রম্য-বাজারে বিষবৃক্ষ by সাইফুল আলম

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে কখনও ব্যাক গিয়ারে আবার কখনও ফ্রন্ট গিয়ারে চলতে লাগলাম। হঠাৎ করেই কিসমিস মাছের বাজার থেকে বের হয়ে সবজির বাজার ঘুরে বাইরে এসে দাঁড়াল। আমিও যন্ত্রের মতো ওকে অনুসরণ করলাম। বাইরে বেরিয়ে ওকে শুধালাম, 'কী বিষয় দোস্ত।
তুমি এত দ্রুত বাজার থেকে বের হয়ে এলে যে, কোনো কিছুর দরদামও করলে না কিসমিস আলীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা যেন আমাদের দু'জনের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও কনক্রিট হয়ে উঠছে। সমসাময়িক জীবনযাত্রার অনিয়মতান্ত্রিক সমস্যাগুলোকে আমাদের দু'জনের দু'জোড়া চোখ যেন একটি দৃষ্টি হয়ে দেখতে পাচ্ছে। তবে তীক্ষষ্ট বুদ্ধিমত্তার ঘোড়দৌড়ে শীর্ণকায় কিসমিসের সঙ্গে পাল্লা দিতে আমাকে বেশ পিছিয়ে পড়তে হয়েছে।
সেদিন পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার ওপর ভর করে আমরা সকাল ১০টা ২৯ মিনিটে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের নির্দিষ্ট স্থানে সাক্ষাৎ করলাম। বাজারে আমার পদচারণার কথাটা মস্তিষ্কে টোকা দিতেই আমার অতি সংসারী বৌটা দুটি বাজারের থলে আমার হাতে গুঁজে দিল। যথাস্থানে পেঁৗছে কিসমিসকে দেখে বললাম, 'দোস্ত ঠিক সময়েই এসে পড়েছি, একটুও বিলম্ব হয়নি।' আমার কথায় ওর ভাঙা গাল দুটি কিঞ্চিৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল এবং বলল, 'তা ঠিক। রাজধানীর যানজট যেভাবে সারাক্ষণ আমাদের গতিপথটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে, তাতে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পেঁৗছানোটাই সৌভাগ্যের বিষয়।' আমি ওর রম্যবাক্যের কোনো উত্তর না দিয়েই শুধালাম, 'তা দোস্ত বাজারে এলে কিন্তু তোমার হাতে তো কোনো ব্যাগ-ট্যাগ দেখছি না। অবশ্য আজকাল আর বাজারে যাওয়ার সময় আগের মতো সনাতনী ঢঙে চটের থলে বা হাতলওলা বেতের সাজি নিয়ে বের হতে হয় না।' আমার মন্তব্যটা শেষ হলে ও উত্তরে বলল, 'কিন্তু আমি তো বাজার করতে আসিনি।'
_'সে কি! তবে কী করতে এসেছ?' আমি বিস্ময়ের ওপর দাঁড়িয়ে শুধালাম। আমার কথায় কিসমিস যেন কিছুটা উদাস হয়ে এলো। কণ্ঠকে শান্ত করে বলল_ 'দেখতে এসেছি।' তারপর কিঞ্চিৎ থেমে আবার বলল, 'দোস্ত আজকাল আমাদের দেশের বাজার-হাট তো মানুষের জীবন নিয়ে রঙ্গলীলা খেলার প্রাণঘাতী মেলা। তাই মেলা দেখতে এসেছি।
_তোমার কথা ঠিক বুঝলাম না।
_কেন, চারদিকে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ভেজাল প্রয়োগের যে হোলিখেলা চলছে, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তা দেখনি?'
