ধর নির্ভয় গান-এই বসন্তের আগমনে by আলী যাকের
ফরীদি চলে গেল। আরও কিছুদিন থেকে গেলে পারত। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল। আজ এই সুদূরে বসে ওর কথা মনে আসছে বড়। যদিও সাম্প্রতিককালে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। আমাদের পথ চলছিল সমান্তরাল পথে। একসময় ওর সঙ্গে এক ধরনের বন্ধুতা হয়েছিল আমার। পরে আমার সন্তানদেরও।
বাচ্চারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বেশি ভালো বোঝে। ওরা বড় দুঃখ পেয়েছে। বিচলিত হয়েছে। আমি এই প্রস্থানকে দেখছি আমার মতো করে
এই বসন্তের সূচনায় আমি দেশে নেই। দেশ থেকে দূরে, আবার খুব দূরেও নয়_ এমন একটি স্থানে আমি বসে, এক বহুতল ভবনের ছাদের ওপরে। এখানে মাথার ওপরে একটা ছোট ছাদ আছে বটে, কিন্তু চারদিকে কোনো দেয়াল নেই। অতএব দৃষ্টি অবারিত, যেদিকে তাকাই। একটু দূরে ছায়ার মতো কিছু পাহাড় দেখা যায়। সারাটা শহর সবুজে ঢাকা। যেন সবুজ জলের সমুদ্র চারদিকে। মনটা নানা কারণে ভালো নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বিষয়গুলো মানুষকে বিচলিত করে সাধারণত, যেমন_ রোগ, জরা ইত্যাদি নিজের এবং আপনজনদের, সে তো আছেই। তার চেয়েও বড় কথা, একটা বয়সে পেঁৗছে এই বোধোদয় হওয়া যে, আমি নিজের ওপর কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। এখন চাইলেই যথেচ্ছাচার করা সম্ভব নয় আর_ এটা গ্রহণ করা কারও পক্ষেই বোধহয় সহজ নয়। কিছুদিন আগেও ভাবতাম, আমার শরীর, মন আমারই তো! অতএব যা খুশি, যেমন খুশি আচরণ করা যায় এর সঙ্গে। আমাদের এক প্রখ্যাত কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার একসময় ঘন ঘন চেহারা বদল করতেন। কোনো সময় মাথা চেঁছে ফেলতেন, কোনো সময় চুল রাখতেন, কখনও আবার পরচুলাও পরতেন। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করত এমন ঘন ঘন চেহারা বদল কেন? তিনি মোক্ষম জবাব দিতেন, 'আরে ভাই, চেহারাটা তো আমারই। আমি তো অন্য কারও চেহারা নিয়ে স্বেচ্ছাচার করছি না?' তার এই বাক্যটি দারুণ লাগত আমার। আমি তাকে অনুসরণ এবং অনুকরণ করে অনেককে আমার নিজের সম্পর্কেও বলেছি এই ধরনের কথা। এখনও বলি। তবে জানি যে, সব ঠিক নেই। এই আমিই তো কত তরুণকে রবীন্দ্রনাথের গান উদ্ধৃত করে বলেছি, 'ওরে সাবধানী পথিক; বারেক পথ ভোল, পথ ভোল, পথ ভুলে মর ফিরে...।' আমার সবসময় মনে হয়েছে, সময় যত এগিয়ে চলেছে, আমরা যত আধুনিক হচ্ছি, ততই সীমিত হয়ে পড়ছি আমাদের চলায়, বলায়, চিন্তা-চেতনায়। বড় সাবধানে ফেলছি পা। সর্বদা আমাদের মনে শঙ্কা, জীবনের চলার পথে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ হারিয়ে ফেলছি যেন। যেন অন্য কেউ তা ছিনিয়ে নিচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। এক প্রায় অশল্গীল প্রতিযোগিতার আক্রমণে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি আমরা। কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে গিয়ে যে জীবনকেই হারিয়ে ফেলছি তা কি বুঝছি আমরা? এ রকম পরিস্থিতি থেকে মুক্তির একটি উপায় হতে পারে পথ ভুলে ঘুরে মরা হয়তোবা। কিন্তু আমি যদি পথ ভোলারও অধিকার হারিয়ে ফেলি, মন চায় না বলে নয়, শরীর পারে না বলে, তাহলে মানুষের আর উপায় কি থাকে কোনো?
আজ সন্ধ্যায় এই ছাদের ওপরে বসে দূর দিগন্তে অপসৃয়মান মেঘের ভেলা দেখছি। এই শহরের উজ্জ্বল আলো মেঘের তলদেশকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। হাওয়া বইছে হুহু করে। কেমন শীত শীত করছে এখানে, এই সবার মাথার ওপরে বসে। মনটাও হুহু করছে হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ইংরেজিতে একটা অভিব্যক্তি আছে ্তুৎবভষবপঃরাব ঃযড়ঁমযঃ্থ, বাংলায় একে কী বলব জানি না। হয়তো বলা যেতে পারে 'প্রতিবিম্বিত চিন্তা'। আজ এই ধরনের মন কেমন করা অনেক চিন্তা মাথায় ভিড় করে আসছে যেন। প্রতিবিম্বিত বললাম এই কারণে যে, চিন্তাগুলো আমার মৌলিক সৃষ্টি নয়। এগুলো আসলেই প্রতিবিম্বিত এবং সৃষ্ট পারিপাশর্ি্বক অবস্থার দ্বারা।
ফরীদি চলে গেল। আরও কিছুদিন থেকে গেলে পারত। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল। আজ এই সুদূরে বসে ওর কথা মনে আসছে বড়। যদিও সাম্প্রতিককালে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। আমাদের পথ চলছিল সমান্তরাল পথে। একসময় ওর সঙ্গে এক ধরনের বন্ধুতা হয়েছিল আমার। পরে আমার সন্তানদেরও। বাচ্চারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বেশি ভালো বোঝে। ওরা বড় দুঃখ পেয়েছে। বিচলিত হয়েছে। আমি এই প্রস্থানকে দেখছি আমার মতো করে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, 'জীবন থেকে মৃত্যু একটা রূপান্তরই কেবল। এর বেশি কিছু নয়।' কবিগুরুর এই কথাটি অস্বীকার করে সাধ্য আছে কার? তবুও যে নতুন জীবনে ফরীদির প্রবেশ ঘটল সেখানে কাদের ও ওর অভিনয়শৈলী দিয়ে অমন আনন্দ দেবে, যেমন দিত আমাদের? কী বহুমাত্রিক ছিল ওর অভিনয়ের ক্ষমতা! অবলীলায় নিজেকে ভেঙেচুরে ফেলতে পারত ও। আবার নির্মাণ করতে পারত ভিন্ন ভিন্নভাবে, নতুন করে। ওর চলে যাওয়ার পর ইন্টারনেটে গিয়ে দেখলাম, কত লোক কত কথা বলছে ওকে নিয়ে। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে ফরীদি অনেক মানুষের জীবন স্পর্শ করেছিল। কেবল অভিনয় দিয়ে তো তা সম্ভব নয়? একসময়, আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে, আমরা খুব আড্ডা মারতাম সন্ধ্যাবেলায়। তখনও ও ফিল্মে তেমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েনি। অসাধারণ ক্ষমতা ছিল ওর গল্প করার। নিতান্ত সাধারণ বিষয় নিয়েও। রান্নাবাড়ার বিষয়েও ভীষণ আগ্রহ ছিল ফরীদির। এখানেও ওর অভিনয় প্রতিভার অবদান ছিল বলতেই হবে। ও অবলোকন করত নিবিড়ভাবে। একজন অভিনেতার যা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। ও বলত, 'জানেন, মাছ বড় শিষ্ট প্রাণী। তেল-মসলা মাখিয়ে চুলোয় চাপিয়ে দিন, দেখবেন একেবারে লক্ষ্মীর মতো শুয়ে থেকে সেদ্ধ হয়ে চলেছে। আর মাংস বড় বেয়াদব। সেদ্ধ হওয়ার আগে একাধিকবার উঠতে, বসতে চায়। তখন চামচ দিয়ে বসিয়ে দিয়ে ঢাকনা চাপা দিয়ে রাখুন, সিধে হয়ে যাবে।' ও অসাধারণ কৌতুক বলতে পারত। বলার সময় একেবারে নির্লিপ্ত থাকত। কিন্তু বলা হয়ে গেলে প্রাণ উজাড় করা এক হাসি দিত হা-হা করে।
আমি ফরীদি অভিনীত একাধিক মঞ্চনাটক দেখেছি। ওর প্রথম যে নাটকটি আমার মন কেড়ে নেয়, সেটি হলো 'ফণীমনসা'। অসাধারণ অভিনয় করেছিল ও। ঢাকা থিয়েটারের সে সময়ের প্রায় সব নাটকেই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ওর উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। তবে মঞ্চের সঙ্গে ওর সম্পর্কের একেবারে শেষদিকে ও ঢাকা থিয়েটারেরই নাটক বের্টল্ট ব্রেশ্টের ্তুঞযব জবংরংঃরনষব জরংব ড়ভ অৎঃঁৎড় টর্থ অবলম্বনে 'ধূর্ত উই' নাটকের নাম ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে ্তুংঃধমব ঢ়ৎবংবহপব্থ, সেটা ছিল ফরীদির পূর্ণমাত্রায়। মাঝারি আকারের একজন হালকা-পাতলা মানুষ, অথচ মঞ্চে যখন আবির্ভূত হতো, তখন একেবারে সবার নজর কেড়ে নিত ও। আমার খুব বেশি সুযোগ হয়নি ফরীদির সঙ্গে অভিনয়ের। সামান্য কয়েকটা টিভি নাটক করেছিলাম ওর সঙ্গে। কিন্তু ওই স্বল্প কয়েকটি নাটকের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এমন সংবেদনশীল অভিনেতা কমই দেখেছি আমি। ওর সঙ্গে অভিনয় করার একটা বিরাট সুবিধা, ও সহ-অভিনেতাকে একেবারে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেত। একবার হুমায়ূন আহমেদের একটা ঈদের নাটকে আমি আর ফরীদি একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। আমি যথারীতি মামার চরিত্রে, আর ফরীদি আমাদের বাসার প্রাইভেট টিচার। নাটক চলাকালে একটা বিরতির সময় আমি ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ফরীদি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দুই কাঁধ টিপে দিচ্ছে। আমি কিছু বলার আগেই ও বলল, 'কাঁধ দুটো টেন্স হয়ে আছে। মনে হচ্ছে সংলাপ আয়ত্তে আসেনি, তাই না? ঘাড় আর কাঁধের টেনশন কমিয়ে লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করেন।' আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার টেনশন আমি বুঝছিলাম, কিন্তু ও বুঝল কী করে? সহ-অভিনেতাকে বোঝার এই যে চেষ্টা, তা আজকাল আর দেখাই যায় না বলতে গেলে। এই রকম আরও কত ছোটখাটো অভিজ্ঞতা আছে ফরীদির সঙ্গে, তার হিসাব রাখা ভার।
আজ এই বসন্তের সন্ধ্যায়, বাতাসের উদ্দামতায়, কত কিছু যে মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে, তার ইয়ত্তা নেই। কোথায় বসন্ত মনকে করে তুলবে হালকা, নির্ভার, তা নয়। বুঝতে পারি, দেশ থেকে এত দূরে আমি, তাই আরও বিচলিত আমার মন। তাই আজ এই বিক্ষিপ্ত মনের ধন্বন্তরী ওষুধ হিসেবে আমার একটি প্রিয় নাটকের এক সংলাপ দিয়ে শেষ করছি এই অকিঞ্চিৎকর কলাম। এটি উৎসর্গ করছি ফরীদিকে।
'... নেভ, নিভে যাও নিভু নিভু দীপ।
এ জীবন নিতান্ত এক চলমান ছায়া।
হতভাগ্য এক অভিনেতা রঙ্গমঞ্চে কিছুকাল লাফায় ঝাঁপায়,
তারপর আর শোনা যায় না সংবাদ।
