শান্তির নতুন মডেল-সমস্যার মূলে দৃষ্টি দিতে হবে
পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের নতুন ভূমিকার কথা এখন সর্বজনবিদিত। এখন শুধু জাতি বা রাষ্ট্রগুলোর বৃহত্তম ফোরামই নয় এটি_ বিশ্বের বিবদমান দেশ বা দেশগুলোর মধ্যে বিবদমান জাতিগুলোর মধ্যস্থতার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
বিগত কয়েক দশকে এ ভূমিকা শুধু সংহত হয়নি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মধ্যস্থতায় জাতিসংঘের ভূমিকাকে অবিকল্প হিসেবেও ভাবা হয়েছে। দেখা গেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত সদস্য দেশগুলোর পুনর্গঠনে জাতিসংঘের সমন্বিত শান্তিরক্ষী বাহিনী পুনর্গঠনের কাজ করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধরত অবস্থাতেও শান্তি স্থাপনের বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। একটি দেশের যুদ্ধরত জাতিগুলোর মধ্যেও শান্তি ও সৌহার্দ্য স্থাপনেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের এ কার্যক্রমে বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। নতুন প্রেক্ষাপটে এ ভূমিকা আরও অর্থবহ ও বিস্তৃত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। সকলেই স্বীকার করেন, শান্তি স্থাপনে শুধু নিরপেক্ষ সামরিক উপস্থিতি যথেষ্ট নয়, এমনকি শান্তি আলোচনার বেসামরিক উদ্যোগও অনেক সময় অপ্রতুল বলে বিবেচিত হয়। কেননা, অশান্তির প্রকাশ যুদ্ধ-বিবাদের মধ্য দিয়ে ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলোর উৎপত্তি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অবিচার, দুর্নীতি, বৈষম্য ও বঞ্চনা থেকে। ফলে শান্তি স্থাপনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতার ভূমিকাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে সমস্যার মূলে দৃষ্টি দিতে হবে। সমস্যার মূল কোথায়? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় ছয়টি পরস্পর সম্পর্কিত বিষয় রয়েছে সমস্যার মূলে। এ ছয়টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব শান্তির জন্য নতুন মডেল উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এ ছয়টি বিষয় হলো : ক্ষুধা ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্য দূরীকরণ, বঞ্চনার লাঘব, ঝরে পড়া মানুষদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা ও সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন। 'আন্তর্জাতিক বিরোধ নিরসনে শান্তিপূর্ণ মধ্যস্থতা' শীর্ষক প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ মডেল উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা যেমন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তেমনি এ মডেলের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের। এ ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য আছে, কিন্তু আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য থেকে উদ্ভূত দারিদ্র্য ও ক্ষুধা শুধু আমাদের সমস্যা নয়, বিশ্বের বহু দেশই এ সমস্যায় আকীর্ণ। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যুদ্ধরত বা যুদ্ধবিধ্বস্ত অধিকাংশ দেশেই মানুষের মধ্যে প্রবল বৈষম্যবোধ সক্রিয়। এমনকি যেখানে সন্ত্রাসবাদের প্রবল আধিপত্য সেখানেও একই অবস্থা। ফলে সন্ত্রাস ও অশান্তির বিরুদ্ধে সকল শক্তিতে একতাবদ্ধ হয়ে আজ দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বৈষম্য, অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে হবে। জগতের লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও ভাগ্যাগতদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ঝরে পড়া মানুষদের উন্নয়নের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে না পারলে তা একটি জাতিকে শুধু পেছনের দিকেই টানতে থাকবে। আর যদি বঞ্চিত মানুষকে মূলধারায় ফিরিয়ে এনে মানবসম্পদ উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করা যায় তবে তা একটি দেশের সার্বিক অগ্রগতির পথেই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করে শান্তির পথকে অবারিত করার এ ধারণা অবশ্যই প্রশংসনীয়। বিশ্ব নেতৃত্ব যদি বাংলাদেশের এ প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বিশ্বের শান্তি প্রক্রিয়াকে আরও গভীর, বিস্তারী ও ব্যাপক মর্যাদা দিতে পারেন, তবে তা হবে প্রকৃত আশার ঘটনা। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা বিশেষভাবে প্রত্যাশিত। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যাসংকুল দেশগুলোকেও উদ্যোগী হতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ বিশ্লেষণ বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করবে সন্দেহ নেই। সে অনুপ্রেরণা যদি এখানে ইতিবাচক উন্নয়নের ধারা তৈরি করে, তবে বাংলাদেশই হতে পারে বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলোর মডেল। সেদিকেই এখন আমাদের মনোযোগী হতে হবে।
No comments