ইতি-নেতি-দিন বদলের বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র হচ্ছে? by মাসুদা ভাট্টি
বিগত দশকে বাংলাদেশ এগিয়েছে এর আগের তিন দশকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ গতিতে। এই এগোনো অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক অগ্রগতির সূচকে। এমনকি জাতীয় প্রবৃদ্ধি তিন অঙ্ক পাড়ি দিয়েছে মাত্র এক দশকে। এর গুরুত্ব আসলে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী।
কারণ একাত্তর সালে স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে যে দেশটিকে আন্তর্জাতিকভাবে 'বাসকেট কেস' হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছিল বৃহৎ শক্তির দ্বারা, সেই দেশটিই মাত্র চার দশক পর এসে এ রকম উন্নতির মুখ দেখবে_সেটা কেউই আশা করেনি। যে কারণে গোল্ডম্যান স্যাকস কিংবা লেম্যান ব্রাদার্সের মতো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে তাদের কেস স্টাডি হিসেবে। বিশেষ করে একটি ক্ষুদ্র আয়তনের দেশ, জনসংখ্যাভারাক্রান্ত দেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ হয়েও বাংলাদেশ কী করে প্রায় দুই সংখ্যা ছুঁই ছুঁই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে যাচ্ছে তা খুঁজে বের করার জন্য আমার জানা অনেক গবেষকই কাজ করে চলেছেন। বেশ কিছুকাল বিদেশে কাটিয়ে যাঁরাই দেশে ফেরেন, তাঁদের মুখেও এ কথা প্রায়ই শোনা যায়, বাংলাদেশ বদলেছে, বদলে যাচ্ছে, নিঃসন্দেহে এই বদল ইতিবাচক। সে কারণেই শেখ হাসিনা যখন বিগত নির্বাচনে তাঁর দলীয় ইশতেহারকে দিন বদলের সনদ নাম দিয়েছিলেন, তখন অনেকেই, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম আশাবাদী হয়েছিল এবং তার ফলাফল বিগত নির্বাচনে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের বিজয় লাভ।
রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এর আগে একটি সরকার আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছিলাম, দীর্ঘ ২১ বছর রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামের পর প্রয়োজনীয়সংখ্যক আসন জিতে আরো কয়েকটি ছোটখাটো দলের সঙ্গে জোট গঠন করে আওয়ামী ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে। প্রথম দিকে সেই সরকারের কর্মকাণ্ড ও কর্মদক্ষতা এতটাই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় যে বাংলাদেশ দ্রুতই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও বিরোধী দলের অসহযোগিতা ও মারাত্মক বিরোধিতা সত্ত্বেও বেশ কিছু ইতিবাচক নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সক্ষম হয় তৎকালীন সরকার। কিন্তু বছর তিনেক যেতে না যেতেই ষড়যন্ত্রের জাল চারদিক থেকে সরকারকে ঘিরে ফেলেছিল। মিডিয়া-সন্ত্রাসের মতো শব্দ আমরা তখনই পেয়েছিলাম বরেণ্য কলামিস্টদের কাছ থেকে। মোট কথা, রাষ্ট্রের ভেতরকার শক্তিগুলো একাট্টা হয়েছিল এবং বাইরের শক্তির সঙ্গে তারা হাত মিলিয়েছিল চরম নিষ্ঠুরতায়। তাতে দেশের ক্ষতি কতটা হয়েছিল, সেদিকে কেউই দৃষ্টি দেননি। শেখ হাসিনা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে মুখের ওপর তেল-গ্যাস রপ্তানির বিপক্ষে কথা বলেছিলেন বলে আন্তর্জাতিকভাবেও তাঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। দেশের ভেতরকার সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে শেখ হাসিনাকেই আক্রমণ করা হয়েছিল তীব্রভাবে। দলীয় নেতাকর্মীরা এই আক্রমণের আগুনে ঘি ঢেলেছিলেন সন্দেহ নেই, তাদের কর্মতৎপরতা দিয়ে। আর সবচেয়ে বড় অসহযোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল প্রশাসন। মেয়াদ পূর্ণ করে ক্ষমতা ছাড়ার আগেই প্রশাসন হাত মিলিয়েছিল নতুন সরকারের জন্য। বলা বাহুল্য, সে সরকার আওয়ামী লীগের ছিল না।
পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বঙ্গবভন থেকে বেরোনোর আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে তিনি আর ক্ষমতায় আসছেন না। জনগণের কাছে সে বার্তাই পেঁৗছেছিল। তার পরের ঘটনাবলি তো আরো ভয়াবহ। কী ঘটেনি তখন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে? যদি ধরেও নেওয়া যায় যে আওয়ামী লীগ সরকারের অসংখ্য ত্রুটিবিচ্যুতি ছিল (অবশ্যই ছিল), কিন্তু তাই বলে ঢালাওভাবে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের যেভাবে এলাকাছাড়া করা হয়েছিল নির্বাচনের আগেই, তা বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনামলেও ঘটেনি। ২০০১ সালে নির্বাচনে জোট সরকার নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করার পর যে রক্তকাণ্ড এই দেশে ঘটেছে, তার নজিরও ইতিহাসে নেই। আজ যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করছেন জোট সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রীসহ প্রায় সবাই, তাঁদের কি সেদিনের কথা মনে আছে? আমরা জানি, ভোলায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন একুশে টিভিতে প্রচারিত হওয়ার আশঙ্কায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী স্বপ্রণোদিত হয়ে একুশে টিভির টেরেস্ট্রিয়াল লাইসেন্স বাতিলই কেবল নয়, সোনারগাঁও হোটেলের ছাদে থাকা স্যাটেলাইট সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল তাঁরই নির্দেশে। মোট কথা, যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে, তা পূর্ণতা লাভ করেছিল ২০০১-এর অক্টোবরে এবং ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত গোটা দেশ প্রত্যক্ষ করেছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কতটা ভয়ংকর হতে পারে। এই ষড়যন্ত্রী বা ষড়যন্ত্রের কুশীলবরা কি সমাজে পরিচিত নন? তাঁরা কি অজ্ঞাত? মোটেও নয়। বরং তাঁরা সবাই জনগণের চেনা মুখ এবং চেনা জন। তাহলে তাঁদের থামানো সম্ভব হয়নি কেন? এখানেই আসে ক্ষমতাসীন সরকারের দূরদৃষ্টির এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতার প্রশ্নটি।
এখানে আওয়ামী লীগ সরকার বলে কথা নয়, ১৯৯৮-৯৯ সালের সেই ষড়যন্ত্রের নিট ক্ষতি কেবল দল হিসেবে আওয়ামী লীগের হয়েছে তা বললে ভুল বলা হবে। ক্ষতি হয়েছে গোটা দেশের ও গোটা জাতির। আমরা দেখেছি, জঙ্গিবাদের ভয়াল থাবার নিচে চলে গেছে দেশ; সুশীল সমাজকে পদে পদে অগ্রাহ্য করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে, জেলে পোরা হয়েছে; দলীয় কর্মীদের হাতে জিম্মি হয়ে গিয়েছিল মানুষের জীবন, সম্পদ; আওয়ামী লীগ আমলে কিছু এলাকা সন্ত্রাসের জনপদ আখ্যা পেলেও জোট আমলে গোটা দেশ পরিণত হয়েছিল সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে; আর অর্থনীতি? দুর্নীতি কত প্রকার ও কী কী তা জাতি প্রত্যক্ষ করেছিল। আওয়ামী লীগ হতে পারে ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক শিকার, কিন্তু তার ব্যাপ্তি ছিল গোটা জনজীবনে এবং শেষ পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেনের অরাজনৈতিক সরকারও কি সেই ষড়যন্ত্রের নিট ফলাফলের আওতাধীন নয়? এ কথা কি অস্বীকার করা যাবে? যাহোক, এত কথা, এই পেছনে ফেরা এ কারণেই যে আবারও সেই ষড়যন্ত্র, আবারও সেই পরিচিত ষড়যন্ত্রীদের কর্মকাণ্ড লক্ষ করা যাচ্ছে এবং দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, সরকার আবারও এদের পথ করে দিচ্ছে নিজেরই অজান্তে বা অজ্ঞাতসারে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে আড়াই বছর হলো। একটি সরকারের পূর্ণ মেয়াদের অর্ধেকটা সময় কেটে গেছে। এখন সময় এসেছে এ সরকারের মূল্যায়নের এবং সামনের দিনগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের। বিগত দিনের যা কিছু ভুল, যা কিছু অস্পষ্টতা এখনই নিরসনের সময়_যাতে সামনের দিনগুলোতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তাই এখন সরকারের সমালোচনা কিংবা সরকারকে যে বা যারাই আঘাত করুক না কেন, তা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার মানসিকতা সরকারের এবং সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের থাকতে হবে। সমালোচনা মানে ষড়যন্ত্র নয়_এ কথা আমাদের বুঝতে হবে। আর এটাও বোঝার ক্ষমতা থাকতে হবে, সমালোচনা ও ষড়যন্ত্রের পার্থক্যটা আসলে কোথায়। দেশের ভেতর ও দেশের বাইরে কে কোন অবস্থান থেকে কিভাবে কাজ করছে, তা তীক্ষ্নভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর সবচেয়ে বড় যে প্রয়োজন আজকে বর্তমান সরকারের জন্য দেখা দিয়েছে তা হলো, সরকারের প্রচারণানীতিটি নির্ধারণ করা এবং তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো। যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে সরকারের নেতিবাচক কাজের ঢোল বাজছে আর ইতিবাচক কাজের কথা চাপা পড়ে থাকছে কোথায় কোন অন্তরালে। আগামী সপ্তাহে এ বিষয় নিয়ে লিখে দিন বদলের কথার নটে গাছটি মুড়ব, কথা দিচ্ছি।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com
No comments