এ হলো কাহিনী এক নির্বোধ কথিত
অলংকারে অনুপ্রাসে ঠাসা, ইতি তাৎপর্যবিহীন।'
(ম্যাকবেথ : উইলিয়াম শেকসপিয়ার। অনুবাদ : সৈয়দ শামসুল হক)
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
এই বসন্তের সূচনায় আমি দেশে নেই। দেশ থেকে দূরে, আবার খুব দূরেও নয়_ এমন একটি স্থানে আমি বসে, এক বহুতল ভবনের ছাদের ওপরে। এখানে মাথার ওপরে একটা ছোট ছাদ আছে বটে, কিন্তু চারদিকে কোনো দেয়াল নেই। অতএব দৃষ্টি অবারিত, যেদিকে তাকাই। একটু দূরে ছায়ার মতো কিছু পাহাড় দেখা যায়। সারাটা শহর সবুজে ঢাকা। যেন সবুজ জলের সমুদ্র চারদিকে। মনটা নানা কারণে ভালো নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে বিষয়গুলো মানুষকে বিচলিত করে সাধারণত, যেমন_ রোগ, জরা ইত্যাদি নিজের এবং আপনজনদের, সে তো আছেই। তার চেয়েও বড় কথা, একটা বয়সে পেঁৗছে এই বোধোদয় হওয়া যে, আমি নিজের ওপর কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে। এখন চাইলেই যথেচ্ছাচার করা সম্ভব নয় আর_ এটা গ্রহণ করা কারও পক্ষেই বোধহয় সহজ নয়। কিছুদিন আগেও ভাবতাম, আমার শরীর, মন আমারই তো! অতএব যা খুশি, যেমন খুশি আচরণ করা যায় এর সঙ্গে। আমাদের এক প্রখ্যাত কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার একসময় ঘন ঘন চেহারা বদল করতেন। কোনো সময় মাথা চেঁছে ফেলতেন, কোনো সময় চুল রাখতেন, কখনও আবার পরচুলাও পরতেন। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করত এমন ঘন ঘন চেহারা বদল কেন? তিনি মোক্ষম জবাব দিতেন, 'আরে ভাই, চেহারাটা তো আমারই। আমি তো অন্য কারও চেহারা নিয়ে স্বেচ্ছাচার করছি না?' তার এই বাক্যটি দারুণ লাগত আমার। আমি তাকে অনুসরণ এবং অনুকরণ করে অনেককে আমার নিজের সম্পর্কেও বলেছি এই ধরনের কথা। এখনও বলি। তবে জানি যে, সব ঠিক নেই। এই আমিই তো কত তরুণকে রবীন্দ্রনাথের গান উদ্ধৃত করে বলেছি, 'ওরে সাবধানী পথিক; বারেক পথ ভোল, পথ ভোল, পথ ভুলে মর ফিরে...।' আমার সবসময় মনে হয়েছে, সময় যত এগিয়ে চলেছে, আমরা যত আধুনিক হচ্ছি, ততই সীমিত হয়ে পড়ছি আমাদের চলায়, বলায়, চিন্তা-চেতনায়। বড় সাবধানে ফেলছি পা। সর্বদা আমাদের মনে শঙ্কা, জীবনের চলার পথে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ হারিয়ে ফেলছি যেন। যেন অন্য কেউ তা ছিনিয়ে নিচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। এক প্রায় অশল্গীল প্রতিযোগিতার আক্রমণে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি আমরা। কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে গিয়ে যে জীবনকেই হারিয়ে ফেলছি তা কি বুঝছি আমরা? এ রকম পরিস্থিতি থেকে মুক্তির একটি উপায় হতে পারে পথ ভুলে ঘুরে মরা হয়তোবা। কিন্তু আমি যদি পথ ভোলারও অধিকার হারিয়ে ফেলি, মন চায় না বলে নয়, শরীর পারে না বলে, তাহলে মানুষের আর উপায় কি থাকে কোনো?
