আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-২৭)-এই দিনটি জীবনে ভুলব না by আলী যাকের
পড়াশোনার বাইরে মুকুল মেলার কাজ হয়ে দাঁড়াল আমার প্রধান কাজগুলোর একটি। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আমরা ধূপখোলা মাঠের পশ্চিম পাশে সুদৃশ্য একটি আমবাগানের মাঝের ছোট মাঠে জড়ো হতাম। সেখানে যেমন শরীরচর্চা হতো, তেমনি সপ্তাহে এক দিন উন্মুক্ত আকাশের নিচে বসে সাহিত্যচর্চাও হতো।
আমাদের প্রান্তিক মুকুল মেলার সভাপতি ছিলেন বজলে মওলা। তিনি ছিলেন একজন নিভৃতচারী চিত্রশিল্পী। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার অধিদপ্তরে কাজ করতেন। মওলা ভাই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নবপ্রজন্মের সেতুবন্ধ রচনায় তাঁর নিজের মতো করে এবং অতি সুচিন্তিতভাবে অবদান রাখতেন। সেই সময় প্রান্তিক মুকুল মেলায় মালেক ভাই বলে এক ব্রতচারী শিক্ষক আসতেন আমাদের ব্রতচারী নৃত্য এবং লাঠিখেলা শেখাতে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও পটুয়া কামরুল হাসান ধূপখোলা মাঠে প্রান্তিক মুকুল মেলার আমন্ত্রণে এসেছিলেন ব্রতচারী বিষয়ে আমাদের হাতে-কলমে শেখাতে। আজ আমার অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, পরবর্তীকালে আমি যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তার পেছনে আমার এসব শিক্ষকের অবদান ছিল অপরিসীম। এখানে একটি কথা বলা বোধ হয় প্রাসঙ্গিক হবে, আমাদের প্রজন্ম আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতি-উদ্ভূত আদর্শ, চেতনা ও মূল্যবোধে আকৃষ্ট হয়েছিল এ কারণে যে আমরা আমাদের জাতিসত্তার বিরুদ্ধাচরণকারী যে শক্তি, অর্থাৎ পাকিস্তানি পরাশক্তি, তাকে শুরু থেকেই চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। অর্থাৎ আমরা অতি অল্প বয়সেই জানতাম, কে আমাদের শত্রু এবং আমাদের মিত্রই বা কে। এই গোটা বিষয়টি আমাদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রমনা মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। মুকুল মেলার কাজকর্ম শুরু করার পর বেশ কিছু মানুষের সানি্নধ্য আমি পেয়েছিলাম, যাঁরা পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সাহিত্য এবং শিল্প-সংস্কৃতিতে অবদান রেখেছেন। এ ছাড়া পেয়েছিলাম কিছু বন্ধুবান্ধব, যাদের সাহচর্য আমাকে সর্বদাই আনন্দ দিত। একটি বিষয় আমি অবশ্যই স্বীকার করি, আমার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সম্যক ধ্যান-ধারণা হয়েছিল প্রান্তিক মুকুল মেলায় কাজ করার সময় থেকেই। ওই ক্ষুদ্র শিশু-কিশোর প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্বদান করার মধ্য দিয়েই পরবর্তীকালে যেকোনো কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বদান অনেকটা সহজতর হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। আমার আজও অনেক মধুর স্মৃতি মনে আছে মুকুল মেলাকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে ভ্রমণ ও বন্ধুজনের স্মৃতি, তেমনি আছে