শেকড়ের ডাক-চিড়িয়াখানার নামে এসব কী হচ্ছে by ফরহাদ মাহমুদ
বাংলাদেশ আইন তৈরিতে যতটাই দক্ষ, আইন প্রয়োগে ততটাই অদক্ষ-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমনই একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। বাস্তব জীবনে প্রতিদিনই আমরা এই ধারণার সপক্ষে ভূরি ভূরি প্রমাণ পাচ্ছি, সত্যতা প্রত্যক্ষ করছি। সম্প্রতি এমনই একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে শ্রীমঙ্গলে।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধিত) আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী কোনো বন্য প্রাণী ধরা ও আটকে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইন প্রয়োগের প্রধান দায়িত্ব বন বিভাগের। অথচ শ্রীমঙ্গলে বন বিভাগের অফিসের কাছেই একটি বাড়িতে দুর্লভ কিছু প্রাণী কয়েক মাস ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশ থেকে অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে থাকা দুটি বনছাগল, একটি সাদা বাঘ, তিনটি লজ্জাবতী বানর, একটি চিতা বিড়াল, দুটি উল্লুক, দুটি ধনেশ, চারটি ট্রোগন, একটি অজগর, তিনটি পাম সিভেট, পাঁচটি পাহাড়ি ময়না, ছয়টি বনমোরগসহ অন্যান্য প্রাণী। এর মধ্যে বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা কিছু প্রাণীও রয়েছে। যেমন একটি ময়ূর, তিনটি উটপাখি, পাঁচটি ইমু পাখি। অবশেষে র্যাব ও বন বিভাগের যৌথ অভিযানে এগুলো ধরা পড়েছে। পরে এগুলোর কিছু লাউয়াছড়া জঙ্গলে, কিছু কঙ্বাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, বাড়ির মালিক আবদুল হান্নান ও আবদুল আহাদ ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা করার জন্য প্রাণীগুলো সংগ্রহ করেছিলেন। বলে রাখা ভালো, সারা দেশে এ ধরনের অনেক ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানা রয়েছে, যা আইন অনুযায়ী করা যায় না। এমনকি শ্রীমঙ্গল শহরেই জনৈক সীতেশ বাবুর বাড়িতে এ ধরনের আরেকটি চিড়িয়াখানা রয়েছে। রাজধানী ঢাকায়ও অনেক বাড়িতে বহুসংখ্যক বন্য প্রাণী দেখা যায়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বন বিভাগের এক সাবেক সিসিএফের বাসা থেকেও অবৈধভাবে রাখা অনেক বন্য প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছিল। অথচ আইনে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে, কোন ধরনের বা কি কি বন্য প্রাণী অনুমতিসাপেক্ষে বাড়িতে পালন করা যাবে।
নিয়ম অনুযায়ী, যদি কেউ বন্য প্রাণী লালন-পালন করতে চান তাহলে তাঁকে বন বিভাগের বন্য প্রাণী শাখায় আবেদন করতে হবে। বন্য প্রাণী শাখা দেখবে আবেদনকারী কতটুকু জায়গা দেবেন, তাতে কয়টি প্রাণী স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবে। সে অনুযায়ী তাঁকে সে কয়টি প্রাণী পালনের অনুমতি দেওয়া হবে। যেসব প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্তির পথে সেগুলোকে বাড়িতে পালনের অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আবার হিংস্র প্রাণীকেও বাড়িতে পালন করার অনুমতি দেওয়া হবে না। জানা যায়, একবার এক পীর সাহেব বন্য প্রাণী শাখায় বাঘ পালনের অনুমতি চেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, বন্য প্রাণী শাখা তাঁকে সেই অনুমতি দিতে পারেনি। অথচ অনেকের ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানায় এমন সব প্রাণী দেখা যায়, যেগুলো হিংস্র কিংবা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক পর্যায়ে চলে গেছে। প্রভাবশালী এসব ব্যক্তি বন্য প্রাণী শাখার অনুমতি নেওয়ার ধারই ধারেন না। আবার তথাকথিত এসব চিড়িয়াখানায় প্রাণীগুলোকে খাঁচার ভেতরে এমনভাবে রাখা হয় যে সেগুলো ঠিকমতো নড়াচড়াই করতে পারে না। তাদের যে খাবার দেওয়া হয়, তা-ও স্বাভাবিক কিংবা পর্যাপ্ত নয়। নিয়মানুযায়ী বন্য প্রাণী শাখার অনুমতি নিয়ে বাড়িতে বন্য প্রাণী পালন করলে ছয় মাস পরপর প্রাণীগুলোর সংখ্যা ও অবস্থা জানিয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। কারণ এর মধ্যে কোনো প্রাণী মারাও যেতে পারে, আবার প্রজনন করে সংখ্যাও বৃদ্ধি করতে পারে। বন্য প্রাণী শাখার লোকজন প্রয়োজনে সরজমিনে প্রাণীগুলোর অবস্থা দেখবেন। এই নিয়মগুলো ঠিকমতো পালন না করলে বন্য প্রাণী চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ বন্য প্রাণী চোরাচালানের আন্তর্জাতিক পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। বিভিন্ন সময় এ ধরনের বেশ কিছু বন্য প্রাণী আটকের ঘটনাও ঘটেছে। কিছুদিন আগেও এলিফ্যান্ট রোডের একটি বাড়ি থেকে বাঙ্বন্দি অবস্থায় বেশ কিছু বন্য প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছিল। এর আগে বাঙ্বন্দি জীবন্ত কুমিরও উদ্ধার করা হয়েছে। সাপ, পাখি ও অন্যান্য ছোট প্রাণী তো হরহামেশাই চোরাচালান হচ্ছে। কয়েক বছর আগে বিমানবন্দরে কয়েক হাজার পাখি আটক করা হয়েছিল। তাই সচেতন যেসব মানুষ বাড়িতে বন্য প্রাণী পালন করতে চান, চোরাচালানকে নিরুৎসাহী করার জন্য তাঁদের উচিত, অনুমতি নিয়ে এবং নিয়ম মেনে সেগুলো পালন করা। বন বিভাগকেও এ ব্যাপারে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।
