কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসের কথা by সৈয়দ শামছুল হুদা

দেশে বাংলা ভাষায় মান সম্পন্ন বিকল্প কিতাব রচিত হয়েছে। যেসব মাদ্রাসায় এগুলো চালু হয়েছে সেখানের ছাত্রদের মধ্যে একটু ভিন্ন ধরনের আমেজ লক্ষ্য করা যায়। এসো আরবি শিখি, এসো নাহু শিখি, এসো ছরফ শিখি, এসো বালাগাত শিখি ইত্যাদি নামের বাংলা-আরবি মিশ্রণে মানসম্মত চমৎকার বইগুলো আমাদের সামনে রয়েছে।


কী ভেবে যেন আমরা এগুলো পাঠ্যভুক্ত করতে পারছি না। অথবা এর বিকল্প নিজেরা তৈরিও করতে পারছি ন
ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনের একটি পর্যায়ে এ দেশের হক্কানী আলেম-ওলামারা দ্বীনের মৌলিকত্ব ধরে রাখার প্রয়াসে বর্তমান ধারার কওমি মাদ্রাসাগুলো গড়ে তোলেন। তখন এ দেশের রাজভাষা ছিল ফারসি। অতঃপর উর্দু হয়ে বর্তমানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ভারত-পাকিস্তানের আলেমরা নিজ নিজ ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করে জাতিকে উপহার দিয়েছেন বিশাল সাহিত্য সম্ভার। আর আমরা! ভাষার জন্য রক্ত দিলেও এখন পর্যন্ত বাংলাকে আপন করে নিতে পারিনি। বাংলা ভাষায় এখনও গড়ে তুলতে পারিনি কোনো পাঠ্যসূচি। মনে হয়, উর্দু-ফারসির মোহ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ নেই। সত্য হলেও তিক্ত যে, আমাদের কওমি মাদ্রাসার সিলেবাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এরই বাস্তব চিত্র।
কওমি মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণী সমমানের একটি ক্লাসের সিলেবাস বা পাঠ্য তালিকাটি নিয়ে আলোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এই ক্লাসটি নাহবেমির জামাত হিসেবে পরিচিত। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক প্রতিটি বোর্ডেই এই ক্লাসের পরীক্ষা হয় বোর্ডের অধীনে। আসুন, আমরা একটু অনুসন্ধান করে দেখি কী পড়ানো হয়, কীভাবে পড়ানো হয়, কী ভাষায় পড়ানো হয় এই ক্লাসের বিষয়াদি। কওমি মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকায় বিষয়সূচি নিয়ে কোনো মন্তব্য বা আলোচনা নয়, আলোচনার উদ্দেশ্য ভাষার মাধ্যম নিয়ে, পড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে। দেশের মানুষকে এ বিষয়ে কিছুটা হলেও ধারণা থাকা প্রয়োজন। নিম্নে নাহবেমির জামাতের (যা অষ্টম শ্রেণী সমমান) বিষয়গুলো তুলে ধরছি_
নাহবেমির, ভাষা ফারসি, বিষয় নাহু, উদ্দেশ্য আরবি ভাষার অলঙ্কার শাস্ত্র; পাঞ্জেগঞ্জ, ভাষা ফারসি, বিষয় ছরফ, উদ্দেশ্য আরবি ভাষার শব্দগঠন শৈলী সম্পর্কিত বিষয়; মালা বুদ্দা মিনহু, ভাষা ফারসি, বিষয় ফিকহ, উদ্দেশ্য প্রয়োজনীয় মাসআলা মাসায়েল শিখানো; গুলিস্তা, ভাষা ফারসি, বিষয় ফারসি কাব্যশাস্ত্র, উদ্দেশ্য ছাত্রদের নীতি-নৈতিকতা শিখানো; সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া, ভাষা উর্দু, বিষয় সীরাত, উদ্দেশ্য নবী চরিত বিষয়ে জ্ঞানদান করা; রওজাতুল আদব, ভাষা আরবি ও উর্দু, বিষয় আরবি সাহিত্য, উদ্দেশ্য উর্দুতে প্রদত্ত অনুশীলনীসহ এই কিতাবের মাধ্যমে ছাত্রদের আরবি চর্চা করানো; শরহে মিআতে আমেল, ভাষা আরবি, বিষয় নাহু, উদ্দেশ্য ছাত্রদের ইংরেজি চৎবঢ়ড়ংরঃরড়হ-এর মতো আরবি ভাষায় একশ'টি সূত্র বা আমেল শিক্ষা দেওয়া; বাংলা (ঐচ্ছিক); মনে চাইলে কেউ গুলিস্তার বিকল্প হিসেবে নিতে পারে। যেহেতু ওস্তাদরা ফারসির পক্ষে সে জন্য ছাত্ররা গুলিস্তাই বেশি পাঠ করে থাকে। আর নম্বরও বেশি মিলে ফারসি পড়লে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ভাষার এই জটিলতার কারণে এটাকে সাবলীলভাবে গ্রহণ করতে পারে না। সাধারণ শিক্ষিত পরিবারের অনেক ছেলে মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে দ্বীন শেখার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও এ ধরনের সমস্যার কারণে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথবা বাধ্যতামূলক পড়ার চাপে অনেক ক্ষেত্রে বখাটেপনায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। অনেক ছাত্র আগ্রহের সঙ্গে এগুলো পড়লেও যুগের চাহিদা অনুযায়ী যেসব বিষয়ে আরও বেশি পারদর্শী হয়ে ওঠার কথা, সেসব বিষয়ে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারে না। পাঠ্যসূচিতে সীরাত, নাহু-ছরফ ও ফিকাহ শেখার ব্যাপারে কারও কোনো আপত্তি নেই; থাকতেও পারে না। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে অন্য ক্ষেত্রে। তা হলো, মাসআলা আমার শেখা প্রয়োজন কিন্তু সেটা ফারসিতে কেন? সীরাত শিখব, তবে তা উর্দুতে কেন? নাহু-ছরফ কেন বাংলা-আরবিতে নয়!
দেশে বাংলা ভাষায় মানসম্পন্ন বিকল্প কিতাব রচিত হয়েছে। যেসব মাদ্রাসায় এগুলো চালু হয়েছে সেখানের ছাত্রদের মধ্যে একটু ভিন্ন ধরনের আমেজ লক্ষ্য করা যায়। এসো আরবি শিখি, এসো নাহু শিখি, এসো ছরফ শিখি, এসো বালাগাত শিখি ইত্যাদি নামের বাংলা-আরবি মিশ্রণে মানসম্মত চমৎকার বইগুলো আমাদের সামনে রয়েছে। কী ভেবে যেন আমরা এগুলো পাঠ্যভুক্ত করতে পারছি না। অথবা এর বিকল্প নিজেরা তৈরিও করতে পারছি না।
অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে আমরা বড় নির্মমভাবে এড়িয়ে যাচ্ছি। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করার তৌফিক আল্লাহ দিয়েছেন। কথাটি শুনতে খুব রূঢ় হলেও বলতে হচ্ছে, কওমি মাদ্রাসার গতানুগতিক সিলেবাসে যারা পড়ছে তাদের হেদায়েতুন্নাহু থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত সব কিতাব আরবিতে পড়ানো হলেও এখান থেকে ফারেগ হওয়া ছাত্রদের ৮০-৯০% ছাত্র আরবি, উর্দু, ফারসি এবং বাংলা কোনো ভাষাতেই বিশুদ্ধভাবে একটি দরখাস্ত পর্যন্ত লিখতে পারছে না। আরবি. উর্দু, ফারসিতে ১০ মিনিট সুন্দরভাবে কথা বলতে পারছে না। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। আমি গড়পড়তা কওমি অঙ্গনের বর্তমান ফারেগিনদের কথা বলছি। যদি অতিরঞ্জন বলে থাকি, তাহলে রাব্বুল আলামীনের দরবারে ক্ষমা চাচ্ছি।
কওমি মাদ্রাসার যারা এখন শীর্ষস্থানীয় দায়িত্বে আছেন তাদের কাছে বিনীত নিবেদন, দয়া করে বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবুন। দেশ ও জাতির কল্যাণের দিকটি আরও গুরুত্ব সহকারে অনুভব করুন। আবেগকে বাস্তবতার মুখোমুখি করুন।
alhuda_wf@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.