আজ সন্ধ্যায় এই ছাদের ওপরে বসে দূর দিগন্তে অপসৃয়মান মেঘের ভেলা দেখছি। এই শহরের উজ্জ্বল আলো মেঘের তলদেশকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। হাওয়া বইছে হুহু করে। কেমন শীত শীত করছে এখানে, এই সবার মাথার ওপরে বসে। মনটাও হুহু করছে হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ইংরেজিতে একটা অভিব্যক্তি আছে ্তুৎবভষবপঃরাব ঃযড়ঁমযঃ্থ, বাংলায় একে কী বলব জানি না। হয়তো বলা যেতে পারে 'প্রতিবিম্বিত চিন্তা'। আজ এই ধরনের মন কেমন করা অনেক চিন্তা মাথায় ভিড় করে আসছে যেন। প্রতিবিম্বিত বললাম এই কারণে যে, চিন্তাগুলো আমার মৌলিক সৃষ্টি নয়। এগুলো আসলেই প্রতিবিম্বিত এবং সৃষ্ট পারিপাশর্ি্বক অবস্থার দ্বারা।
ফরীদি চলে গেল। আরও কিছুদিন থেকে গেলে পারত। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেল। আজ এই সুদূরে বসে ওর কথা মনে আসছে বড়। যদিও সাম্প্রতিককালে ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। আমাদের পথ চলছিল সমান্তরাল পথে। একসময় ওর সঙ্গে এক ধরনের বন্ধুতা হয়েছিল আমার। পরে আমার সন্তানদেরও। বাচ্চারা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বেশি ভালো বোঝে। ওরা বড় দুঃখ পেয়েছে। বিচলিত হয়েছে। আমি এই প্রস্থানকে দেখছি আমার মতো করে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, 'জীবন থেকে মৃত্যু একটা রূপান্তরই কেবল। এর বেশি কিছু নয়।' কবিগুরুর এই কথাটি অস্বীকার করে সাধ্য আছে কার? তবুও যে নতুন জীবনে ফরীদির প্রবেশ ঘটল সেখানে কাদের ও ওর অভিনয়শৈলী দিয়ে অমন আনন্দ দেবে, যেমন দিত আমাদের? কী বহুমাত্রিক ছিল ওর অভিনয়ের ক্ষমতা! অবলীলায় নিজেকে ভেঙেচুরে ফেলতে পারত ও। আবার নির্মাণ করতে পারত ভিন্ন ভিন্নভাবে, নতুন করে। ওর চলে যাওয়ার পর ইন্টারনেটে গিয়ে দেখলাম, কত লোক কত কথা বলছে ওকে নিয়ে। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে ফরীদি অনেক মানুষের জীবন স্পর্শ করেছিল। কেবল অভিনয় দিয়ে তো তা সম্ভব নয়? একসময়, আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে, আমরা খুব আড্ডা মারতাম সন্ধ্যাবেলায়। তখনও ও ফিল্মে তেমনভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েনি। অসাধারণ ক্ষমতা ছিল ওর গল্প করার। নিতান্ত সাধারণ বিষয় নিয়েও। রান্নাবাড়ার বিষয়েও ভীষণ আগ্রহ ছিল ফরীদির। এখানেও ওর অভিনয় প্রতিভার অবদান ছিল বলতেই হবে। ও অবলোকন করত নিবিড়ভাবে। একজন অভিনেতার যা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। ও বলত, 'জানেন, মাছ বড় শিষ্ট প্রাণী। তেল-মসলা মাখিয়ে চুলোয় চাপিয়ে দিন, দেখবেন একেবারে লক্ষ্মীর মতো শুয়ে থেকে সেদ্ধ হয়ে চলেছে। আর মাংস বড় বেয়াদব। সেদ্ধ হওয়ার আগে একাধিকবার উঠতে, বসতে চায়। তখন চামচ দিয়ে বসিয়ে দিয়ে ঢাকনা চাপা দিয়ে রাখুন, সিধে হয়ে যাবে।' ও অসাধারণ কৌতুক বলতে পারত। বলার সময় একেবারে নির্লিপ্ত থাকত। কিন্তু বলা হয়ে গেলে প্রাণ উজাড় করা এক হাসি দিত হা-হা করে।
আমি ফরীদি অভিনীত একাধিক মঞ্চনাটক দেখেছি। ওর প্রথম যে নাটকটি আমার মন কেড়ে নেয়, সেটি হলো 'ফণীমনসা'। অসাধারণ অভিনয় করেছিল ও। ঢাকা থিয়েটারের সে সময়ের প্রায় সব নাটকেই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ওর উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। তবে মঞ্চের সঙ্গে ওর সম্পর্কের একেবারে শেষদিকে ও ঢাকা থিয়েটারেরই নাটক বের্টল্ট ব্রেশ্টের ্তুঞযব জবংরংঃরনষব জরংব ড়ভ অৎঃঁৎড় টর্থ অবলম্বনে 'ধূর্ত উই' নাটকের নাম ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে ্তুংঃধমব ঢ়ৎবংবহপব্থ, সেটা ছিল ফরীদির পূর্ণমাত্রায়। মাঝারি আকারের একজন হালকা-পাতলা মানুষ, অথচ মঞ্চে যখন আবির্ভূত হতো, তখন একেবারে সবার নজর কেড়ে নিত ও। আমার খুব বেশি সুযোগ হয়নি ফরীদির সঙ্গে অভিনয়ের। সামান্য কয়েকটা টিভি নাটক করেছিলাম ওর সঙ্গে। কিন্তু ওই স্বল্প কয়েকটি নাটকের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এমন সংবেদনশীল অভিনেতা কমই দেখেছি আমি। ওর সঙ্গে অভিনয় করার একটা বিরাট সুবিধা, ও সহ-অভিনেতাকে একেবারে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেত। একবার হুমায়ূন আহমেদের একটা ঈদের নাটকে আমি আর ফরীদি একসঙ্গে কাজ করেছিলাম। আমি যথারীতি মামার চরিত্রে, আর ফরীদি আমাদের বাসার প্রাইভেট টিচার। নাটক চলাকালে একটা বিরতির সময় আমি ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ফরীদি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার দুই কাঁধ টিপে দিচ্ছে। আমি কিছু বলার আগেই ও বলল, 'কাঁধ দুটো টেন্স হয়ে আছে। মনে হচ্ছে সংলাপ আয়ত্তে আসেনি, তাই না? ঘাড় আর কাঁধের টেনশন কমিয়ে লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করেন।' আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমার টেনশন আমি বুঝছিলাম, কিন্তু ও বুঝল কী করে? সহ-অভিনেতাকে বোঝার এই যে চেষ্টা, তা আজকাল আর দেখাই যায় না বলতে গেলে। এই রকম আরও কত ছোটখাটো অভিজ্ঞতা আছে ফরীদির সঙ্গে, তার হিসাব রাখা ভার।
আজ এই বসন্তের সন্ধ্যায়, বাতাসের উদ্দামতায়, কত কিছু যে মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে, তার ইয়ত্তা নেই। কোথায় বসন্ত মনকে করে তুলবে হালকা, নির্ভার, তা নয়। বুঝতে পারি, দেশ থেকে এত দূরে আমি, তাই আরও বিচলিত আমার মন। তাই আজ এই বিক্ষিপ্ত মনের ধন্বন্তরী ওষুধ হিসেবে আমার একটি প্রিয় নাটকের এক সংলাপ দিয়ে শেষ করছি এই অকিঞ্চিৎকর কলাম। এটি উৎসর্গ করছি ফরীদিকে।
'... নেভ, নিভে যাও নিভু নিভু দীপ।
এ জীবন নিতান্ত এক চলমান ছায়া।
হতভাগ্য এক অভিনেতা রঙ্গমঞ্চে কিছুকাল লাফায় ঝাঁপায়,
তারপর আর শোনা যায় না সংবাদ।
এ হলো কাহিনী এক নির্বোধ কথিত
অলংকারে অনুপ্রাসে ঠাসা, ইতি তাৎপর্যবিহীন।'
(ম্যাকবেথ : উইলিয়াম শেকসপিয়ার। অনুবাদ : সৈয়দ শামসুল হক)
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments