ইতিউতি-তবু মুশকিল আসানের আশায় by আতাউস সামাদ
ভাগ্যিস, আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে সংবিধান আর মোটাসোটা আইনের বই পড়তে হয় না। ওসব বই প্রথম সংস্করণে যতই সাদাসিধে, হালকা-পাতলা ও ছিমছাম থাকুক না কেন, কালক্রমে সেগুলো বেশ মোটা ও ঘোরপ্যাঁচওয়ালা হয়ে যায়-নানা ব্যাখ্যা, বিধি আর সংশোধনী যোগ হওয়ার ফলে।
এমনকি যে সংবিধান নিয়ে এখন এত কথা তা ১৯৭২ সালে প্রণীত হওয়ার পর আকারে এতই শীর্ণ ছিল যে এখনকার ছেলেমেয়েরা ওটা দেখলে বিশ্বাসই করবে না যে এই আমাদের আদি সংবিধান। কিন্তু এখন আমরা ওগুলো পড়তে চাইলেও দুই-চার পৃষ্ঠার বেশি এগোতে পারি না। ফলে সংবিধান ও আইনের বই সাধারণ মানুষ পড়তে পারে না। তা ছাড়া যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ অক্ষর চেনেন না তাঁরা বই পড়তে চাইলেও তো তা পড়তে পারবেন না। ফলে সংবিধান, আইন, বিধি, মামলার রায়-এসব পড়ে দেওয়ার জন্য আছেন আইনজীবীরা, আর মাঝেমধ্যে বাধ্য হয়ে পড়েন জাতীয় সংসদের সদস্যরা। এখন এই আইনজীবী আর সংসদ সদস্যরা একমত হতে পারছেন না দেশে সংবিধান আছে কী নেই-এই প্রশ্নে। এই প্রশ্নটারও আবার সূক্ষ্ম ও জটিল রূপ আছে।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ 'অস্তিত্ব আছে কি নেই' এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর ন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএনএস) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় একটা সমাধান দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'বাংলাদেশে এখন সংবিধান নেই, এ দাবি ঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান কেউ বিলুপ্ত করে নাই অথবা বাতিল করে দেয় নাই। সংবিধান আছে তবে সুপ্রিম কোর্ট কয়েকটি সংবিধান সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেওয়ায় ওই রায়গুলির আলোকে বাতিল সংশোধনীগুলি বাদ দিয়ে সংবিধান নতুন করে ছাপতে হচ্ছে।' তবে অনেক আইন বিশেষজ্ঞ ও সংসদ সদস্য এ সম্পর্কে যা বলতে থাকলেন সেসবের পরিপ্রেক্ষিতে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মন্তব্য বড় বেশি সহজ-সরল এবং আংশিকভাবে সঠিক বলে মনে হলো। কারণ একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠল আদালতের রায় মানলেও সংবিধান বিষয়ে তা কার্যকর করার অধিকার কার-সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের নাকি জাতীয় সংসদের। এই প্রশ্নটিরও সুরাহা হতে না হতে দেখা দিল নতুন সমস্যা। কে করবেন আদালতের রায় বাস্তবায়ন-এই প্রশ্নের ফয়সালা হওয়ার আগেই আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে, মূলত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে যে রায়টি হয় সেটি বাস্তবায়ন করে, সংবিধানের ৫০০ কপি ছেপে ফেলল। এই নবমুদ্রিত সংস্করণ বাজারে পাওয়া যায় না। তবুও বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ারসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য এর কপি সংগ্রহ করে দাবি করলেন, আইন মন্ত্রণালয় নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সংবিধানে এমন কিছু ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা নাকি সংশ্লিষ্ট রায়ে নেই, আবার এমন কিছু বিলুপ্ত করেছে, যা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে করতে বলা হয়নি। বিষয়টা একটা কেলেঙ্কারির দিকেই যাচ্ছিল। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের কপাল ভালো বলতে হবে। কারণ সংবিধান নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আরো কিছু রায় দিলেন। যেমন-পঞ্চম সংশোধনীর ওপর তদানীন্তন আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় সম্পর্কে নতুন প্রধান বিচারপতির (তিনি অবশ্য সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে অ্যাটর্নি জেনারেল 'রিভিউ' দরখাস্ত করায় তার আলোকে আগের রায়ের কিছু বদলে গেল। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মূল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, অতএব তা বাতিল এই রায় দিয়ে আপিল বিভাগ জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখন থেকে বাতিল বলে ঘোষণা করলেন, কিন্তু একই সঙ্গে বললেন যে রাষ্ট্রীয় জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি'র আলোকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে দেশের দায়িত্ব দিয়ে আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন করা যেতে পারে। এ ছাড়া আলাদাভাবে সপ্তম সংশোধনীও অবৈধ বলে রায় দিলেন সুপ্রিম কোর্ট। এসবের ফলে সংবিধান ধোয়ামোছা করে আবারও ছাপতে হবে। এবার বোধ হয় সংস্কারের কাজে হাত লাগিয়ে দ্বিতীয়বার আঙুল না পুড়িয়ে আইন মন্ত্রণালয় দায়িত্বটা পার করে দেবে জাতীয় সংসদের ওপরে। সেখানে একটি বিশেষ কমিটি সংবিধান সংশোধন করার জন্য সুপারিশমালা তৈরি করছে।
এই পর্যায়ে একবারের জন্য ফিরে যাই সংবিধান আছে কী নেই প্রশ্নটির যে সূক্ষ্ম রূপের কথা উল্লেখ করেছিলাম তাতে। ওই সূক্ষ্ম প্রশ্নটি হলো, 'এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রায়োগিক রূপ কী?' অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের যে এতগুলো রায় তার সব ক'টির নির্দেশনা অনুযায়ী (আলোকে নয়, এ ক্ষেত্রে আলোটি বড়ই অস্বচ্ছ) সংবিধান সংশোধন সম্পন্ন না করে আদালতে বা জাতীয় সংসদে বা প্রয়োজনে অন্যত্র আইন হিসেবে প্রয়োগ করা বা উপস্থাপন করার মতো সংবিধানের কোনো সংস্করণের অস্তিত্ব আছে কি? তা থাকলে, দেখান তো সেটা? ওটা হাতে নিয়ে কাজ করি। জানি না এই পর্যায়ে এসে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সংবিধান সংশোধন সুপারিশ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির আহ্বায়ক ও সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, কমিটির উপ-আহ্বায়ক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অথবা সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এর কী উত্তর দেবেন। তবে শুনতে পাই যে সংসদীয় বিশেষ কমিটি (বিরোধী দল কর্তৃক বর্জিত) বাজেট পেশ হয়ে যাওয়ার পর সুবিধামতো সময়ে, মানে জুনের শেষে কী জুলাইয়ের শুরুতে তাঁদের সুপারিশমালা সংসদের কাছে পেশ করবেন। হয়তো তখন জানা যাবে বাজারে কিনতে পাওয়া যাওয়ার মতো সংবিধানের সংস্কার করা সংস্করণ কবে নাগাদ পাওয়া যাবে বা দুষ্ট লোকের মতে, অদূর-ভবিষ্যতে আদৌ পাওয়া যাবে কি না। তবে এসব প্রশ্ন আপাতত আমার মতো অলস ও নিষ্কর্মা ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে ঘুরছে।
এখন তো সবার মনে বিলিয়ন ডলার বা শত কোটি ডলারের প্রশ্নটি হলো, ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় দেশের দায়িত্ব নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে থাকবে কি না? সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি সাম্প্রতিক মন্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করলে বলতে হয়, 'না, তা থাকবে না।' এখানে স্মরণ করা যাক, শ্রী সেনগুপ্ত কী মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে আর ছাড়েন না। দেখলেন না, ইউনূস মিয়ারে' (নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস), ছাড়ছেন তারে!' তো এই দৃঢ়তম মুষ্টির অধিকারিণী ও এক কথার নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না, কারণ এটাই আদালতের রায়। তিনি বলেছেন, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে, তবে এটি পরিচালনা করবে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং ভোট প্রদান করা হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। তাঁর মতে, এতেই অবাধ, সুষ্ঠু ও কারচুপিহীন এবং ভোট ডাকাতি থেকে মুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত হবে। শেখ হাসিনা এ-ও বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট এতদিনকার (পনেরো বছর) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে বিধায় এর ব্যত্যয় হওয়ার উপায় নেই। তিনি নিজে আরো কিছুকাল এই ব্যবস্থা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন কয়েক সপ্তাহ আগেও, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দরুন তাঁকে অবস্থান পরিবর্তন করতে হলো।
তবে দেখা যাচ্ছে, বিষয়টা সহজ-সরল পথে নিষ্পত্তি হওয়ার নয়। দেশের প্রধান বিরোধী দল আগে থেকেই বলে আসছিল, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। আর সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে মানবে না, কারণ তাদের ভাষায় বিচারপতি হক আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি ন্যায়বিচার করেননি। বিচারপতি খায়রুল হক হাইকোর্ট বিভাগে থাকার সময়ে (২০০৯ সালে) প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান নিয়েছিলেন-আমার দেশ পত্রিকায় এ তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আরো কমে যায়। {উল্লেখযোগ্য যে, তথ্যটি প্রকাশ করার আগে আমার দেশ পত্রিকা তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিল। পত্রিকাটি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গেও এই প্রসঙ্গে কথা বলেছিল। তখন অথবা এখন পর্যন্ত (৩.৬.২০১১) কেউ বলেননি যে তথ্যটি সঠিক নয়।}
অবশেষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ওই ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে বিএনপি দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে আগামী রবিবার ৫ জুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবির পক্ষে প্রয়োজনে তারা এ রকম আরো কর্মসূচি দেবে বলে জানিয়েছে। শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এই সংবাদ প্রচার হয়েছিল তিনি নিজে ঘোষণা দেওয়ার আগের দিনই। তখনই অনেকে চিন্তিত হয়ে পড়েন যে আবার নতুন করে দেশে অচলাবস্থা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেবে। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এনডিপি ও আরো একটি দলের লাগাতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, সংসদ থেকে বিরোধীদলীয় সদস্যদের পদত্যাগ, একের পর এক হরতাল, ১৯৯৬ মধ্য-ফেব্রুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে সহিংসতা, নির্বাচনে অবিশ্বাস্য পরিমাণ ভোট পড়া হিসাব দেখানোতে এর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট, লাগাতার অবরোধ এবং অবশেষে ওই নির্বাচনের ভিত্তিতে গড়া ষষ্ঠ সংসদ মাত্র এক অধিবেশন বসে বিরোধী দলগুলোর দাবি মোতাবেক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা করে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী করে ভেঙে যাওয়া ও বিএনপি সরকারের পদত্যাগ-এসব কথা মনে পড়ে যায় তাঁদের। এ রকমভাবে চিন্তিত হয়েছেন এমন দুই-চারজন আওয়ামী লীগ সদস্যের সঙ্গে দেখাও হয়েছে আমার। এসব আশঙ্কা প্রায় অবিলম্বে খানিকটা সত্যে পরিণত হলো বিএনপি তাৎক্ষণিক হরতাল ঘোষণা করায়। এখন ভয়, হরতালের সময় হাঙ্গামা হতে পারে, আর তাতে বিএনপির লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রতিবাদে আবারও হরতাল ডাকতে পারে দলটি। এই করে যে সঙ্গে সঙ্গে ফল পাবে বিএনপি, এমন কথা কেউ বলতে পারে না, কিন্তু লেগে থাকলে একসময় কাজ হয়েও যেতে পারে। আন্দোলন করতে পারদর্শী বলে খ্যাত যে আওয়ামী লীগ, তাদেরও তো বহুবারই একেক দফায় বছর কয়েক ধরে আন্দোলন করতে হয়েছে বিভিন্ন দাবি আদায় করতে। সে