_হ্যাঁ, তাই আমরা জেনেশুনে বিষ খাচ্ছি ভাই। কথাটা নাকিসুরে গেয়ে কিসমিস এবার বলল, 'চল বাজারের ভেতরটা পরিদর্শন করি, দেখি মৎস্যকন্যারা কেমন আছে। আর শাকসবজি, মসলাপাতি, ফলমূলেরই-বা কী দশা।
_তা মৎস্যকন্যা বলছ কেন? বাজারে তো পুরুষ মাছও থাকতে পারে।' আমার কথাটাকে কানে তুলে কিসমিস তার খোরমা মার্কা শুকনো ঠোঁট দুটিতে কিঞ্চিৎ হাসি বুলিয়ে বলল, 'তা ঠিক বলেছ। তবে আমরা সবসময় ডিমওয়ালা মাছদেরই গণনায় আনি।' আমি ওর কথাটার এত গভীরে গিয়ে কোনো দিন সাঁতার কাটিনি। তাই ওর কৌতুকের মাঝেও বাস্তবতার গন্ধ পেলাম। যা হোক, ভিড় ঠেলতে ঠেলতে আমরা মাছের বাজারের দিকে পা চালাতে সচেষ্ট হলাম। মানুষের শোরগোল আর উচ্চ বাক্য কানের পর্দা দুটোয় যেন কোনো ব্যান্ড-কনসার্টের ড্রাম বাজাতে লাগল। কিসমিস আমার কানের কাছে ওর ঠোঁট দুটিকে উপস্থিত করে ফিসফিসিয়ে বলল, 'আজকাল মাছে হরদম ফরমালিন মাখিয়ে তাকে তাজা করে রাখা হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই জানো। তাছাড়া লেগুনের মাছকে নদী বা পুকুরের বলে চালানো হচ্ছে।'
_তা জানি। কিন্তু বোঝার উপায় কী?
_ঠিকই বলেছ, বোঝা বড়ই শক্ত।
_তাছাড়া যে পানিতে মানুষ বা কলকারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সে এলাকার মাছও বিষাক্ত হয়ে ভক্ষণকারীদের আক্রান্ত করছে।
_'তুমি যথার্থ বলেছ; কিন্তু দেশের মাথাওয়ালা লোকদের কোনো মাথাব্যথা নেই।' আমি কোনো উত্তর না দিয়ে কখনও ব্যাক গিয়ারে আবার কখনও ফ্রন্ট গিয়ারে চলতে লাগলাম। হঠাৎ করেই কিসমিস মাছের বাজার থেকে বের হয়ে সবজির বাজার ঘুরে বাইরে এসে দাঁড়াল। আমিও যন্ত্রের মতো ওকে অনুসরণ করলাম। বাইরে বেরিয়ে ওকে শুধালাম, 'কী বিষয় দোস্ত। তুমি এত দ্রুত বাজার থেকে বের হয়ে এলে যে, কোনো কিছুর দরদামও করলে না।' আমার প্রশ্ন শুনে ওর চোখের তারা দুটোয় যেন হতাশার রঙ দেখা দিল। বলল, 'দোস্ত মাছের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু এ অসময়ে কেমন তরতাজা টমেটোর সরবরাহ দেখলে তো! আমাদের পানে তাকিয়ে তারা যেন মিটমিটিয়ে হাসছে।'
_'তা ভালোই তো, সারা বছর শাকসবজি খাবার সুযোগ পাচ্ছি আমরা।' আমার কথাটা যেন ক্রিকেট বলের মতো লুফে নিয়ে ও বলল, 'মাঝে মধ্যে তোমাকে সব কথার ব্যাখ্যা করে বলতে হয়। আমি চুপ করে রইলাম। ও বলল, আমরা আজকাল সবাই জানি যে, মাছে ফরমালিন, শাকসবজিতে ইউরিয়া, ফলমূলে কার্বাইড, বেকারির খাবারে পশুর চর্বি, গুঁড়া মসলায় ইটের গুঁড়া_ এমনকি বিদেশ থেকে আমদানি করা শিশুখাদ্যে পর্যন্ত মেলামাইন_ আহা! সত্যি সেলুকাস!' কিসমিসের কণ্ঠে যেন আবেগ আর ধিক্কারের সহবাস।
_'তুমি যথার্থ বলেছ। আমরা যেন ভেজালের আঁতুড়ঘর থেকে বের হতে পারছি না।' আমার কথাটা শেষ হতেই কিসমিস বলল, 'কিছুদিন আগে সমকাল পত্রিকায় বোতলজাত করা তথাকথিত ফিল্টার পানি অসাধু প্রক্রিয়ার প্রতিবেদনটা কি লক্ষ্য করেছ?' আমি ইতস্তত কণ্ঠে জানালাম 'কৈ? না তো।'
_'ওয়াসার ময়লা পানি বোতলে ভরে শহরের দোকান, হোটেল আর অফিসে সগৌরবে সরবরাহ করা হচ্ছে আর আমরাও তা পিয়ে তৃষিত বুকের চরাকে শীতল করছি।'
_'আমি আরও শুনেছি শহরের রাস্তার মোড়ের স্টপেজগুলোতে নানা ব্র্যান্ডের লেভেল মার্কা বোতলের পানিও নাকি এভাবে প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে।'
_'হ্যাঁ, এ খেলাটাও তো আমাদের সাংবাদিক সৈনিকদের রাডারে ধরা পড়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে।' আমি কিঞ্চিৎ নিম্ন সুরে বললাম, 'দোস্ত, ফল পাকানোর বিষয়ে একটা কৌতূহল মাঝে মধ্যে আমার বুকে দানা বাঁধে।'
_'তা দানাটা প্রস্ফুটিত করেই ফেল না।' কিসমিসের উৎসাহে আমি এবার এক কেজি উৎসাহ নিয়ে বললাম, 'গাছে ফল ধরলে, তা তো এক সময় পাকবেই, যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে তা মরে না যায়। তবে আর নানা অপকর্ম করে ইমম্যাচুরড ডেলিভারির প্রয়োজন কেন?' আমার কথাটা কানে যেতেই কিসমিস ব্যস্ত হয়ে আশপাশে দৃষ্টি ফেলে কী যেন খুঁজল। মনে হলো পাশে কোনো বসার ব্যবস্থা থাকলে সেখানে আশ্রয় নেবে। আমি শঙ্কিত হয়ে শুধালাম, 'কী হলো দোস্ত? শারীরিক যন্ত্রের কোনো বিঘ্ন ঘটল না তো?' ও এবার আমার চোখে চোখ ফেলে বলল, 'তোমার বয়স পাকলেও বুদ্ধিটা আজও অপরিপকস্ফ। এখন দেখছি তোমার বুদ্ধির গোড়াতেই কার্বাইড ঢালতে হবে।' কিসমিসের মন্তব্যে এবার সত্যি আমি লজ্জায় নিরুত্তর থাকলাম। আমার নীরবতাকে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে না দিয়ে ও বলল, দেশের অতি লোভী অসাধু ব্যবসায়ীরা, অতি জলদি আর অতি মুনাফা লাভের আকাঙ্ক্ষায় মৌসুমি ফলকে অকাল পকস্ফ আর বাহারি রঙে রূপান্তরিত করে আমাদের চিত্ত হরণের চেষ্টা করছে। এমনকি ফলন্ত গাছে তারা রাসায়নিক স্প্রে করছে।' কথাগুলো দ্রুতগতিতে বর্ণনা করে কিসমিস এবার যেন দম নিল। আমি বললাম, 'একটা জাতির পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বিষয়টি সত্যিই আশঙ্কাজনক।' কিসমিস এবার স্থান বদলে খানিকটা সামনে অবস্থান নিল। আমি সঙ্গ নিলাম। ও বলল, 'দোস্ত আমার মনে একটা আশঙ্কা খুব তীব্রভাবে মাথা তুলে ওঠে।'
_'তা বলই না, কী এমন আশঙ্কা?' আমি যেন উদ্বিগ্ন লুকাতে পারি না।
_আমার আশঙ্কা হয়, অচিরেই আমাদের দেশে হয়তো জন্মগত নানা ব্যাধি সঙ্গে নিয়ে অথবা পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে শিশুরা ভূমিষ্ঠ হবে।
_'তোমার আশঙ্কাকে একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সী ৯৪ ভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার।'
_এসব পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব আর ভেজালমাখা খাদ্যের কারণেই যে হচ্ছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।' আমাদের আলাপচারিতা সময়ের পালকিতে চড়েই যেন চলছিল। আমি বললাম, 'দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা তো আমাদের বিশেষভাবে সাবধান করে বলেছেন, এসব ভেজাল শরীরের ক্যান্সার, জন্ডিস, হার্টের রোগ ইত্যাদির জন্য দায়ী।'
_তা দোস্ত, ডাক্তাররা দায়িত্ব পালন করেছেন; কিন্তু জনসাধারণের সঙ্গে তাদেরও তো বাধ্য হয়েই ভেজালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।' আমি এবার কিঞ্চিৎ আশা জাগানিয়া কণ্ঠে বললাম, 'আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত তো প্রায়ই দেশের বিভিন্ন বাজারে হানা দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের সোজা করার চেষ্টা করছে।' আমার কথাটা যেন কিসমিসের কঙ্কালসর্বস্ব দেহের বগলের তলে কাতুকুতুর মতো কাজ করল, ও তার সারা শরীরের এনাটমিক্যাল ল্যান্ডমার্কগুলোর হাসি বুলিয়ে বলল, 'দোস্ত আমাদের একটা বদভ্যাস আছে, তা কি জানো? আমি বললাম, আমাদের তো অসংখ্য বদভ্যাস আছে। তা তুমি কোনটা ইঙ্গিত করছ তা তো বুঝলাম না।'
_'আমরা সর্বদাই গাছের গোড়ায় হাত না দিয়ে অযথাই ডালপালা কেটে শ্রম ব্যয় করি আর পরোক্ষভাবে শিকড়ে জল ঢালি।'
_'তোমার কথার অর্থ বুঝেছি। কিন্তু শিকড়টা কে তা তো জানতে হবে। কী নামইবা তার?
_'মহাজন তার নাম।' কিসমিসের কণ্ঠে কৌতুকের সুরলীলা খেলা করে উঠল। পরক্ষণেই দৃঢ় কণ্ঠে ও বলল, 'দেশের খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদনকারী, মজুদদার, সরবরাহকারী_ এদের সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরতে হবে। অযথা খুচরা ব্যবসায়ীদের নাড়ানাড়ি করে কোনো লাভ হবে না।' আমি ওর কথাগুলো দু'কান ভর্তি করে শুনে সমর্থনের ভঙ্গিতে নিশ্চুপ রইলাম। ও এবার বলল, 'দোস্ত, বিষবৃক্ষ চেনো? নাম শুনেছ?'
_'না, চিনি না। তবে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিত চন্দ্রের কালজয়ী উপন্যাস বিষবৃক্ষের সব পাতাতেই চোখ বুলিয়াছি।'
_'তোমার সাহিত্যপ্রেমে সত্যিই পুলকিত হলাম। তবে এ বিষবৃক্ষ হলো আমাদের অসাধু ব্যবসায়ীরা।'
_'তোমার উপমাটা সত্যি চমকপ্রদ দোস্ত।'
_'হ্যাঁ, ওই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে হবে। তবেই দেখবে ডালপালা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।' কিসমিস কথাগুলো শেষ করে এবার তার হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময়টা জেনে নিয়ে হঠাৎই বলল, 'দোস্ত আমাকে একবার মতিঝিল যেতে হবে। চলি! ফের দেখা হবে।' বলেই সে সময় ক্ষয় না করে দ্রুত সামনে পা রাখল। আমি ওর দিকে কিছুক্ষণ চোখ পেতে এবার আমার হাতে গুঁজে থাকা থলে দুটির অস্তিত্বটা অনুভব করলাম। এ দুটির ক্ষুধার্ত পেটে এ অবধি কিছুই চালান দেওয়া হয়নি। ওদিকে বাড়িতে আমার বৌটাও একরাশ আশা নিয়ে স্বামী রত্নটির ফেরার পথে চেয়ে আছে। তাই আর বিলম্ব না করে মুরগির বাজারের দিকে পা বাড়ালাম।

ডা. সাইফুল আলম :চিকিৎসক
 

No comments

Powered by Blogger.