আমার প্রথম কবিতা লেখার স্মৃতি, 'প্রান্তিক' নামে দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের স্মৃতি এবং সর্বোপরি ব্রতচারী নৃত্যের স্মৃতি। আমরা সমস্বরে যখন গাইতাম, 'চল কোদাল চালাই ভুলে মানের বালাই/ঝেড়ে অলস মেজাজ হবে শরীর ঝালাই' অথবা কামরুল ভাই, কামরুল হাসান, আমাদের লাঠিখেলা শেখানোর সময় ছন্দে গাইতেন সাঁওতালি সুরে 'ঝা গিজির গিজ ঘিনিতা-তারিতা, গিজঘিনিতা', তখন দারুণ রোমাঞ্চে শরীর-মন উদ্বেলিত হয়ে যেত।
আমি যখন নটর ডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, দ্বিতীয় বর্ষে, হঠাৎ একদিন বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমার সেই বাল্যকাল থেকে দেখে আসছি, শেষ রাতের দিকে বাবার বুকে ব্যথা ওঠে। সেই ব্যথায় তিনি কোঁকাতেন। তাঁর এক প্রিয় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন, যাঁর ধারণা ছিল, এটা অম্বল অথবা গ্যাসের ব্যথা। আমাদের গেণ্ডারিয়াপাড়ার অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার ওয়াহিদ সাহেব অনেকবার বাবাকে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাবা যেতে রাজি হননি। কেন যেন ডাক্তারদের প্রচণ্ড ভয় পেতেন তিনি। যেদিন মারা যান, সেই দিনটি কোনো কারণে আমাদের কলেজ ছুটি ছিল। বাবা আমাদের বাসার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর একটা অভ্যাস ছিল, অফিসে যাওয়ার সময় যদি তাঁর সন্তানরা বাড়িতে থাকে, তারা যেন আশপাশেই থাকে। ওইদিন আমি একাই ছিলাম বাড়িতে। বাবা গাড়িতে গিয়ে বসলেন। গাড়ি চলে গেল। আমি সদর দরজা বন্ধ করলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাবা এবং তাঁর অফিসের আরো দু-একজনকে নিয়ে গাড়ি ফিরে এল বাড়িতে। সকালে আমার জীবিত বাবাকে আমি বিদায় জানিয়েছি। সেই বাবা ফিরে এলেন প্রাণহীন। ওই দিনটি জীবনে ভুলব না। সেটা ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬১। এ ঘটনাটি আমাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। আমার মনে হয়েছিল, আমি একটা মরুভূমির ওপর রৌদ্রতপ্ত দুপুরে বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং হঠাৎ করে বটগাছটি একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে পড়ে গেল। মাথার ওপর আর কোনো ছায়া রইল না। আমি তখন বালুকাবেলার ওপর দাঁড়িয়ে, একা, মাথার ওপর নিষ্করুণ সূর্য এবং আমার কোথাও যাওয়ার কোনো পথ নেই। বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুতে আমার মনে হয়েছিল, আমার বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ নেই। এই সময় বাবার স্মৃতি আমাকে রক্ষা করেছিল। যখনই তমসার অন্ধকারে ডুবন্ত আমি তীর খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখনই মনে পড়ত বাবার হাসিমাখা মুখটি। তিনি যেন স্নেহময় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, 'এত সহজেই হেরে যাবি? আমি তো হারিনি কোনো দিন?' বাবার এমন স্মৃতি আমাকে বাঁচিয়ে দিত। মনে হতো, কোনো কিছুই তো শেষ হয়ে যায়নি এখনো!
প্রসংগত, অনেক পরের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে করাচিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে শহরটি আমার বেশ ভালো লেগে যায়। অতএব, আমি বেশ কয়েক দিন সেখানে থাকি। শেষমেশ একটি চাকরিও পেয়েছিলাম করাচিতেই, যে চাকরির সুবাদে আমার আজকের পেশায় আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। এই চাকরি পাওয়ার আগেই আমার কয়েকজন বন্ধুর দুর্ব্যবহারে আমি ভীষণ আহত হয়েছিলাম। তখন ঢাকায় চাকরিরত আমার বড় ভাইকে আমি এ বিষয়ে লিখেছিলাম। আমার বড় ভাই এর জবাবে কোনো আপ্তবাক্য উচ্চারণ কিংবা প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি কেবল কয়েকটি সংকটময় পরিস্থিতিতে আমার বাবার কিছু বচন তাঁর চিঠিতে লিখে পাঠিয়েছিলেন। আমি সেই চিঠি পেয়ে শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদেছিলাম।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আমি যখন নটর ডেম কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, দ্বিতীয় বর্ষে, হঠাৎ একদিন বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমার সেই বাল্যকাল থেকে দেখে আসছি, শেষ রাতের দিকে বাবার বুকে ব্যথা ওঠে। সেই ব্যথায় তিনি কোঁকাতেন। তাঁর এক প্রিয় হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন, যাঁর ধারণা ছিল, এটা অম্বল অথবা গ্যাসের ব্যথা। আমাদের গেণ্ডারিয়াপাড়ার অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার ওয়াহিদ সাহেব অনেকবার বাবাকে একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাবা যেতে রাজি হননি। কেন যেন ডাক্তারদের প্রচণ্ড ভয় পেতেন তিনি। যেদিন মারা যান, সেই দিনটি কোনো কারণে আমাদের কলেজ ছুটি ছিল। বাবা আমাদের বাসার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর একটা অভ্যাস ছিল, অফিসে যাওয়ার সময় যদি তাঁর সন্তানরা বাড়িতে থাকে, তারা যেন আশপাশেই থাকে। ওইদিন আমি একাই ছিলাম বাড়িতে। বাবা গাড়িতে গিয়ে বসলেন। গাড়ি চলে গেল। আমি সদর দরজা বন্ধ করলাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাবা এবং তাঁর অফিসের আরো দু-একজনকে নিয়ে গাড়ি ফিরে এল বাড়িতে। সকালে আমার জীবিত বাবাকে আমি বিদায় জানিয়েছি। সেই বাবা ফিরে এলেন প্রাণহীন। ওই দিনটি জীবনে ভুলব না। সেটা ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৬১। এ ঘটনাটি আমাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। আমার মনে হয়েছিল, আমি একটা মরুভূমির ওপর রৌদ্রতপ্ত দুপুরে বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং হঠাৎ করে বটগাছটি একেবারে গোড়া থেকে উপড়ে পড়ে গেল। মাথার ওপর আর কোনো ছায়া রইল না। আমি তখন বালুকাবেলার ওপর দাঁড়িয়ে, একা, মাথার ওপর নিষ্করুণ সূর্য এবং আমার কোথাও যাওয়ার কোনো পথ নেই। বাবার এই আকস্মিক মৃত্যুতে আমার মনে হয়েছিল, আমার বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ নেই। এই সময় বাবার স্মৃতি আমাকে রক্ষা করেছিল। যখনই তমসার অন্ধকারে ডুবন্ত আমি তীর খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখনই মনে পড়ত বাবার হাসিমাখা মুখটি। তিনি যেন স্নেহময় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন, 'এত সহজেই হেরে যাবি? আমি তো হারিনি কোনো দিন?' বাবার এমন স্মৃতি আমাকে বাঁচিয়ে দিত। মনে হতো, কোনো কিছুই তো শেষ হয়ে যায়নি এখনো!
প্রসংগত, অনেক পরের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে করাচিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে শহরটি আমার বেশ ভালো লেগে যায়। অতএব, আমি বেশ কয়েক দিন সেখানে থাকি। শেষমেশ একটি চাকরিও পেয়েছিলাম করাচিতেই, যে চাকরির সুবাদে আমার আজকের পেশায় আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। এই চাকরি পাওয়ার আগেই আমার কয়েকজন বন্ধুর দুর্ব্যবহারে আমি ভীষণ আহত হয়েছিলাম। তখন ঢাকায় চাকরিরত আমার বড় ভাইকে আমি এ বিষয়ে লিখেছিলাম। আমার বড় ভাই এর জবাবে কোনো আপ্তবাক্য উচ্চারণ কিংবা প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি কেবল কয়েকটি সংকটময় পরিস্থিতিতে আমার বাবার কিছু বচন তাঁর চিঠিতে লিখে পাঠিয়েছিলেন। আমি সেই চিঠি পেয়ে শিশুর মতো হাউ হাউ করে কেঁদেছিলাম।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments