ঐতিহ্য-জাহাজ ভাসানোর উৎসব

কদিন আগে ঘটল ঘটনাটা। জাহাজ ভাসানোর উৎসব। এ এক অন্য রকম দৃশ্য। ঘটনাটি ঘটেছিল ১২ অক্টোবর। কক্সবাজারের রামু উপজেলার বাঁকখালী নদীতে। মানুষের ঢল নেমেছিল যেন সেদিন। মহাধুমধাম আর আনন্দ-উল্লাসের ছিল না কোনো সীমা-পরিসীমা।


জাহাজ ভাসানো উৎসব উদ্যাপন কমিটির সভাপতি স্বপন বড়ুয়া জানান, উপজেলার হাইটুপি, মেরংলোয়া, পূর্ব মেরংলোয়া, হাজারীকুল, রাজারকুল, জাদীপাড়া, রাখাইনপাড়া, বড়ুয়াপাড়া, শ্রীকুল, ফতেখাঁরকুলসহ বিভিন্ন এলাকার অন্তত এক লাখ মানুষ এ উৎসবে যোগ দেয় এবং উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়।
এই বাঁকখালী নদীতে ভাসানো হয় নয়টি জাহাজ। দেখা গেছে, উৎসবকে কেন্দ্র করে উপজেলার ১৮টি বৌদ্ধপল্লিতে তিন মাস ধরে চলে অন্য রকম আনন্দ। ‘শুকনো ডালে ফুল ফুটিল, স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এল, কে কে যাবি আয় রে, বুদ্ধের মতো এমন দয়াল আর নাইরে’—এ রকম বৌদ্ধকীর্তন গেয়ে গ্রামের শিশু-কিশোর ও যুবকেরা ঢোল, কাঁসর, মন্দিরা, বাঁশিসহ নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে প্রতি রাতে বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে ওঠে। তারা এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি, এ-পাড়া থেকে ও-পাড়া প্রদক্ষিণ করে কাটিয়ে দেয় পুরো তিনটি মাস। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ‘প্রবারণা পূর্ণিমা’ উপলক্ষে বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসানো উৎসব ঘিরে চলে এই আনন্দ আয়োজন। পাড়ায়-পাড়ায় বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ।
বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা জানান, প্রতিবছর আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস বর্ষাব্রত পালনের শেষ দিনটি হচ্ছে প্রবারণা পূর্ণিমা। এই দিনে ধর্মীয় নানা আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের পাশাপাশি জাহাজ ভাসানো উৎসব চলে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গ্রামবাসীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে গ্রামের উৎসাহী তরুণ-যুবকেরা জাহাজ তৈরির উদ্যোগ নেয়। মূলত প্রতি রাতে জাহাজ তৈরির কাজ এবং অর্থ সংগ্রহকে ঘিরে গ্রামের শিশু-কিশোর, যুবকেরা অন্য রকম আনন্দে মেতে ওঠে। বাঁশ, বেত, কাঠ আর রঙিন কাগজ দিয়ে তৈরি হয় কারুকাজে ভরা দৃষ্টিনন্দন এই জাহাজ। ময়ূর, কবুতর, হাঁসসহ বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতির আদলে এই জাহাজ তৈরি হয়।
কথিত রয়েছে, বৈশালী রাজ্যে খারাপ দেবতার প্রভাবে অনাবৃষ্টি, খরা, দুর্ভিক্ষ মহামারি রূপ ধারণ করে। তখন মারা যাচ্ছিল মানুষ আর জীবজন্তু। তখন ভগবান বুদ্ধ বর্ষাবাস চলাকালে পার্শ্ববর্তী রাজগিরিতে অবস্থান করছিলেন। এই খবর শুনে বৈশালী রাজ গৌতম বুদ্ধকে দেশের মহামারি থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য নিমন্ত্রণ (ফাং) করলেন। বুদ্ধ ফাং গ্রহণ করে বৈশালী ও রাজগিরির মধ্যভাগে ৫০০ শিষ্য নিয়ে রাজ্যে গমন করে রত্ন সূত্র পাঠ করে খারাপ দেবতার প্রভাব থেকে রাজ্যকে রক্ষা করলেন। ফিরতি পথে যমুনা নদীতে পানির নিচে নাগ সর্প (দেবনাগ) গণ ৫০০টি দিব্য বিমান নৌকা তৈরি করে বুদ্ধ ও তাঁর ৫০০ শিষ্যকে নদী পার করে দেন। সেই দিনটিকে স্মরণ করে রাখতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন নৌকার জাহাজ ভাসিয়ে প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব পালন করে আসছে।
প্রবারণা পূর্ণিমার প্রথম দিন ছিল ১১ অক্টোবর। অন্যান্য এলাকার মতো কক্সবাজারেও বুদ্ধপূজা, অষ্টশীল ও পঞ্চশীল গ্রহণ, ধর্মীয় সভা, বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা ও হাজার প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। দ্বিতীয় দিন ১২ অক্টোবর বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসানো উৎসব পালন করা হয়।
বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সভাপতি পণ্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের জানান, প্রায় ২০০ বছর আগে মিয়ানমারের মুরহনঘা নামক এলাকার একটি নদীতে সংঘরাজ ম্রাজং ব্রান প্রথম এই জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করেন। সেখান থেকেই বাংলাদেশের রামুতে এই উৎসব হয়ে আসছে প্রায় শত বছর ধর। রামুর এই জাহাজ ভাসানোর উৎসব এখন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলায় পরিণত হয়। যেখানে সব সম্প্রদায়ের লাখো মানুষের মিলনমেলা বসে।
আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার
ranacox05@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.