তালিকা সবারই মনে আছে। এখন হয়তো বিএনপি তা থেকে পাঠ নিয়ে আন্দোলন করবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না ঘোষণা নিয়ে একটা সমালোচনা আছে। সেটি হলো, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে, তবে এতে বিচার বিভাগকে সংযুক্ত করা ঠিক হবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা তো রায়ের এই অংশটি আমলে নিচ্ছেন না। সমালোচকদের প্রশ্ন, 'আদালতের রায়ের এক ভাগ মানা হবে, কিন্তু অপর ভাগ মানা হবে না, তা কেন?' সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় সংসদ সদস্য মওদুদ আহমদ এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা আরো বেশ খানিক এগিয়ে দাবি করেছেন, 'সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের জন্য অনির্বাচিত বিচারকদের রায় মানা বাধ্যতামূলক নয়।'
এদিকে শান্তিকামী ও যুক্তিবাদী খ্যাতনামা প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সবার কাছে আবেদন করেছেন তাড়াহুড়ো না করতে। তিনি বলেছেন, আপিল বিভাগ যেন দ্রুতই তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গ লিখিত বিবরণটি প্রকাশ করে, যাতে তার পর্যালোচনার ভিত্তিতে রিভিউ পিটিশন করা যায়। এর ফলে হয়তো অবশেষে আদালতের এমন একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্ত পাওয়া যেতে পারে, যা দিয়ে বর্তমান উত্তেজনা প্রশমন হবে। এদিকে সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেছেন, তাদের শুধু হরতাল ডাকলে হবে না, আদালত ও সরকারের সিদ্ধান্তের সুস্পষ্ট বিকল্প প্রস্তাব দিতে হবে, না হলে মানুষ তাদের আন্দোলন সমর্থন করবে কেন?
এদিকে দৈনিক পত্রিকা যুগান্তর খবর দিয়েছে যে সংবিধানে না রাখলেও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোয় সরকারই জাতীয় সংসদে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যাতে আপাতত রাখা যায় তেমন আইন প্রস্তাব করবে। এও ভালো। যদি কাজ হয়। তবে আঁধারে ডোবার আগে মুশকিল আসানের আশা নিয়েই না হয় থাকলাম।
ছোট একটা ফুটনোট-মাত্র ক'দিন আগে ইলেকশন কমিশনাররা বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসতে আসতে ইলেকট্রনিক ভোটিং প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে এখন ওই লক্ষ্যে একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ 'অস্তিত্ব আছে কি নেই' এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর ন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএনএস) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় একটা সমাধান দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'বাংলাদেশে এখন সংবিধান নেই, এ দাবি ঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান কেউ বিলুপ্ত করে নাই অথবা বাতিল করে দেয় নাই। সংবিধান আছে তবে সুপ্রিম কোর্ট কয়েকটি সংবিধান সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেওয়ায় ওই রায়গুলির আলোকে বাতিল সংশোধনীগুলি বাদ দিয়ে সংবিধান নতুন করে ছাপতে হচ্ছে।' তবে অনেক আইন বিশেষজ্ঞ ও সংসদ সদস্য এ সম্পর্কে যা বলতে থাকলেন সেসবের পরিপ্রেক্ষিতে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মন্তব্য বড় বেশি সহজ-সরল এবং আংশিকভাবে সঠিক বলে মনে হলো। কারণ একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠল আদালতের রায় মানলেও সংবিধান বিষয়ে তা কার্যকর করার অধিকার কার-সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের নাকি জাতীয় সংসদের। এই প্রশ্নটিরও সুরাহা হতে না হতে দেখা দিল নতুন সমস্যা। কে করবেন আদালতের রায় বাস্তবায়ন-এই প্রশ্নের ফয়সালা হওয়ার আগেই আইন মন্ত্রণালয় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে, মূলত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে যে রায়টি হয় সেটি বাস্তবায়ন করে, সংবিধানের ৫০০ কপি ছেপে ফেলল। এই নবমুদ্রিত সংস্করণ বাজারে পাওয়া যায় না। তবুও বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ারসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য এর কপি সংগ্রহ করে দাবি করলেন, আইন মন্ত্রণালয় নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সংবিধানে এমন কিছু ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা নাকি সংশ্লিষ্ট রায়ে নেই, আবার এমন কিছু বিলুপ্ত করেছে, যা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে করতে বলা হয়নি। বিষয়টা একটা কেলেঙ্কারির দিকেই যাচ্ছিল। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের কপাল ভালো বলতে হবে। কারণ সংবিধান নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আরো কিছু রায় দিলেন। যেমন-পঞ্চম সংশোধনীর ওপর তদানীন্তন আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় সম্পর্কে নতুন প্রধান বিচারপতির (তিনি অবশ্য সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে অ্যাটর্নি জেনারেল 'রিভিউ' দরখাস্ত করায় তার আলোকে আগের রায়ের কিছু বদলে গেল। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী মূল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, অতএব তা বাতিল এই রায় দিয়ে আপিল বিভাগ জাতীয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখন থেকে বাতিল বলে ঘোষণা করলেন, কিন্তু একই সঙ্গে বললেন যে রাষ্ট্রীয় জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে 'ডকট্রিন অব নেসেসিটি'র আলোকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে দেশের দায়িত্ব দিয়ে আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন করা যেতে পারে। এ ছাড়া আলাদাভাবে সপ্তম সংশোধনীও অবৈধ বলে রায় দিলেন সুপ্রিম কোর্ট। এসবের ফলে সংবিধান ধোয়ামোছা করে আবারও ছাপতে হবে। এবার বোধ হয় সংস্কারের কাজে হাত লাগিয়ে দ্বিতীয়বার আঙুল না পুড়িয়ে আইন মন্ত্রণালয় দায়িত্বটা পার করে দেবে জাতীয় সংসদের ওপরে। সেখানে একটি বিশেষ কমিটি সংবিধান সংশোধন করার জন্য সুপারিশমালা তৈরি করছে।
এই পর্যায়ে একবারের জন্য ফিরে যাই সংবিধান আছে কী নেই প্রশ্নটির যে সূক্ষ্ম রূপের কথা উল্লেখ করেছিলাম তাতে। ওই সূক্ষ্ম প্রশ্নটি হলো, 'এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রায়োগিক রূপ কী?' অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের যে এতগুলো রায় তার সব ক'টির নির্দেশনা অনুযায়ী (আলোকে নয়, এ ক্ষেত্রে আলোটি বড়ই অস্বচ্ছ) সংবিধান সংশোধন সম্পন্ন না করে আদালতে বা জাতীয় সংসদে বা প্রয়োজনে অন্যত্র আইন হিসেবে প্রয়োগ করা বা উপস্থাপন করার মতো সংবিধানের কোনো সংস্করণের অস্তিত্ব আছে কি? তা থাকলে, দেখান তো সেটা? ওটা হাতে নিয়ে কাজ করি। জানি না এই পর্যায়ে এসে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সংবিধান সংশোধন সুপারিশ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির আহ্বায়ক ও সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, কমিটির উপ-আহ্বায়ক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অথবা সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এর কী উত্তর দেবেন। তবে শুনতে পাই যে সংসদীয় বিশেষ কমিটি (বিরোধী দল কর্তৃক বর্জিত) বাজেট পেশ হয়ে যাওয়ার পর সুবিধামতো সময়ে, মানে জুনের শেষে কী জুলাইয়ের শুরুতে তাঁদের সুপারিশমালা সংসদের কাছে পেশ করবেন। হয়তো তখন জানা যাবে বাজারে কিনতে পাওয়া যাওয়ার মতো সংবিধানের সংস্কার করা সংস্করণ কবে নাগাদ পাওয়া যাবে বা দুষ্ট লোকের মতে, অদূর-ভবিষ্যতে আদৌ পাওয়া যাবে কি না। তবে এসব প্রশ্ন আপাতত আমার মতো অলস ও নিষ্কর্মা ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে ঘুরছে।
এখন তো সবার মনে বিলিয়ন ডলার বা শত কোটি ডলারের প্রশ্নটি হলো, ভবিষ্যতে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় দেশের দায়িত্ব নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে থাকবে কি না? সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি সাম্প্রতিক মন্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করলে বলতে হয়, 'না, তা থাকবে না।' এখানে স্মরণ করা যাক, শ্রী সেনগুপ্ত কী মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে আর ছাড়েন না। দেখলেন না, ইউনূস মিয়ারে' (নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস), ছাড়ছেন তারে!' তো এই দৃঢ়তম মুষ্টির অধিকারিণী ও এক কথার নারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না, কারণ এটাই আদালতের রায়। তিনি বলেছেন, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে, তবে এটি পরিচালনা করবে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন এবং ভোট প্রদান করা হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে। তাঁর মতে, এতেই অবাধ, সুষ্ঠু ও কারচুপিহীন এবং ভোট ডাকাতি থেকে মুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত হবে। শেখ হাসিনা এ-ও বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট এতদিনকার (পনেরো বছর) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে বিধায় এর ব্যত্যয় হওয়ার উপায় নেই। তিনি নিজে আরো কিছুকাল এই ব্যবস্থা চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন কয়েক সপ্তাহ আগেও, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দরুন তাঁকে অবস্থান পরিবর্তন করতে হলো।
তবে দেখা যাচ্ছে, বিষয়টা সহজ-সরল পথে নিষ্পত্তি হওয়ার নয়। দেশের প্রধান বিরোধী দল আগে থেকেই বলে আসছিল, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। আর সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে মানবে না, কারণ তাদের ভাষায় বিচারপতি হক আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেছেন এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি ন্যায়বিচার করেননি। বিচারপতি খায়রুল হক হাইকোর্ট বিভাগে থাকার সময়ে (২০০৯ সালে) প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান নিয়েছিলেন-আমার দেশ পত্রিকায় এ তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আরো কমে যায়। {উল্লেখযোগ্য যে, তথ্যটি প্রকাশ করার আগে আমার দেশ পত্রিকা তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিল। পত্রিকাটি আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গেও এই প্রসঙ্গে কথা বলেছিল। তখন অথবা এখন পর্যন্ত (৩.৬.২০১১) কেউ বলেননি যে তথ্যটি সঠিক নয়।}
অবশেষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না এই মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ওই ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে বিএনপি দেশজুড়ে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে আগামী রবিবার ৫ জুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার দাবির পক্ষে প্রয়োজনে তারা এ রকম আরো কর্মসূচি দেবে বলে জানিয়েছে। শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এই সংবাদ প্রচার হয়েছিল তিনি নিজে ঘোষণা দেওয়ার আগের দিনই। তখনই অনেকে চিন্তিত হয়ে পড়েন যে আবার নতুন করে দেশে অচলাবস্থা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেবে। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সালের মার্চ পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, এনডিপি ও আরো একটি দলের লাগাতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, সংসদ থেকে বিরোধীদলীয় সদস্যদের পদত্যাগ, একের পর এক হরতাল, ১৯৯৬ মধ্য-ফেব্রুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে সহিংসতা, নির্বাচনে অবিশ্বাস্য পরিমাণ ভোট পড়া হিসাব দেখানোতে এর গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট, লাগাতার অবরোধ এবং অবশেষে ওই নির্বাচনের ভিত্তিতে গড়া ষষ্ঠ সংসদ মাত্র এক অধিবেশন বসে বিরোধী দলগুলোর দাবি মোতাবেক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা করে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী করে ভেঙে যাওয়া ও বিএনপি সরকারের পদত্যাগ-এসব কথা মনে পড়ে যায় তাঁদের। এ রকমভাবে চিন্তিত হয়েছেন এমন দুই-চারজন আওয়ামী লীগ সদস্যের সঙ্গে দেখাও হয়েছে আমার। এসব আশঙ্কা প্রায় অবিলম্বে খানিকটা সত্যে পরিণত হলো বিএনপি তাৎক্ষণিক হরতাল ঘোষণা করায়। এখন ভয়, হরতালের সময় হাঙ্গামা হতে পারে, আর তাতে বিএনপির লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রতিবাদে আবারও হরতাল ডাকতে পারে দলটি। এই করে যে সঙ্গে সঙ্গে ফল পাবে বিএনপি, এমন কথা কেউ বলতে পারে না, কিন্তু লেগে থাকলে একসময় কাজ হয়েও যেতে পারে। আন্দোলন করতে পারদর্শী বলে খ্যাত যে আওয়ামী লীগ, তাদেরও তো বহুবারই একেক দফায় বছর কয়েক ধরে আন্দোলন করতে হয়েছে বিভিন্ন দাবি আদায় করতে। সে তালিকা সবারই মনে আছে। এখন হয়তো বিএনপি তা থেকে পাঠ নিয়ে আন্দোলন করবে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না ঘোষণা নিয়ে একটা সমালোচনা আছে। সেটি হলো, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকতে পারে, তবে এতে বিচার বিভাগকে সংযুক্ত করা ঠিক হবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা তো রায়ের এই অংশটি আমলে নিচ্ছেন না। সমালোচকদের প্রশ্ন, 'আদালতের রায়ের এক ভাগ মানা হবে, কিন্তু অপর ভাগ মানা হবে না, তা কেন?' সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিএনপির জাতীয় সংসদ সদস্য মওদুদ আহমদ এবং সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা আরো বেশ খানিক এগিয়ে দাবি করেছেন, 'সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের জন্য অনির্বাচিত বিচারকদের রায় মানা বাধ্যতামূলক নয়।'
এদিকে শান্তিকামী ও যুক্তিবাদী খ্যাতনামা প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সবার কাছে আবেদন করেছেন তাড়াহুড়ো না করতে। তিনি বলেছেন, আপিল বিভাগ যেন দ্রুতই তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত রায়ের পূর্ণাঙ্গ লিখিত বিবরণটি প্রকাশ করে, যাতে তার পর্যালোচনার ভিত্তিতে রিভিউ পিটিশন করা যায়। এর ফলে হয়তো অবশেষে আদালতের এমন একটি পরিষ্কার সিদ্ধান্ত পাওয়া যেতে পারে, যা দিয়ে বর্তমান উত্তেজনা প্রশমন হবে। এদিকে সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেছেন, তাদের শুধু হরতাল ডাকলে হবে না, আদালত ও সরকারের সিদ্ধান্তের সুস্পষ্ট বিকল্প প্রস্তাব দিতে হবে, না হলে মানুষ তাদের আন্দোলন সমর্থন করবে কেন?
এদিকে দৈনিক পত্রিকা যুগান্তর খবর দিয়েছে যে সংবিধানে না রাখলেও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোয় সরকারই জাতীয় সংসদে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যাতে আপাতত রাখা যায় তেমন আইন প্রস্তাব করবে। এও ভালো। যদি কাজ হয়। তবে আঁধারে ডোবার আগে মুশকিল আসানের আশা নিয়েই না হয় থাকলাম।
ছোট একটা ফুটনোট-মাত্র ক'দিন আগে ইলেকশন কমিশনাররা বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসতে আসতে ইলেকট্রনিক ভোটিং প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে এখন ওই লক্ষ্যে একটা প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments