অর্থনীতি-পুঁজিবাদবিরোধী প্রতিবাদ: কিছু প্রাথমিক মন্তব্য by এম এম আকাশ

পৃথিবী বদলে যাচ্ছে—একদম নতুন ধরনের ঘটনা ঘটছে পৃথিবীতে। তিউনিসিয়ায় একজন শিক্ষিত যুবক তার মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজের শরীরে আগুন জ্বেলে আত্মহত্যার পর সেই আগুন পুরো আরব বিশ্বে একের পর এক ছড়িয়ে পড়ল। অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে তা ছড়াল।


আবার একই সঙ্গে বিশ্বপুঁজিবাদের প্রাণভোমরা আমেরিকান ফিন্যান্স পুঁজির সিংহাসন দখলের জন্য শতাধিক নানা রকম আমেরিকান মানুষ (যাঁদের মধ্যে সাবেক বামপন্থী, কালো-সাদা, মানবাধিকারকর্মী, বেকার যুবকসহ গায়ক, বাদক—সবাই-ই আছেন!) স্লোগান তুললেন—‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’, আর সেই ডাক ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। পৃথিবীর ৯৫১টি শহরে (এমনকি আমাদের ঢাকায়ও!) হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ পথে নেমে ঘোষণা করলেন: পৃথিবীতে আজ যে ১ শতাংশ ক্ষমতাধর ধনী পুঁজিপতি রয়েছেন, তাঁদের ক্ষমতা ছাড়তে হবে। গণতন্ত্র হবে ৯৯ শতাংশের গণতন্ত্র! এর চেয়ে বিপ্লবী সহজ-সরল স্লোগান গত ১৫-২০ বছরে এই বিবর্ণ সংকটজর্জর পৃথিবীতে আর উঠে আসেনি! তাই চমকে ভাবতে বসেছি, একজন নিস্পৃহ সমাজবিজ্ঞানী এ সম্পর্কে প্রাথমিক কী কী পর্যবেক্ষণ পেশ করতে পারেন। সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে আমার এ সম্পর্কে মোট ১৬টি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে। পাঠকের সঙ্গে ‘শেয়ার’ করার জন্য নিচে এগুলো তুলে ধরছি।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষণগুলো
১. প্রতিবাদটি শুরু হয়েছিল বিশ্বপুঁজিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে। সেই কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আমেরিকার ‘ওয়াল স্ট্রিট’। প্রধান স্লোগান ছিল—‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’।
২. প্রধান ইস্যু ছিল তিনটি: বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতি, বৈষম্য ও বেকারত্ব। হয়তো এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওবামা প্রশাসনের লজ্জাকর দ্বিচারিতা: অপরাধী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে ‘বেইল আউট’ করে দরিদ্র নাগরিকদের সামাজিক ভোগ তহবিল সংকুচিত করার নীতিকৌশল।
৩. কোনো স্থায়ী সংগঠন বা বৃহৎ রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনকে সংগঠিত করেনি। এটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আত্মসংগঠিত একটি সামাজিক উদ্যোগ। এর জন্য ব্যবহূত হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরির কৌশল। এই সফল কৌশল এমন এক নতুন সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, যেখানে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন যে তিনিই এই আন্দোলনের কর্মী, তিনিই আবার এই আন্দোলনের জনক বা নেতা। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মতো: ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’।
৪. এ আন্দোলনটি হচ্ছে আগের অন্য সব বিপ্লবী আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের ভিন্নধর্মী একটি গণবিপ্লবী আন্দোলন। আগের সব বিপ্লবী আন্দোলন তৈরি হয়েছে অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশের বা প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশের ‘দুর্বল গ্রন্থিতে’ এবং তার নেতৃত্বে থেকেছে একটি ‘অগ্রগামী’ সংগঠিত রেজিমেন্টেড বাহিনী। এবার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। অগ্রগামী শ্রেণীর শ্রেণীসংগ্রাম নয়, নানা মানুষের মধ্যে যাঁরা ‘সমমতের অধিকারী’, তাঁদের একত্র বিদ্রোহই জন্ম দিয়েছে এই নতুন আন্দোলনের। আর আন্দোলনটি জন্ম নিয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে একই সঙ্গে প্রায় উন্নত পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশের শহরগুলোতে। আক্ষরিক অর্থেই এই গণ-আন্দোলনের মূল চরিত্র হচ্ছে—জনগণের জন্য, জনগণের এবং জনগণের দ্বারা।
৫. এই আন্দোলন অসম্ভব হতো যদি ওয়েবসাইট, ফেসবুক, মাইক্রো ব্লগিং, টুইটার ইত্যাদি আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধার সমর্থন অনুপস্থিত থাকত।
৬. এ আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে এর ‘নেতিবাচক’ চরিত্র। নিঃসন্দেহে এই আন্দোলন হচ্ছে প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদ। বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে একটি প্রতিবাদ বিন্দুতে এসে একত্র হয়েছেন। সে জন্য তাঁদের কোনো দীর্ঘমেয়াদি নিজস্ব যৌথ কর্মসূচি ছিল না। তাঁরা জানতেন যে তাঁরা পুঁজিবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে চান, কিন্তু কী দিয়ে—তা তাঁরা এখনো জানেন না। যেহেতু এই আন্দোলন এখনো স্বতঃস্ফূর্ত, অপরিকল্পিত, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-ক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসরমাণ—সেহেতু এর ভবিষ্যৎও ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত। যেকোনো শক্ত সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি এই আন্দোলনের ভেতর নোঙর ফেলে এর হালটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে একে অনাকাঙ্ক্ষিত পথে অগ্রসর করে নিতে পারে। তাই এই আন্দোলনের পরিণতি শুভও হতে পারে, অশুভও হতে পারে। অথবা আরও পেছনেও সমাজকে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি নিছক নৈরাজ্যেও পরিণত হতে পারে।
৭. প্রতিবাদটি ছিল আসলে আমেরিকান ফিন্যান্স পুঁজির প্রতীক ‘ওয়াল স্ট্রিটে’র বিরুদ্ধে। প্রতিবাদটি শুরু হয়েছিল প্রায় এক মাস আগে ১৭ সেপ্টেম্বর, যখন মাত্র ২০০ প্রতিবাদকারী ওয়াল স্ট্রিটের কাছে একটি পার্কে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন কর্তৃপক্ষ একে কোনো আমল দেয়নি। কিন্তু জেদি প্রতিবাদকারীরা দিনের পর দিন তাঁদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁদের সমর্থন বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষ আদেশ জারি করে যে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে তাঁদের সরে যেতে হবে। তাঁরা ভয় না পেয়ে থেকে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। নিপীড়ন ও গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা মেনে নিয়ে নৈতিক মানসিক বল নিয়ে অটল রইলেন। তখন কর্তৃপক্ষ অগত্যা পিছু হটতে বাধ্য হলো। কারণ আইন অনুযায়ী, তাঁদের সরানোর কোনো অধিকার রাষ্ট্রের নেই। এই ক্ষুদ্র বিজয়টি ইলেকট্রিক বার্তার মতো সারা পৃথিবীতে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করল, তারই পরিণতিতে এই ২০০ নাগরিক পৃথিবীব্যাপী ইতিহাসের স্রষ্টায় পরিণত হলেন।
৮. যেহেতু মূল প্রাথমিক স্লোগানটি ছিল ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল করো’, সেহেতু এটি কোনো সংকীর্ণ ইস্যুভিত্তিক সংগ্রাম ছিল না। এটি ছিল ক্ষমতাসীন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একটি বৈপ্লবিক সংগ্রাম। তাই একই ধারায় বৈপ্লবিক স্লোগানগুলো উঠেছে একটার পর একটা—‘দখল করো রোম’, ‘দখল করো টোকিও’, ‘দখল করো মাদ্রিদ’ ইত্যাদি। জনগণের কণ্ঠে এমন একটি মৌলিক প্রতীকী স্লোগান এর আগে শোনা যায়নি।
৯. সব সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী—আদিবাসী, নারী, কালো বর্ণের মানুষ, সমকামী বা উভয় লিঙ্গ মানুষ, যুদ্ধফেরত সাবেক সৈনিক, শান্তি-সংগ্রামী, হরেক রকমের লোক এতে এসে যোগ দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা অন্তর দিয়ে এ আন্দোলন সমর্থন করেছেন। তদুপরি শাসকশ্রেণীর অপেক্ষাকৃত সৎ ও অসন্তুষ্ট প্রতিনিধিরাও এই আন্দোলনের পক্ষে কোথাও কোথাও অবস্থান নিয়েছেন। সিডনির আন্দোলনে সেখানকার ব্যবসায়ী ইউনিয়ন যোগ দিয়েছে। তাইওয়ানের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী ‘সেমি কন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের’ সভাপতি স্বয়ং এই আন্দোলনের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। বড় বড় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন অঙ্গনের জাতীয় তারকারা এই আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন।
১০. প্রথম এই আন্দোলনের ডাকটা এসেছিল ‘১৫ অক্টোবর নেট’ নামক ওয়েবসাইট থেকে। কিন্তু বিশ্ব যেন তার সব আবেগ ও কল্পনাশক্তি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসেছিল এই ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য। এটি ছিল একটি সার্থক সময়োচিত আহ্বান। বাদক এবং বাদ্যযন্ত্র উভয়েই তৈরি ছিল পরস্পরকে সহযোগিতার জন্য। যদিও মনে রাখতে হবে, এখানে একই লোক একই সঙ্গে বাদক ও বাদ্যযন্ত্র উভয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন!
১১. এই সমগ্র আন্দোলনের একমাত্র ইতিবাচক সাধারণ স্লোগানটি হচ্ছে: জনগণের ক্ষমতায়ন চাই এবং চাই প্রকৃত গণতন্ত্র।
১২. আমরা জানি, সীমা অতিক্রম করলে পরম সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও হিংস্র হয়ে ওঠে। এখানেও তাই হয়েছিল। আমেরিকার ‘বোস্টন দখল করো’ মিছিল যখন ‘রোজ কেনেডি গ্রিনওয়ে’তে পৌঁছায়, ঠিক তখন বেলা দেড়টায় শত শত পুলিশ তাদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মোবাইল ক্যামেরা এবং ইউটিউবের বদৌলতে সেই হিংস্রতার চিত্র তখন বাংলাদেশেই আমরা ডেস্কটপে দেখতে পাচ্ছি এবং আমাদের মনেও ক্ষোভের আবেগ জমতে শুরু করেছে। দমন-পীড়ন তাই এই আন্দোলনের গতিবেগ স্তিমিত না করে আরও বাড়িয়ে এবং ছড়িয়ে দিচ্ছে।
১৩. এ ঘটনার পরই নিউইয়র্কের আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তাঁরা একটি ‘মিলিয়নেয়ার মার্চ’ বা ‘কোটিপতিদের বিরুদ্ধে মার্চের’ আয়োজন করবেন। প্রধানত এখন ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিকশ্রেণীর পরিবারগুলো এই সংগ্রামে এগিয়ে এসেছে।
১৪. আজ এ কথা প্রমাণিত যে যাঁরা গত অর্থনৈতিক সংকট থেকে ফায়দা লুটেছে, সেসব বড় বিনিয়োগ কোম্পানি ও ব্যাংককে টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তার কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে অঢেল ভর্তুকি প্রদান করেছে। সে জন্যই বর্তমান রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘাটতির মাত্রা দাঁড়িয়েছে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। বেচারা প্রেসিডেন্ট ওবামা ঘোষণা করেছেন, যেকোনোভাবেই হোক, প্রতিবছর তিনি চার ট্রিলিয়ন ডলার বাজেট ঘাটতি কমাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে? ওবামা যেটা করছেন তা হচ্ছে, ব্যাপকভাবে তিনি সরকারের শিক্ষাব্যয়, স্বাস্থ্যব্যয়, সামাজিক বিমা সমর্থনব্যয় ইত্যাদি খাতে বাজেট কমাচ্ছেন। আর এসব ব্যয়-সংকোচন প্রধানত আঘাত করছে আমেরিকার নিম্নবিত্ত জনগণকে। এ জায়গাতেই ধীরে ধীরে জমা হচ্ছে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ঢেউ।
১৫. এই নতুন সামাজিক আন্দোলনটি দেশে দেশে এখন পর্যন্ত সরকার, দাতা সংস্থা বা করপোরেশনের আর্থিক সমর্থন থেকে মুক্ত রয়েছে। যদিও একে ঘুষ দিয়ে নষ্ট করার জন্য অনেক শক্তিই এখন তৎপর হবে। নিপীড়ন একে দমন করতে না পারলেও প্রলোভন তা পারতেও পারে।
১৬. সামগ্রিকভাবে মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে হয়তো এক নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। হয়তো একেই ভবিষ্যতে বলা হবে ‘উত্তর-আধুনিক বিপ্লবের’ এক নতুন যুগ। যা-ই বা যে রকমই হোক না কেন, এ যুগের বিপ্লবের মর্মবাণী হবে সব ধরনের অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিরোধিতা। গণতন্ত্রের অর্থ অবশ্য এখানে আরও ব্যাপক হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক—সব ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রায়ণ হবে এ যুগের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.