সরল গরল-নির্বাচনের আগেই নানা অঘটন by মিজানুর রহমান খান

শহরের প্রাণকেন্দ্রে নারায়ণগঞ্জ ক্লাব। গত শনিবারের কথা। একটি টেবিলে মুখোমুখি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক সাবেক কর্মকর্তা। তাঁর কথায়, ‘চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে নেত্রীকে বলেছিলাম, যদি আমরা হারি, তাহলে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে। জয়ী হলে দুই লাখের ব্যবধানে।’ রহস্যটা তিনিই ভাঙলেন।


মহিউদ্দিন সাহেবের নিজের ধারণা ছিল, তিনি দুই লাখ ভোটের ব্যবধানে জিতবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে ওই কর্মকর্তা ধারণা দিয়েছিলেন তিনি এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হারতে পারেন। যে তথ্যটি তিনি প্রকাশ করলেন, সেটি সত্য হলে শঙ্কা ও আশা দুটোই তৈরি হয়। তিনি বললেন, ভোট গণনার একপর্যায়ে কর্মকর্তারা যখন দেখছিলেন যে মহিউদ্দিন সাহেব হারতে চলেছেন, তখন ভোট গণনা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ওপরের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন ভোট গণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু নেত্রী সুষ্ঠু ফলাফল ঘোষণায় দ্রুত সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন।
নারায়ণগঞ্জে তাঁর ধারণা, শহর এলাকায় আইভীর অনুকূলে হাওয়া জোরালো, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে হাওয়া শামীম ওসমানের দিকেই। সব মিলিয়েই তাঁর আশাবাদ, আইভী জিততে পারবেন না।

২.
বৃহস্পতিবারের অপরাহ্নে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম শ্রীশ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ জিউর আখড়ায়। যেসব ভক্ত দুপুরের খাবার গ্রহণের জন্য ওপরে উঠছিলেন, এক যুবক তাঁদের হাতে লিফলেট ধরিয়ে দিচ্ছিল। লিফলেটে আইভীর ছবি। আমি গাড়ি থেকে নামতেই যুবকটি আমাকে দেখে ফেলে। আর অমনি লিফলেটগুলো পকেটে ঢুকিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। তার সন্ত্রস্ত ভাব ছিল দেখার মতো। যেন সে পারলে ভোঁ দৌড় দিয়ে নিমেষে পালায়। এর কারণ, একজন নির্বাচন কর্মকর্তার ভাষায়, ‘এর দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, ওই লিফলেট বিতরণ কোনো অন্যায় ছিল না। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, নির্বাচনী আচরণবিধির কোনটা লঙ্ঘন আর কোনটা লঙ্ঘন নয়, সে বিষয়ে নির্বাচনী প্রচারকাজে নিয়োজিত নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভালো ধারণা নেই। অনেকেই ন্যায়-অন্যায়ের তফাত বুঝতে নির্বাচন দপ্তরে সশরীরে হাজির হচ্ছেন। এমন হতে পারে, ছেলেটি হয়তো নির্বাচন কমিশনের ভ্রাম্যমাণ কোনো টিমের সদস্য ভেবেছে আপনাকে। অনেক জায়গায় আমরা পুলিশ ছাড়াই হাজির হয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। ছেলেটি হয়তো ভেবেছে, মন্দির চত্বরে তার লিফলেট বিতরণ সংগত ছিল না।’ আর দ্বিতীয় কারণ কর্মকর্তাটি মুখ ফুটে বলেনওনি। তবে ইঙ্গিত করেন যে, ছেলেটি হয়তো আপনাকে শক্ত প্রতিপক্ষের লোক ভেবেছে।

৩.
কোনো সন্দেহ নেই, নির্বাচনী প্রচারসংক্রান্ত পরিবেশের বিরাট উন্নতি ঘটেছে। দেয়াললিখন ও রঙিন পোস্টার নেই। তৈমুরের আনারস মার্কার বড় আকৃতির একটি পোস্টার ও চারটি তাজা আনারস কোথাও ঝুলছিল। এর ভিডিও ধারণ করে ওসি তার সিডি জমা দিয়েছেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের স্বচ্ছ হওয়ার আগ্রহ। এই সেদিনও কোনো সরকারি ফাইলের নথিপত্র জনগণের ছুঁয়ে দেখারও সুযোগ ছিল না। নিষিদ্ধ ও গোপনীয় বস্তু কিংবা যক্ষের ধন বিবেচনায় তাঁরা লাল ফিতা দিয়ে বাঁধা ফাইল আগলে রাখতেন। এবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টির বাইরে তা ধরতে পেরেছিলাম।
নারায়ণগঞ্জের প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান। ১৯৮৪ সালে মংলা পোর্টে চাকরি শুরু করেন। ৮৬ সালে নির্বাচন কমিশনে যোগ দেন। এর পর থেকে তিনি নির্বাচন অন্তঃপ্রাণ, বর্তমানে যুগ্ম সচিব। এর আগে তিনি খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের (২০০৫ সালের) সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। তুলনামূলক বিচারে তিনি নারায়ণগঞ্জে কোনো বাড়তি চ্যালেঞ্জ অনুভব করছেন না। লিখিত অভিযোগের শীর্ষে পোস্টার ছেঁড়া।

৪.
যে ডিসির উপস্থিতিতে কবরীকে শামীম ওসমান অপমান করেছিলেন, তিনি প্রশিক্ষণে। ভারপ্রাপ্ত ডিসি দায়িত্বে। তদারককারী ২৪ কর্মকর্তার সবাই ইসির। তবে খাস সরকারি দৃশ্যপটে নেই বলা যাবে না। নির্বাহী হাকিমদের নিয়োগদাতা জেলা হাকিম, মানে ডিসি। পুলিশ সুপারসহ থানার ওসিদের বদলির দাবি করেছিলেন আইভী। কিন্তু লিখিত দেননি বলে ব্যবস্থা না নেওয়ার যুক্তি দিলেন লুৎফর রহমান। বেশি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন আইভী। এরপর আছেন তৈমুর। তিনি ২৬ অক্টোবর একসঙ্গে চারটি অভিযোগ দায়ের করেন। দুটিতে তিনি দুজন ওসিকে প্রত্যাহার করার দাবি তোলেন। সদর থানার ওসি আওয়ামী লীগের সাংসদের জামাতা, সিদ্ধিরগঞ্জের ওসি শুরু থেকেই শামীম ওসমানের পক্ষে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। অভিযোগ আসতে না আসতেই তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছেন প্রধান কর্মকর্তা। তাঁর সামনে গোটা তিনেক মোবাইল ফোন, একটি ল্যান্ডফোন, একটি ফ্যাক্স। কথা বলতেই পারছিলেন না। যন্ত্রগুলো ছিল সক্রিয়। বৃহস্পতিবার বিকেল না গড়াতেই দুই ওসিকে প্রত্যাহার করা হলো। কিন্তু শহরের অদূরে প্রতিমা ভাঙার বিষয়ে চার ঘণ্টার মধ্যে যে তদন্ত প্রতিবেদন আশা করা হয়, তা কয়েক দিনেও মেলেনি। সদর থানার ওসি বিদায়ের আগমুহূর্তে একটা দায়সারা সন্দেহজনক প্রতিবেদন জমা দিয়ে কেটে পড়েন।

৫.
ইভিএম নিয়ে দুই মেয়র পদপ্রার্থী লিখিত আপত্তি দিয়েছেন। তৈমুরের যুক্তিতে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত। তিনি একেবারেই প্রযুক্তিবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। আইভীর যুক্তি, এতে একজন ভোটার তিন মিনিট সময় নেবেন। যেসব ওয়ার্ডে তুলনামূলক কম ভোটার, সেসব স্থানে এটা চলুক। কিসের ভিত্তিতে নয়টি ওয়ার্ড বাছাই করা হলো, এর উত্তরে একজন কর্মকর্তা বললেন, সাবেক তিনটি পৌরসভা নিয়ে বর্তমান সিটি করপোরেশন নির্বাচন হচ্ছে। তাই প্রতিটি সাবেক পৌরসভা থেকে তিনটি করে ওয়ার্ড বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে গড়ে এক মিনিট লাগবে বলেও তিনি মত দেন।

৬.
লিখিত অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে শামীম ওসমান সবচেয়ে পিছিয়ে। তাঁর তরফে অভিযোগ গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে, প্রথম আলোর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছেন। শামীম ওসমানের নাম উল্লেখ না করে জনৈক আইনজীবীর দায়ের করা দুটি অভিযোগ দেখলাম। প্রথম আলো, চ্যানেল আই, এটিএন নিউজের নাম রয়েছে। একটি চিঠিতে তাঁর ভাই নাসিম অভিযোগ খণ্ডন করে লিখেছেন, ‘প্রথম আলো নারায়ণগঞ্জ তথা দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে চায়। এবং জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চায়।’
গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যেকোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ আইনানুগভাবে নিষ্পত্তি হওয়ার দাবি রাখে। প্রয়োজনে প্রথম আলোসহ যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠুক, তা নিষ্পত্তিতে প্রেস কাউন্সিলকে সম্পৃক্ত করা যায়।

৭.
গণমাধ্যমের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, সেটা বাংলাদেশে খুব বেশি মীমাংসিত বলা যায় না। তবে সব কাউন্সিলরকে একরকম বাদ দিয়ে গণমাধ্যম যেভাবে তিন মেয়র পদপ্রার্থীকে নিয়ে মাতামাতি করেছে, তা কিন্তু সংসদীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। ওপরে আমরা যেভাবে প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক, সেভাবে নিচে আমরা মেয়রকেন্দ্রিক অর্থাৎ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। এর মূল ব্যাধিটা সংবিধান ও আইনে থাকলেও গণমাধ্যমের ভূমিকা হওয়া উচিত এ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা। কাউন্সিলররা কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় মেয়রদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবেন, সে বিষয়ে আমরা কোনো টিভি বিতর্ক পাইনি। তবে যে অগ্রগতিটা ঘটেছে, তার অর্জন মোটেও কম নয়। সমির কর একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। তিনি বললেন, একটু আগে দেখলাম যে তিন প্রার্থী বলছেন, নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, সেটা তাঁরা মেনে নেবেন। এটা তো একসময় অবিশ্বাস্য ছিল। নারায়ণগঞ্জবাসী ১৮ বছর স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দেখেনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টিভি চ্যানেলগুলোর সরব ও জীবন্ত উপস্থিতি। আইভী-শামিম-তৈমুরের ত্রিমুখী লড়াই নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনী আমেজকে একটা অসাধারণ এবং অভূতপূর্ব মাত্রা দিয়েছে।
৮.
ওই কর্মকর্তা বলছিলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁরা বিরোধী দলকে দুভাবে বিজয় দিতে রাজি হননি। কারচুপি করলে শুধু ব্যক্তি মহিউদ্দিনের লাভ হতো, কিন্তু সরকার দুভাবে হারত। জনগণের কাছে ও বিরোধী দলের হাতে আন্দোলনের হাতিয়ার তুলে দিয়ে। আগামীকালের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য ‘মাগুরা’ হয় কি না, সেটা দেখার বিষয়।
পরিবেশ অনেক পরিচ্ছন্নই ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে সরকারের ‘না’ এক বিরাট বিস্ময়। ২৪ অক্টোবর আইভী লিখেছিলেন, নাসিক নির্বাচনে সেনাবাহিনীর গর্বিত সৈনিকেরা যাতে কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন, সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন প্রসঙ্গে। তাঁর কথায়, ‘জাতির গর্বের ধন সেনাবাহিনী নিয়োগের ঘোষণার মাধ্যমে ভোটারদের মন থেকে অনেকটা ভয়ভীতি কেটে গেছে।’
গতকাল এল এর উল্টো ঘোষণা। আমরা বিস্মিত, আমরা বেদনাহত, আমরা বিস্ময়ে বিমূঢ়। আইভী যদিও বলেছেন, ঠিক আছে, তাহলে সেনাবাহিনীর দরকার নেই। নারায়ণগঞ্জের জাগ্রত জনতাই তাঁর লক্ষ সেনাবাহিনী। কিন্তু তাঁর ২৪ অক্টোবরের চিঠির বক্তব্য অস্বীকার করা যায় না। ভোটারদের মনে ভয়ভীতি ফিরে আসাই স্বাভাবিক। আইভী ওই চিঠিতে লিখেছিলেন, নারায়ণগঞ্জের অতীত ইতিহাস খুবই ভয়াবহ। নির্বাচনকালে সন্ত্রাসীরা ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছে। তাই ভোটারদের নিরাপত্তার জন্য শুধু ভোটকেন্দ্রের বাইরে নয়, ভোটকেন্দ্রের ভেতরেও সেনা মোতায়েন করা হোক।
গতকালের ঘোষণার ফলে সংখ্যালঘুরা আরও ফাঁপড়ে পড়তে পারেন। কারণ বিশেষ মহল থেকে কেন্দ্রওয়ারি ভোট গুনে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এখন কানে বাজছে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে শোনা ওই কর্মকাতার তথ্যটি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গণনা স্থগিত করা হয়েছিল। তার মানে, এখনো আমাদের নির্বাচনী প্রশাসনযন্ত্রে এমন জাগ্রত অপদেবতা আছেন, যাঁরা এখনো মিডিয়া ক্যু সম্ভব করে তুলতে পারেন।
তাই বড় যন্ত্রণায় পড়লাম। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত। এতে বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ সেনা হয়তো অনিবার্য ছিল না, কিন্তু দেখা গেল শামীমই ‘দূরদর্শী’। অন্যান্য স্থানীয় পরিষদের নির্বাচন সেনা ছাড়াই সুষ্ঠু হয়েছে—এই তত্ত্ব তিনিই প্রথম দেন। চট্টগ্রামের নির্বাচনে ৭০২ সদস্যের সেনা স্ট্রাইকিং ফোর্স ছিল। এখন নজর রাখবো কখনো ফল ঘোষণা বন্ধ হয়ে যায় কি না। বন্ধ হলেও সবুজ সংকেত মেলে কি না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.