গোধূলির ছায়াপথে-কিছুই বদলাতে পারব না by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
সৌদি আরবে আটজনের শিরশ্ছেদের পর অনুরোধ পাই, যেন কিছু লিখি। লিখে কিছু প্রশংসা, কিছু কড়ির অধিক কিছু ঘটেনি। ১৯৮১ সালে হজ করার সময় সামনেই শিরশ্ছেদ দেখেছি। খারাপ লেগেছে। গত পাঁচ বছরে ট্রিগার টিপে পাঁচ লাখ ইরাকির হত্যা টেলিভিশনেই প্রত্যক্ষ করেছি। প্রতিবাদে সৈয়দ আবুল মকসুদ সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরছেন, আমি টাই পরা ছেড়েছি। লিখে, তর্ক করে, প্রতিবাদ করে কিছুই বদলাতে পারিনি, পারব না।
এক কাজ করা যাক। পৃথিবীতে যত শয়তান আছে, সবগুলোকে এক জায়গায় করা যাক। এবার এদের শিরশ্ছেদ করা যায় কি-না। হজের সময় ছিলাম একা, শরীরে শক্তির অভাব ছিল না, শিরশ্ছেদের উদ্দেশ্যে শয়তানের জন্য কঙ্কর নিক্ষেপের মুহূর্তে পড়ে গেলাম ভারী মানুষের পায়ের নিচে। শরীরের শক্তি একত্র করে ঝাড়া দিয়ে উঠলাম এই প্রত্যয়ে যে এটাই শেষ যুদ্ধ, জয়ী হতেই হবে। ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, ওখান থেকেই শক্তি সঞ্চয় করি। রবিঠাকুর গেয়েছেন: ‘ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার’। দেশে দেশে আমাদের শিরশ্ছেদ হচ্ছে। যখন সুযোগ হবে, আমরাও তা-ই করব।
মেঘে মেঘে বেলা যায়। ফেলে আসা গ্রাম দেবীগঞ্জে। একটু শীত পড়ছে, কুয়াশায় ঢাকা কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত স্কুল। লাইনে দাঁড়িয়ে সুবিধাবঞ্চিত ৩০০ ছেলেমেয়ে, তাদের মায়েরা। উপহারসামগ্রী পেয়ে নির্মল হাসির সৌন্দর্যটুকু উপভোগের জন্যই ছুটে আসেন প্রতিবছর কানাডা থেকে মেহমানরা এত দূরত্বে। সুন্দর জনপদের একটি, ২০ হাজার মানুষের গ্রাম, এখন আড়াই লাখ। অচঞ্চল কাঞ্চনজঙ্ঘা, শীর্ণা করতোয়া বয়ে চলেছে। যেন এক্ষুনি শোনা যাবে প্রতাপের ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, দেবী চৌধুরানীর আবির্ভাব হবে এক্ষুনি।
অদূরে সীমান্ত। দেখতে পাই ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশ। ভাষ্যে: ফেলানী আমাদের কেউ নয়, যে ৫০ লাখ মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে রোজগার করে বাংলাদেশকে মানচিত্রে স্থান করে রেখেছেন, তাঁরাও কেউ নন। একজনের মৃত্যুর জন্য আটজন কেন, আরও লোককে মেরে ফেললেও ‘কোই পরোয়া নেই’। এ পর্যন্ত যারা সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে, তাদের জন্য কোথাও কোনো মিনার হয়েছে কি? হয়নি। ওরা আমাদের কেউ নয়।
পথে হাজার মৃত্যু, গাড়ি-বাস-ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে। ইলিয়াস কাঞ্চন বললেন, আব্বাসী ভাই, আমার স্ত্রী বলে যায়: রাস্তার শিশুদের নিরাপত্তার জন্য বিসর্জিত হও, এটাই আমার শেষ চাওয়া। এই সহায়হীনতার কথা ভেবে আমার ঘুম হারাম হতো যদি মন্ত্রী হতাম, কর্মচারী হলেও তাই। অথচ দেখছি দিব্যি হেসেখেলে বাজার গরম করছে ওরা। যেন কিছুই হয়নি। তারেক-মিশুক বলে যাচ্ছেন আমাকে: এখানে কিছুই হবার নয়।
খবরের কাগজ পড়লে মন অশান্ত হয়।
ইরাকে গিয়েছি পাঁচবার। আরব দেশে আধুনিকতার স্পর্শ ওখানেই। সাদ্দামকে ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন দিতে হলো। লিবিয়ায় গিয়েছি গান-বাজনার দল নিয়ে, যেখানে যুদ্ধ শেষ হলো, মরুভূমিতে ১৫ দিন। সির্তে গাদ্দাফির ছোট ভাই তাঁবুর মধ্যে দলপতির সঙ্গে মোলাকাত করে বললেন: মরুভূমির দেশে নেই উচ্চচিন্তা, উচ্চনিচের ভেদাভেদ মানি না, যার যা প্রয়োজন মেটাবে রাষ্ট্র। গাদ্দাফির মৃত্যুদৃশ্যে নজরুলের গানটি মনে পড়ল: ‘চিরদিন কাহারও’...
দৃশ্যপট আলাদা। বসে আছেন নজরুল পানবাগানের বাসায়। খাটের নিচে প্রস্তুত সিঙ্গল রিড হারমোনিয়াম। হারমোনিয়ামটি বের করে এনে কোলের কাছে রেখে কবি গাইছেন: ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়, আজিকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়’। এমন সময় কমল দাসগুপ্তের প্রবেশ। বললেন,
: কাজীদা, তোমার গান ইঙ্গিতে কিছু বলে। এই হতভাগা ইঙ্গিতগুলো টের পায়। নজরুল বললেন,
: যারা রাজা থাকতে ইচ্ছুক, ভাবে চিরদিনই তো থাকব।
: ইংরেজদের রাজত্বে পড়েছে ভাটা। ওদের যাওয়ার সময় হয়ে এল। বাঙালি গাইছে অসহযোগের গান মিছিল করে।
: আজব শহর তোমাদের। একদিকে অসহযোগ, বিপ্লবী গান, অন্যদিকে দেখ চৌরঙ্গীজুড়ে হ্যাট-কোট-প্যান্ট পরা বাবু সাহেবরা রাজা-রানির জন্মদিনে কেমন উথলে উঠছে। দোকানে দোকানে লাল-নীল বাতির ফুলঝুরি...
: কাজীদা, বড় কবিরাও রানিকে খুশি করার জন্য গান লিখেছেন।
: গালিবের কথা বলছ? লিখেছেন সিপাহি যুদ্ধের অনবদ্য রোজনামচা ‘দাস্তাম্বু’, সেই কলমেই ইংল্যান্ডেশ্বরীর প্রশংসায় জরিন কলম। রাজকবি হলে গাইতেই হবে রাজার জয়গান।
: আমি ওড়াব না আমার কবির পতাকা, চিরকালের বিদ্রোহী যিনি? একদিনের জন্যও রাজার জয়গান তার কণ্ঠে নেই।
: দেখো কমল, রামচন্দ্রের গল্পেও বনবাস স্থান করে নিয়েছে। রাজারা যাতে বনবাসের আগাম প্রস্তুতি নেন, কারণ রাবণ যে মাথার ওপর, যার কারণে ললাটের লিখন অপনোদন করতে সক্ষম নন কেউ।
: পঞ্চপাণ্ডব সখা কৃষ্ণভগবান ও পরের অন্তরায় হরিশচন্দ্রের কথাও উল্লেখ করে ব্রিটিশের ললাটে আগুনের চিহ্ন বসিয়েছো, যা একমাত্র কমলের মতো লোক ছাড়া আবিষ্কার করার লোক কম। প্রতি গানে তোমার বাণী অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। এই ভবিষ্যদ্বাণী কি শুধু আজকের জন্য, নাকি অনাগতকালের জন্য?
: রাম-রাবণ থেকে কে আর শিক্ষা নিয়েছে কমল, ইতিহাস থেকেও কোনো দিন শিক্ষা নেয়নি মানুষ। জীবনভর দেখে চলেছি ভাঙা-গড়া, আর ললাটের লিখন। তাই গেয়েছি: চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। তোমাদের কবিও আজ রাজা, তো কাল পথের ভিখারি। কিছুই বদলাতে পারব না।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
মেঘে মেঘে বেলা যায়। ফেলে আসা গ্রাম দেবীগঞ্জে। একটু শীত পড়ছে, কুয়াশায় ঢাকা কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত স্কুল। লাইনে দাঁড়িয়ে সুবিধাবঞ্চিত ৩০০ ছেলেমেয়ে, তাদের মায়েরা। উপহারসামগ্রী পেয়ে নির্মল হাসির সৌন্দর্যটুকু উপভোগের জন্যই ছুটে আসেন প্রতিবছর কানাডা থেকে মেহমানরা এত দূরত্বে। সুন্দর জনপদের একটি, ২০ হাজার মানুষের গ্রাম, এখন আড়াই লাখ। অচঞ্চল কাঞ্চনজঙ্ঘা, শীর্ণা করতোয়া বয়ে চলেছে। যেন এক্ষুনি শোনা যাবে প্রতাপের ঘোড়ার খুরের আওয়াজ, দেবী চৌধুরানীর আবির্ভাব হবে এক্ষুনি।
অদূরে সীমান্ত। দেখতে পাই ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশ। ভাষ্যে: ফেলানী আমাদের কেউ নয়, যে ৫০ লাখ মানুষ মধ্যপ্রাচ্যে রোজগার করে বাংলাদেশকে মানচিত্রে স্থান করে রেখেছেন, তাঁরাও কেউ নন। একজনের মৃত্যুর জন্য আটজন কেন, আরও লোককে মেরে ফেললেও ‘কোই পরোয়া নেই’। এ পর্যন্ত যারা সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে, তাদের জন্য কোথাও কোনো মিনার হয়েছে কি? হয়নি। ওরা আমাদের কেউ নয়।
পথে হাজার মৃত্যু, গাড়ি-বাস-ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে। ইলিয়াস কাঞ্চন বললেন, আব্বাসী ভাই, আমার স্ত্রী বলে যায়: রাস্তার শিশুদের নিরাপত্তার জন্য বিসর্জিত হও, এটাই আমার শেষ চাওয়া। এই সহায়হীনতার কথা ভেবে আমার ঘুম হারাম হতো যদি মন্ত্রী হতাম, কর্মচারী হলেও তাই। অথচ দেখছি দিব্যি হেসেখেলে বাজার গরম করছে ওরা। যেন কিছুই হয়নি। তারেক-মিশুক বলে যাচ্ছেন আমাকে: এখানে কিছুই হবার নয়।
খবরের কাগজ পড়লে মন অশান্ত হয়।
ইরাকে গিয়েছি পাঁচবার। আরব দেশে আধুনিকতার স্পর্শ ওখানেই। সাদ্দামকে ফাঁসিকাষ্ঠে জীবন দিতে হলো। লিবিয়ায় গিয়েছি গান-বাজনার দল নিয়ে, যেখানে যুদ্ধ শেষ হলো, মরুভূমিতে ১৫ দিন। সির্তে গাদ্দাফির ছোট ভাই তাঁবুর মধ্যে দলপতির সঙ্গে মোলাকাত করে বললেন: মরুভূমির দেশে নেই উচ্চচিন্তা, উচ্চনিচের ভেদাভেদ মানি না, যার যা প্রয়োজন মেটাবে রাষ্ট্র। গাদ্দাফির মৃত্যুদৃশ্যে নজরুলের গানটি মনে পড়ল: ‘চিরদিন কাহারও’...
দৃশ্যপট আলাদা। বসে আছেন নজরুল পানবাগানের বাসায়। খাটের নিচে প্রস্তুত সিঙ্গল রিড হারমোনিয়াম। হারমোনিয়ামটি বের করে এনে কোলের কাছে রেখে কবি গাইছেন: ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়, আজিকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায়’। এমন সময় কমল দাসগুপ্তের প্রবেশ। বললেন,
: কাজীদা, তোমার গান ইঙ্গিতে কিছু বলে। এই হতভাগা ইঙ্গিতগুলো টের পায়। নজরুল বললেন,
: যারা রাজা থাকতে ইচ্ছুক, ভাবে চিরদিনই তো থাকব।
: ইংরেজদের রাজত্বে পড়েছে ভাটা। ওদের যাওয়ার সময় হয়ে এল। বাঙালি গাইছে অসহযোগের গান মিছিল করে।
: আজব শহর তোমাদের। একদিকে অসহযোগ, বিপ্লবী গান, অন্যদিকে দেখ চৌরঙ্গীজুড়ে হ্যাট-কোট-প্যান্ট পরা বাবু সাহেবরা রাজা-রানির জন্মদিনে কেমন উথলে উঠছে। দোকানে দোকানে লাল-নীল বাতির ফুলঝুরি...
: কাজীদা, বড় কবিরাও রানিকে খুশি করার জন্য গান লিখেছেন।
: গালিবের কথা বলছ? লিখেছেন সিপাহি যুদ্ধের অনবদ্য রোজনামচা ‘দাস্তাম্বু’, সেই কলমেই ইংল্যান্ডেশ্বরীর প্রশংসায় জরিন কলম। রাজকবি হলে গাইতেই হবে রাজার জয়গান।
: আমি ওড়াব না আমার কবির পতাকা, চিরকালের বিদ্রোহী যিনি? একদিনের জন্যও রাজার জয়গান তার কণ্ঠে নেই।
: দেখো কমল, রামচন্দ্রের গল্পেও বনবাস স্থান করে নিয়েছে। রাজারা যাতে বনবাসের আগাম প্রস্তুতি নেন, কারণ রাবণ যে মাথার ওপর, যার কারণে ললাটের লিখন অপনোদন করতে সক্ষম নন কেউ।
: পঞ্চপাণ্ডব সখা কৃষ্ণভগবান ও পরের অন্তরায় হরিশচন্দ্রের কথাও উল্লেখ করে ব্রিটিশের ললাটে আগুনের চিহ্ন বসিয়েছো, যা একমাত্র কমলের মতো লোক ছাড়া আবিষ্কার করার লোক কম। প্রতি গানে তোমার বাণী অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। এই ভবিষ্যদ্বাণী কি শুধু আজকের জন্য, নাকি অনাগতকালের জন্য?
: রাম-রাবণ থেকে কে আর শিক্ষা নিয়েছে কমল, ইতিহাস থেকেও কোনো দিন শিক্ষা নেয়নি মানুষ। জীবনভর দেখে চলেছি ভাঙা-গড়া, আর ললাটের লিখন। তাই গেয়েছি: চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। তোমাদের কবিও আজ রাজা, তো কাল পথের ভিখারি। কিছুই বদলাতে পারব না।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব
mabbasi@dhaka.net
No comments