শ্রীমঙ্গলে আবদুল হান্নানের বাড়ি থেকে যৌথ অভিযানের মাধ্যমে বন্য প্রাণীগুলো উদ্ধার করার জন্য বন বিভাগ ও র্যাব অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে তারা যদি এ ক্ষেত্রে আরো কিছুটা দায়িত্বশীল হতো, তাহলে এ দেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। যেমন বনছাগল বাংলাদেশে এখন নেই বললেই চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন বনে দু-একটি বনছাগল থাকলেও প্রাণী পর্যবেক্ষকদের চোখে সহসা পড়েছে বলে জানা যায় না। যদিও একটি পত্রিকায় কয়েক দিন আগে আ ন ম আমিনুর রহমানের লেখায় পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন বনে সামান্য কয়েকটি বনছাগল রয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু লেখাটির সঙ্গে যে ছাগলটির ছবি ছাপানো হয়েছে তা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অবস্থার ছবি বলে মনে হয় না। এ রকমই কোথাও আটকে রাখা বনছাগলের ছবির মতো মনে হয়। সিলেট অঞ্চলে বনছাগল দেখার সর্বশেষ রেকর্ড পাওয়া যায় আজ থেকে ৩৩ বছর আগে। এমনি দুটি বনছাগল আবদুল হান্নান কিভাবে এবং কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন, তা জানা প্রয়োজন ছিল। ময়ূর এখন বাংলাদেশে নেই। সেই ময়ূরই বা তিনি কিভাবে সংগ্রহ করলেন? উটপাখি বা ইমু এই মহাদেশেই নেই। সেগুলোই বা তিনি কিভাবে সংগ্রহ করলেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানাটা খুবই জরুরি। কারণ এর ভেতর দিয়ে বন্য প্রাণী পাচারকারী চক্রেরও হদিস পাওয়া যেতে পারত।
বন বিভাগকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। এমনিতেই তাদের লোকবল কম। বন পাহারা দেওয়া, নিয়মিত বৃক্ষ রোপণ ও কর্তনসহ তাদের নানা কাজ রয়েছে। বন বিভাগের জমি রক্ষা করাটাও একটি কঠিন কাজ হয়ে পড়েছে। কেবল শ্রীমঙ্গলেরই বনাঞ্চলগুলোর কয়েক হাজার একর বনভূমি এরই মধ্যে প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। তার মধ্যে বন্য প্রাণী সংরক্ষণে মনোযোগ দেওয়ার মতো সময় কোথায় তাদের? তদুপরি বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষিত জনবল থাকা প্রয়োজন, তা-ও তাদের নেই। কাজেই আইন আছে এবং থাকবে, কিন্তু আইনের সঠিক বাস্তবায়ন নেই এবং থাকবেও না-এটাই যেন বাস্তব সত্য। এদিকে বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন না থাকলেও সরকার নতুন করে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন, ২০১০-এর খসড়া তৈরি করেছে। প্রস্তাবিত এ আইনটি সম্পর্কে বন্য প্রাণীপ্রেমী ও সংরক্ষণকর্মীদের যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। তাঁরা খসড়াটি পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছেন। আসলে নতুন আইন করা যতটা না জরুরি, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হচ্ছে বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে বন বিভাগকে আরো সক্ষম এবং তৎপর করতে হবে। প্রয়োজনে আলাদা বন্য প্রাণী বিভাগ গঠন করা যেতে পারে। তারা দেশের বন্য প্রাণীর সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে একটি মহাপরিকল্পনা নেবে এবং সে অনুযায়ী বাংলাদেশে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের কাজ পরিচালনা করবে।
বাংলাদেশ একটি ছোট্ট ভূখণ্ড, কিন্তু এর রয়েছে বিশাল জনসংখ্যা। তাদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে বন ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। তদুপরি বনের চরিত্র পাল্টে দেওয়া এবং বনে ক্রমবর্ধমান হারে মানুষের উপস্থিতির কারণে বন্য প্রাণীরা কোণঠাসা হতে হতে হারিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার যদি বন্য প্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং কিছুটা হলেও আন্তরিক হয়-তাহলে অতি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে যে ক্ষতি হবে, তা কোনো দিনই পূরণ করা সম্ভব হবে না।
লেখার শেষে এ দেশের অন্যতম প্রাণিবিজ্ঞানী ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খানকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক, ২০১১ গ্রহণ করেছেন। তিনি দ্বিতীয় বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ, যিনি এই পদকে ভূষিত হলেন। তাঁর আগে গত বছর একই পদকে ভূষিত হন দেশের প্রবীণতম প্রাণিবিজ্ঞানী অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন। তাঁদেরই মতো কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষের প্রচেষ্টায় আজ আমরা স্বনামখ্যাত অনেক প্রাণিবিজ্ঞানীকে পেয়েছি। একই সঙ্গে বন্য প্রাণী সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়ায় এবং এ ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করায় সরকারকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা আশা করি, বন্য প্রাণী সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে বিলুপ্তির হাত থেকে আমাদের বনের অবশিষ্ট প্রাণিকুলকে রক্ষায় সরকার একইভাবে এগিয়ে আসবে।
লেখক : সাংবাদিক
No comments