চালচিত্র-জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন এবং বাংলাদেশ by শুভ রহমান
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ফিরে ফিরে আলোচনায় আসে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেতিবাচকভাবে। অথচ বাংলাদেশের অনেক ইতিবাচক দিকও আছে, যেগুলো উপেক্ষিত থেকে যায় 'গৃহদাহ'-এর কারণে। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ছুটে যান 'গৃহদাহ'-এর বিষয়গুলো নিয়ে।
সব অর্জন তাঁরা বিসর্জন দেন হীন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। এই আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড দেশের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করলেও তাঁদের কোনো বোধোদয় ঘটে না! জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান এত কিছুর পরও শীর্ষে_এটি দেশ ও জাতির জন্য অনেক বড় গৌরবের বিষয়। বিশ্বের কয়েকটি দেশে নিয়োজিত শান্তিরক্ষী দলের উঁচু স্তরে, বিশেষ করে আইভরি কোস্টে বহুজাতিক শান্তিরক্ষীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশের এক সেনা কর্মকর্তা। বর্তমান বিশ্বের ১২টি দেশে ১৩টি শান্তিরক্ষা মিশনে ১০ হাজার ৭৩৪ জন বাংলাদেশি কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে সশস্ত্রবাহিনীর বেশ কয়েকজন নারী কর্মকর্তাসহ পুলিশের একটি বিশেষ দলও রয়েছে এবং সেসব দলের সদস্যরা অত্যন্ত সাফল্য ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় তাঁরা সাফল্যের মাধ্যমে দেশের জন্য শুধু সম্মান অর্জনই নয়, দেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়েও সহযোগিতা করছেন। সশস্ত্রবাহিনীর সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে প্রতিবছর গড়ে আয় হচ্ছে প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশের যানবাহন, অস্ত্র, গোলাবারুদ, যন্ত্রপাতি ও জনবল জাতিসংঘের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হওয়ায় ওই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ও সমস্যাকবলিত দেশগুলোর আস্থা, পাশাপাশি নির্ভরযোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে নিজ দেশের জন্য অপার সম্ভাবনার ক্ষেত্র যাঁরা প্রস্তুত করেছেন তাঁদেরকে অভিনন্দন এবং তাঁরা অবশ্যই আমাদের গর্বের ধন। আশার কথা, এই ক্ষেত্র বিস্তৃত করার আরো সুযোগ সামনে রয়েছে।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর কিছু বৈরী কর্মকাণ্ডের কারণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ক্ষেত্র সংকুচিত হতে পারে_এমন আভাস মিলেছিল এবং দেশের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গতিশীল ও কার্যকর করার তাগিদও এসেছিল নানা মহল থেকে। বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ তার সাংবিধানিক ও নৈতিক অঙ্গীকারের কারণে ১৯৮৮ সাল থেকে সামরিক পর্যবেক্ষণ মিশনে তালিকাভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে যে যাত্রা শুরু করেছিল, দিনে দিনে সে ক্ষেত্রে সফলতা অর্জিত হয়েছে এবং অবশ্যই এর জন্য শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরতদের সর্বাগ্রে সাধুবাদ জানাতে হয়। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সরকারও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। নিকট-অতীতে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, বাংলাদেশ বর্তমানে জাতিসংঘের যে কমিটি বা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে এর প্রায় সবই বর্তমান সরকারের মেয়াদে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিভিন্ন নির্বাচনেও ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে। যেমন ইউএন উইম্যানের নির্বাহী বোর্ডের নির্বাচনে বাংলাদেশ ৫৪টি ভোটের সবই পেয়েছে। সিডওতে বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে বেলজিয়ামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইসমাত জাহান নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন। আবার প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরও ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে আইটিইউর কাউন্সিলে বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ওই নির্বাচনে আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল টেলিযোগাযোগ খাতে শক্তিশালী দেশ থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, সৌদি আরব ও ফিলিপাইনকে পেছনে ফেলা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইউএনডিপি-ইউএনএফপিএ নির্বাহী বোর্ডের সহসভাপতি (২০১১-২০১৩) এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সহসভাপতি (২০১১) নির্বাচিত হয়েছে। বর্তমানে জাতিসংঘের ৩৫টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও কমিটিতে সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। একসঙ্গে এত আন্তর্জাতিক কমিটিতে বাংলাদেশ এর আগে কখনো দায়িত্ব পালন করেনি। সন্দেহ নেই, এ সবই হচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যের ফসল। দারিদ্র্যপীড়িত স্বল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ দায়িত্বশীলতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে_এটি অবশ্যই গর্বের। জাতিসংঘের কিছু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হচ্ছে বটে, কিন্তু তার পরও জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করার অবকাশ ক্ষীণ।
২৯ মে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা দিবস-২০১১ অন্যান্য দেশের মতো সংগত কারণেই গুরুত্ব এবং মর্যাদার সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে। আইনের শাসন সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। ওই দিন বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশি শহীদ শান্তিরক্ষী সদস্যদের নিকটাত্মীয় ও স্বজনদের সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। বিশ্ব শান্তিরক্ষায় ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইতিমধ্যে ১০৩ জন বাংলাদেশি শাহাদাতবরণ করেছেন। অবশ্যই গভীর শ্রদ্ধায় তাঁরা আমাদের কাছে সব সময় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং তাঁরা আমাদের বীর। বিদেশ-বিভুঁইয়ে নানা রকম পরিবেশে, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে শান্তি স্থাপনের কাজ শুধু কষ্টকরই নয়, ঝুঁকিপূর্ণও। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কর্মরত অনেক দেশের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব ব্যভিচারসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠলেও বাংলাদেশের সদস্যরা সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ইতিমধ্যে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছেন। বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যও শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছেন পেশাগত নৈপুণ্য প্রদর্শন করেই। অথচ দেশে পুলিশ বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের কর্মকাণ্ড নানাভাবে ব্যাপক সমালোচিত। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বহু দুষ্কর্মের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। এক একটি সরকার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে পুলিশকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে, তাদের অনৈতিক, অন্যায়, আইনবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের হোতা হয়ে উঠতে নিজেদের স্বার্থেই চুপ করে থেকেছে। নিয়োগ থেকে শুরু করে পোস্টিং সবই দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হয়ে থাকে। অথচ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশ সদস্যরা অন্য রকম ভূমিকা পালন করে সমাদৃত হচ্ছেন আন্তর্জাতিক মহলের কাছে। আরো প্রশংসনীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে কনভেনশনাল রীতিনীতির বাইরে সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষামূলক কর্মসূচি, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি কর্মসূচির বাস্তবায়নে সহায়তা দান।
ধারণা করা যায়, বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে ওইসব দেশে ইতিবাচক ধারণা জন্ম নেওয়ার কারণেই আফ্রিকায় জমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কৃষি উৎপাদনের দরজা অনেকটা প্রশস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধাপ্রাপ্তির নতুন নতুন পথেরও সন্ধান মিলছে। শান্তিরক্ষার মতো জটিল ও ব্যাপক কষ্টসহিষ্ণু কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে বাংলাদেশের সদস্যরা বিশ্ব দরবারে প্রমাণ করে দিয়েছেন, বাঙালি জাতি আত্মকলহপ্রবণ, অদক্ষ, অসামাজিক কিংবা স্বার্থবাদী নয়। যাঁরা এসবে গা ডুবিয়ে রেখেছেন তাঁদের অনেকেই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক, রাজনীতির নিয়ন্ত্রক, অর্থনীতির পরিচালক কিংবা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকলেও সে সংখ্যা অসংখ্য নয়। দেশের সাধারণ মানুষ, বিপুলসংখ্যক সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কিছুসংখ্যক রাজনীতিক এসব সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশেই নানা কারণে সংঘাত-রক্তপাত ঘটছে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এসব দেশের ভবিষ্যৎ চিত্র আরো কতটা উৎকট রূপ নেয় তা বলা যাচ্ছে না, যদিও এমন পরিস্থিতি প্রকট হয়ে উঠুক তা কাম্য নয়। কিন্তু যদি এমনটি হয়-ই তাহলে সেসব দেশেও শান্তিরক্ষায় জাতিসংঘকে দৃষ্টি দিতে হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপট তৈরি হলে শান্তি মিশনে জনবলের সংখ্যা স্বাভাবিক কারণেই বাড়াতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের আরো বড় সুযোগ আসার সম্ভাবনা ব্যাপক। আমাদের সমাজে যে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা দেখা যায় এর সমাধানে সংশ্লিষ্টরা জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত বাংলাদেশি সদস্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। একটি কথা তো সত্যি, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষতা, সততা, নির্মোহ থাকার পাশাপাশি আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা খুবই জরুরি। এ সব কিছুর সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতার পাঠ পোক্ত করার বিষয়টিও অতি জরুরি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যেসব বাংলাদেশি কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে মূল্যবোধের চর্চা থাকার কারণেই তাঁরা অন্যদের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন এবং শান্তিরক্ষী হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন, দেশের পতাকা শীর্ষে তুলে ধরতে পেরেছেন। শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ বাহিনী দেশে দেশে যে সম্পর্কের ভিত রচনা করেছে, তা কাজে লাগাতে আমাদের সরকারকে আরো দূরদর্শী হতে হবে, রাজনীতিকদের মন্দ চর্চা বন্ধ করতে হবে, দেশের রাজনীতির বিবর্ণ চেহারা পাল্টাতে হবে, নিজেদের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সম্পর্কে নালিশ বন্ধ করে অন্যদের সালিসে ডাকার আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের যবনিকাপাত ঘটাতে হবে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থানের সংবাদটি আমাদের জন্য অবশ্যই সুবার্তা।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর কিছু বৈরী কর্মকাণ্ডের কারণে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ক্ষেত্র সংকুচিত হতে পারে_এমন আভাস মিলেছিল এবং দেশের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গতিশীল ও কার্যকর করার তাগিদও এসেছিল নানা মহল থেকে। বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ তার সাংবিধানিক ও নৈতিক অঙ্গীকারের কারণে ১৯৮৮ সাল থেকে সামরিক পর্যবেক্ষণ মিশনে তালিকাভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে যে যাত্রা শুরু করেছিল, দিনে দিনে সে ক্ষেত্রে সফলতা অর্জিত হয়েছে এবং অবশ্যই এর জন্য শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরতদের সর্বাগ্রে সাধুবাদ জানাতে হয়। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সরকারও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। নিকট-অতীতে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, বাংলাদেশ বর্তমানে জাতিসংঘের যে কমিটি বা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে এর প্রায় সবই বর্তমান সরকারের মেয়াদে। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিভিন্ন নির্বাচনেও ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে। যেমন ইউএন উইম্যানের নির্বাহী বোর্ডের নির্বাচনে বাংলাদেশ ৫৪টি ভোটের সবই পেয়েছে। সিডওতে বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে বেলজিয়ামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইসমাত জাহান নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন। আবার প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরও ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে আইটিইউর কাউন্সিলে বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ওই নির্বাচনে আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল টেলিযোগাযোগ খাতে শক্তিশালী দেশ থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, সৌদি আরব ও ফিলিপাইনকে পেছনে ফেলা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইউএনডিপি-ইউএনএফপিএ নির্বাহী বোর্ডের সহসভাপতি (২০১১-২০১৩) এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের সহসভাপতি (২০১১) নির্বাচিত হয়েছে। বর্তমানে জাতিসংঘের ৩৫টি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও কমিটিতে সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। একসঙ্গে এত আন্তর্জাতিক কমিটিতে বাংলাদেশ এর আগে কখনো দায়িত্ব পালন করেনি। সন্দেহ নেই, এ সবই হচ্ছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যের ফসল। দারিদ্র্যপীড়িত স্বল্পোন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ দায়িত্বশীলতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে_এটি অবশ্যই গর্বের। জাতিসংঘের কিছু কর্মকাণ্ডের সমালোচনা হচ্ছে বটে, কিন্তু তার পরও জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করার অবকাশ ক্ষীণ।
২৯ মে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা দিবস-২০১১ অন্যান্য দেশের মতো সংগত কারণেই গুরুত্ব এবং মর্যাদার সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে। আইনের শাসন সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। ওই দিন বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশি শহীদ শান্তিরক্ষী সদস্যদের নিকটাত্মীয় ও স্বজনদের সংবর্ধনাও দেওয়া হয়। বিশ্ব শান্তিরক্ষায় ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইতিমধ্যে ১০৩ জন বাংলাদেশি শাহাদাতবরণ করেছেন। অবশ্যই গভীর শ্রদ্ধায় তাঁরা আমাদের কাছে সব সময় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং তাঁরা আমাদের বীর। বিদেশ-বিভুঁইয়ে নানা রকম পরিবেশে, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে শান্তি স্থাপনের কাজ শুধু কষ্টকরই নয়, ঝুঁকিপূর্ণও। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কর্মরত অনেক দেশের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব ব্যভিচারসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠলেও বাংলাদেশের সদস্যরা সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব উঠে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে ইতিমধ্যে ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছেন। বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যও শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছেন পেশাগত নৈপুণ্য প্রদর্শন করেই। অথচ দেশে পুলিশ বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের কর্মকাণ্ড নানাভাবে ব্যাপক সমালোচিত। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বহু দুষ্কর্মের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। এক একটি সরকার নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে পুলিশকে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে, তাদের অনৈতিক, অন্যায়, আইনবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের হোতা হয়ে উঠতে নিজেদের স্বার্থেই চুপ করে থেকেছে। নিয়োগ থেকে শুরু করে পোস্টিং সবই দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হয়ে থাকে। অথচ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে পুলিশ সদস্যরা অন্য রকম ভূমিকা পালন করে সমাদৃত হচ্ছেন আন্তর্জাতিক মহলের কাছে। আরো প্রশংসনীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে কনভেনশনাল রীতিনীতির বাইরে সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষামূলক কর্মসূচি, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি কর্মসূচির বাস্তবায়নে সহায়তা দান।
ধারণা করা যায়, বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে ওইসব দেশে ইতিবাচক ধারণা জন্ম নেওয়ার কারণেই আফ্রিকায় জমি লিজ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য কৃষি উৎপাদনের দরজা অনেকটা প্রশস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধাপ্রাপ্তির নতুন নতুন পথেরও সন্ধান মিলছে। শান্তিরক্ষার মতো জটিল ও ব্যাপক কষ্টসহিষ্ণু কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে বাংলাদেশের সদস্যরা বিশ্ব দরবারে প্রমাণ করে দিয়েছেন, বাঙালি জাতি আত্মকলহপ্রবণ, অদক্ষ, অসামাজিক কিংবা স্বার্থবাদী নয়। যাঁরা এসবে গা ডুবিয়ে রেখেছেন তাঁদের অনেকেই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক, রাজনীতির নিয়ন্ত্রক, অর্থনীতির পরিচালক কিংবা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকলেও সে সংখ্যা অসংখ্য নয়। দেশের সাধারণ মানুষ, বিপুলসংখ্যক সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কিছুসংখ্যক রাজনীতিক এসব সংকীর্ণতার ঊধর্ে্ব। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশেই নানা কারণে সংঘাত-রক্তপাত ঘটছে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এসব দেশের ভবিষ্যৎ চিত্র আরো কতটা উৎকট রূপ নেয় তা বলা যাচ্ছে না, যদিও এমন পরিস্থিতি প্রকট হয়ে উঠুক তা কাম্য নয়। কিন্তু যদি এমনটি হয়-ই তাহলে সেসব দেশেও শান্তিরক্ষায় জাতিসংঘকে দৃষ্টি দিতে হতে পারে। এমন প্রেক্ষাপট তৈরি হলে শান্তি মিশনে জনবলের সংখ্যা স্বাভাবিক কারণেই বাড়াতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের আরো বড় সুযোগ আসার সম্ভাবনা ব্যাপক। আমাদের সমাজে যে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা দেখা যায় এর সমাধানে সংশ্লিষ্টরা জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত বাংলাদেশি সদস্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। একটি কথা তো সত্যি, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষতা, সততা, নির্মোহ থাকার পাশাপাশি আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা খুবই জরুরি। এ সব কিছুর সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতার পাঠ পোক্ত করার বিষয়টিও অতি জরুরি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যেসব বাংলাদেশি কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে মূল্যবোধের চর্চা থাকার কারণেই তাঁরা অন্যদের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছেন এবং শান্তিরক্ষী হিসেবে প্রশংসা কুড়িয়েছেন, দেশের পতাকা শীর্ষে তুলে ধরতে পেরেছেন। শান্তিরক্ষী বাহিনী হিসেবে বাংলাদেশ বাহিনী দেশে দেশে যে সম্পর্কের ভিত রচনা করেছে, তা কাজে লাগাতে আমাদের সরকারকে আরো দূরদর্শী হতে হবে, রাজনীতিকদের মন্দ চর্চা বন্ধ করতে হবে, দেশের রাজনীতির বিবর্ণ চেহারা পাল্টাতে হবে, নিজেদের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সম্পর্কে নালিশ বন্ধ করে অন্যদের সালিসে ডাকার আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের যবনিকাপাত ঘটাতে হবে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থানের সংবাদটি আমাদের জন্য অবশ্যই সুবার্তা।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments