না দ্রুত চলার জন্য বা পাখা গজায় না ওড়ার অনন্ত অভিলাষ সত্ত্বেও। চাকাওয়ালা যান ও পাখাওয়ালা উড়োযান তৈরি করে মানুষ তাতে চড়েই দূরের পথকে নিকটবর্তী করেছে। আমাদের দেশে সবক্ষেত্রে যুগোপযোগী গতি আসেনি।
তার কারণ আমাদের প্রগতি বিশ্বমানের নয়। গতি-প্রগতি কোনোটাই আমাদের সবার জন্য নয়, কিছুসংখ্যক মানুষের জীবনকে গতি দেয়, আলো দেয়। যেমন আমাদের ট্রেন সার্ভিস এখন মুমূর্ষু। এই যানে মোটামুটি বেশিসংখ্যক মানুষের সময় ও অর্থের সাশ্রয় হতে পারত। কিন্তু রেলওয়ে সেক্টরই অবহেলিত। যেগুলো আছে তা-ও সেই পুরনো দিনের গতিতে চলে। অথচ উন্নত বিশ্বের ট্রেনের গতি প্রায় আকাশযানের কাছাকাছি। দিন দিন তাদের স্থল-জল-আকাশ সর্বপ্রকার যানের যান্ত্রিক উৎকর্ষ বাড়ছে। আমরা বলতে গেলে বিপরীত দিকে চলছি অথবা থমকে আছি আগের অবস্থানে।
কোনো জাতির জীবনে গতি-প্রগতি, উন্নতি-উৎকর্ষ আসে অবশ্যই তার শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিপুষ্টি ও উৎকর্ষের মানমাত্রা অনুযায়ী। এ ছাড়া কোনো বিকল্প মানবেতিহাসে পাওয়া যায় না। এ দেশে অকল্পনীয় দ্রুত সময়ের মধ্যে ধনী হয়ে উঠতে পারার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও আমরা আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি বা সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে পারিনি। সৎ ও শক্ত কলমের সাংবাদিক-কলামিস্ট, দৃষ্টিসম্পন্ন কবি-সাহিত্যিক, চিত্রকর বা চলচ্চিত্রকার কিছুই আর আগের জায়গায় আসতে পারেনি। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরও সত্তরের দশকের সঞ্চয় থেকে দেখে নিলে বোঝা যাবে আমাদের যা ছিল তা-ও নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, সময় অতিবাহিত হয়েছে প্রায় ৪০ বছর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যন্ত্রসভ্যতার উপাদান ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো প্রয়োজনীয় উপায়। কিন্তু এসবের কিছুই আমরা আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মেধা-মননশীলতার জন্য কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে ব্যক্তি সম্পত্তির, বস্তুগত বিষয় ও বৈষয়িকতার বা গাড়ি-বাড়ি-শহর-নগরের জৌলুশ বেড়েছে। সমান মানে মাপে তরুণ সমাজের মধ্যে জাগরণ এনেছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও উপগ্রহ মাধ্যমের সুযোগ-সুবিধা। চাল-চলন-ভূষণ-ফ্যাশনে এসেছ আমূল পরিবর্তন, এমনকি ডিজিটাল ভাষাও কিছু জায়গায় জুড়ে বসেছে। যা হোক, যা কিছুই হচ্ছে বা পরিবর্তন ঘটছে তাকে যুগের দাবি হিসেবে একসময় সমাজ হজম করে নেয়, তা সত্য। কিন্তু কোনোটা হয় সত্যি হজম আর কোনোটা হয় বদহজম। বদহজমের প্রতিক্রিয়া যে ভালো হয় না তা সবাই জানি।
নানা সময় ফেসবুক নিয়ে লেখালেখি ও বিতর্ক শোনা যায়। এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে, তা বেশির ভাগ মানুষ মনে করে। এরূপ সব প্রগতি-প্রযুক্তি ও নতুন যেকোনো কিছুরই দুটি দিক থাকবেই। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা এসবও যখন নতুন ছিল, তা নিয়েও নিশ্চয়ই বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু কথা হলো, সেই মূল কথাটি। আমাদের সমাজ তার কোনো কিছুই ভালোভাবে হজম করার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তাই সবই বদহজমের উপসর্গ রূপে সমাজের নানা স্তরে উৎপাত হিসেবে চলছে। এর কারণ আমাদের সমাজ বা তরুণ সমাজের সামনে বস্তুগত উৎকর্ষের দৃষ্টান্ত ছাড়া, শিক্ষার নামে মননচর্চা নয় অর্থ প্রতিষ্ঠার প্ররোচনা ছাড়া অন্য কিছুই অনুসরণীয় বা শিক্ষণীয় রূপে দাঁড় করাতে পারিনি। সহজ কথায়, আমাদের ভূমি উর্বর নয়। তাই অনুর্বর ও অপ্রস্তুত জমিতে ভালো জাতের বীজ বপন করলেও ভালো ফল যেমন দুরাশা মাত্র, ঠিক সমাজও তেমনি। তথ্যপ্রযুক্তি হোক আর তৎসংশ্লিষ্ট যা কিছুই হোক না কেন, এসবের ব্যবহার হবেই অশিক্ষিত, অসংস্কৃত আনাড়ি ব্যবহারের মধ্যে বিনোদনের নিমিত্তেই কেবল। অতএব, দুনিয়াজুড়ে যে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের উপকার বিভিন্ন দেশ ও জাতি ভোগ করছে, আমরা তাদের মতো পারছি না। এসব ব্যবহারের লক্ষ্য ও গুণগত পার্থক্য সুস্পষ্ট। এ দেশে সহজে নেতা হওয়া আর ধনী হওয়া যায় বটে, ঠিক এমনি কিন্তু জাতির সমৃদ্ধি শর্টকাট পথে সম্ভব নয়। অনুর্বর অকর্ষিত জমিতে ভালো বীজ এনে ছেড়ে দিলেই ফসল ঘরে উঠবে না। এ কথা মনে রেখেই ডিজিটালের স্বপ্ন দেখতে হবে। ভালো জিনিস হজম করার মতো মন-মনন তৈরি হতে হবে সমাজের।
তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি সহজলভ্য হয়েছে; কিন্তু তাতে অপব্যবহারের কুফল ফলছে সমাজজুড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আমাদের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ভিত্তি দিন দিন এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে আত্মবিশ্বাসের নানা প্রযুক্তি ও উপাদান আয়ত্তে থাকা সত্ত্বেও তা দিয়ে চলছে আত্মবিনাশ। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড বলা হতো। নিঃসন্দেহে বিশ্বের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভালো আসন ছিল। অথচ সেদিন একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, কয়েক শ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সারিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি পর্যন্ত নেই।
এই ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য অবনতি ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ থেকে আমাদের দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি চিত্র অনুমান করতে পারি। উন্নত বিশ্ব থেকে বরাবরই তত্ত্ব-সাহিত্য-প্রযুক্তি আমরা আত্মস্থ করার লক্ষ্যে আমদানি করি। কিন্তু চর্চা-চিন্তাশীলতার অভাবে তা বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। এ থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও চিন্তাশীল, দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
কোনো জাতির জীবনে গতি-প্রগতি, উন্নতি-উৎকর্ষ আসে অবশ্যই তার শিক্ষা-সংস্কৃতির পরিপুষ্টি ও উৎকর্ষের মানমাত্রা অনুযায়ী। এ ছাড়া কোনো বিকল্প মানবেতিহাসে পাওয়া যায় না। এ দেশে অকল্পনীয় দ্রুত সময়ের মধ্যে ধনী হয়ে উঠতে পারার ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু সুদীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেও আমরা আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি বা সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে পারিনি। সৎ ও শক্ত কলমের সাংবাদিক-কলামিস্ট, দৃষ্টিসম্পন্ন কবি-সাহিত্যিক, চিত্রকর বা চলচ্চিত্রকার কিছুই আর আগের জায়গায় আসতে পারেনি। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরও সত্তরের দশকের সঞ্চয় থেকে দেখে নিলে বোঝা যাবে আমাদের যা ছিল তা-ও নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, সময় অতিবাহিত হয়েছে প্রায় ৪০ বছর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যন্ত্রসভ্যতার উপাদান ও তথ্যপ্রযুক্তির মতো প্রয়োজনীয় উপায়। কিন্তু এসবের কিছুই আমরা আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মেধা-মননশীলতার জন্য কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে ব্যক্তি সম্পত্তির, বস্তুগত বিষয় ও বৈষয়িকতার বা গাড়ি-বাড়ি-শহর-নগরের জৌলুশ বেড়েছে। সমান মানে মাপে তরুণ সমাজের মধ্যে জাগরণ এনেছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও উপগ্রহ মাধ্যমের সুযোগ-সুবিধা। চাল-চলন-ভূষণ-ফ্যাশনে এসেছ আমূল পরিবর্তন, এমনকি ডিজিটাল ভাষাও কিছু জায়গায় জুড়ে বসেছে। যা হোক, যা কিছুই হচ্ছে বা পরিবর্তন ঘটছে তাকে যুগের দাবি হিসেবে একসময় সমাজ হজম করে নেয়, তা সত্য। কিন্তু কোনোটা হয় সত্যি হজম আর কোনোটা হয় বদহজম। বদহজমের প্রতিক্রিয়া যে ভালো হয় না তা সবাই জানি।
নানা সময় ফেসবুক নিয়ে লেখালেখি ও বিতর্ক শোনা যায়। এর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে, তা বেশির ভাগ মানুষ মনে করে। এরূপ সব প্রগতি-প্রযুক্তি ও নতুন যেকোনো কিছুরই দুটি দিক থাকবেই। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা এসবও যখন নতুন ছিল, তা নিয়েও নিশ্চয়ই বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু কথা হলো, সেই মূল কথাটি। আমাদের সমাজ তার কোনো কিছুই ভালোভাবে হজম করার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তাই সবই বদহজমের উপসর্গ রূপে সমাজের নানা স্তরে উৎপাত হিসেবে চলছে। এর কারণ আমাদের সমাজ বা তরুণ সমাজের সামনে বস্তুগত উৎকর্ষের দৃষ্টান্ত ছাড়া, শিক্ষার নামে মননচর্চা নয় অর্থ প্রতিষ্ঠার প্ররোচনা ছাড়া অন্য কিছুই অনুসরণীয় বা শিক্ষণীয় রূপে দাঁড় করাতে পারিনি। সহজ কথায়, আমাদের ভূমি উর্বর নয়। তাই অনুর্বর ও অপ্রস্তুত জমিতে ভালো জাতের বীজ বপন করলেও ভালো ফল যেমন দুরাশা মাত্র, ঠিক সমাজও তেমনি। তথ্যপ্রযুক্তি হোক আর তৎসংশ্লিষ্ট যা কিছুই হোক না কেন, এসবের ব্যবহার হবেই অশিক্ষিত, অসংস্কৃত আনাড়ি ব্যবহারের মধ্যে বিনোদনের নিমিত্তেই কেবল। অতএব, দুনিয়াজুড়ে যে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের উপকার বিভিন্ন দেশ ও জাতি ভোগ করছে, আমরা তাদের মতো পারছি না। এসব ব্যবহারের লক্ষ্য ও গুণগত পার্থক্য সুস্পষ্ট। এ দেশে সহজে নেতা হওয়া আর ধনী হওয়া যায় বটে, ঠিক এমনি কিন্তু জাতির সমৃদ্ধি শর্টকাট পথে সম্ভব নয়। অনুর্বর অকর্ষিত জমিতে ভালো বীজ এনে ছেড়ে দিলেই ফসল ঘরে উঠবে না। এ কথা মনে রেখেই ডিজিটালের স্বপ্ন দেখতে হবে। ভালো জিনিস হজম করার মতো মন-মনন তৈরি হতে হবে সমাজের।
তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন ইত্যাদি সহজলভ্য হয়েছে; কিন্তু তাতে অপব্যবহারের কুফল ফলছে সমাজজুড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। আমাদের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ভিত্তি দিন দিন এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে আত্মবিশ্বাসের নানা প্রযুক্তি ও উপাদান আয়ত্তে থাকা সত্ত্বেও তা দিয়ে চলছে আত্মবিনাশ। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড বলা হতো। নিঃসন্দেহে বিশ্বের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভালো আসন ছিল। অথচ সেদিন একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, কয়েক শ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সারিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি পর্যন্ত নেই।
এই ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য অবনতি ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এ থেকে আমাদের দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি চিত্র অনুমান করতে পারি। উন্নত বিশ্ব থেকে বরাবরই তত্ত্ব-সাহিত্য-প্রযুক্তি আমরা আত্মস্থ করার লক্ষ্যে আমদানি করি। কিন্তু চর্চা-চিন্তাশীলতার অভাবে তা বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। এ থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও চিন্তাশীল, দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
No comments