চিরদিন স্মৃতিপটে গাঁথা রবে by ড. আবু এন এম ওয়াহিদ

আমাদের এ শহরে অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও গবেষক আছেন, যাঁরা সম্প্রতি জাপান থেকে উচ্চশিক্ষা (পিএইচডি পর্যায়ে) নিয়ে আমেরিকায় চাকরি করতে এসেছেন। বিভিন্ন সময় তাঁদের কাছে শুনেছি জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজ, সভ্যতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জাপানিদের ধর্মবিশ্বাসের কথা।

আরো শুনেছি তাদের মানবিক মূল্যবোধ, আধুনিক প্রযুক্তি ও কর্মনিষ্ঠা, স্বভাব-চরিত্র, অতিথিপরায়ণতা, পরোপকার, আত্মত্যাগ-আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধের কথা। ধর্মবিশ্বাসের বিষয় বাদ দিলে, অন্য যাবতীয় সামাজিক ও মানবিক গুণাবলিতে জাপান পৃথিবীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ না হলেও কারো থেকে যে পিছিয়ে নেই, তা মোটামুটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। ধর্মকর্ম ও ধর্মবিশ্বাস প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে জাপানিরা বলে, 'ধর্ম দিয়ে কী হবে? ধর্ম ছাড়াই তো আমরা ভালো আছি।' কথাটা শুনেছি আমার এক জাপানফেরত বন্ধুর কাছে। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুইবার জাপান যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। জাপানিদের কাছ থেকে দেখেছি, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং কিছু লেনদেনও করেছি। এ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জাপানিদের সম্পর্কে আমার ধারণাও বন্ধুটির থেকে কোনো অংশে ভিন্ন নয়। ধর্মের প্রতি জাপানিদের মধ্যে কোনো ধরনের অনুরাগ-বিরাগ, উৎসাহ-উদ্দীপনা কিংবা বাড়াবাড়ি_কোনোটিই আমি দেখিনি। ধর্মের ব্যাপারে এক কথায় বলতে গেলে, তারা সত্যি সত্যি নিরপেক্ষ। অবশ্য আজকের এ নিবন্ধে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব, তা হচ্ছে জাপানিদের সহৃদয়তা ও পরোপকারের কথা।
১. ২০০৭ সালে আমি এবং আমার স্ত্রী সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পথে জাপানে থেমেছিলাম তিন দিনের জন্য। নাগোয়ার নানজান বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম এক বিশেষ সেমিনার উপলক্ষে। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খন্দকার মিজানুর রহমান। সিঙ্গাপুর থেকে সারা দিন বিমানে উড়ে টোকিও হয়ে আমরা যখন নাগোয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পেঁৗছি, তখন স্থানীয় সময় রাত প্রায় ১০টা। এয়ারপোর্ট থেকে ড. রহমানের বাসায় যেতে হবে আরো প্রায় ৩০-৪০ মাইল। জাপানে ট্যাঙ্ িভাড়া অত্যধিক জেনে আমরা ঠিক করলাম, বাসে যাব। ব্যাগেজ খালাস করে টার্মিনালের মেইন ফ্লোর থেকে এক কী দুই লেভেল নিচে গিয়ে যখন বাসস্টপেজে দাঁড়ালাম, তখন রাত প্রায় সাড়ে ১০টা। আমরা এতই ক্লান্ত যে পা দুটি যেন কোনোক্রমেই আর শরীরের ভার বইতে পারছিল না। মিনিট কয়েকের মধ্যেই ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সাড়ে ১০টায় বাস এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল। দিনের শেষ বাস, অল্প কয়েকজন যাত্রী। আমরা তড়িঘড়ি করে বাসে উঠলাম। ড. রহমানের পরামর্শ অনুযায়ী আমি টোকিও এয়ারপোর্টে ১০০ ডলার ভাঙিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় কিছু বেশি ইয়েন কিনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও পার পেলাম না। বাসে উঠে পড়লাম এক নতুন সমস্যায়। আমার কাছে ইয়েনের নোটগুলো সব ছিল বড় বড়। বাস ড্রাইভারকে সঠিক পরিমাণ ইয়েন দিতে পারছি না আর সিটেও বসতে পারছি না, ফলে বাস ছাড়ছে না এবং দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। একে তো অতিক্লান্ত, তারপর কথা বুঝি না, কিছু বোঝাতেও পারি না। কী করব তাই ভাবছি আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। এমন সময় বুঝতে পারলাম, বাসের মাঝখানে বসা এক মধ্যবয়সী জাপানি যাত্রী এক পলকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারছেন। চোখাচোখি হওয়ায় আমাকে তিনি ইশারা করলেন তাঁর কাছে যেতে। আমি ছুটে গেলাম তাঁর দিকে। ইতিমধ্যে তিনি তাঁর পকেট থেকে একটি ছোট্ট পাউচ বের করে কয়েন গুনে গুনে আমাদের দুজনের ভাড়া আমার হাতে বুঝিয়ে দিলেন। ড্রাইভারের কাছে নির্দিষ্ট বাঙ্ েভাড়াটা ফেলে দিয়ে এসে স্বস্তির সঙ্গে আমরা দুজন একই বেঞ্চে তাঁর পাশে বসলাম। বাস ছাড়ল। তারপর ভদ্রলোক তাঁর সঠিক পাওনা আমার হাত থেকে নিজেই গুনে নিয়ে নিলেন।
২. ২০১০ সালে আবার একটা সুযোগ এল জাপান যাওয়ার। সেবার গিয়েছিলাম টোকিওর রপঙ্গি এলাকায় অবস্থিত 'ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজে'। উদ্দেশ্য 'গবেষণা ও প্রকাশনা' বিষয়ে সেখানকার মাস্টার্স ও পিএইচডিতে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের সামনে একটি একক উপস্থাপনা। কাজ সেরে ফেরার দিন রপঙ্গি থেকে ট্রেনে রওনা দিয়েছি। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন লাইন। টিউবের ভেতর দিয়ে দ্রুতগতিতে চলছে। কোনো ল্যান্ডমার্ক দেখার কিংবা বোঝার কোনো উপায় নেই। দেখতে পেলাম আমার এই অসহায় অবস্থাদৃষ্টে পাশের বেঞ্চে বসা এক জাপানি সহযাত্রী ওয়ালেট খুলে একটা চিরকুট বের করে কী যেন লিখছেন।
পরের স্টপেজে তিনি নেমে গেলেন। যাওয়ার সময় আমার হাতে চিরকুটখানি ধরিয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে যা বললেন, তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। চিরকুটখানি খুলে দেখলাম ক্রমান্বয়ে নম্বর দিয়ে চারটি স্টেশনের নাম লেখা, তাও জাপানি ভাষায়। কিছু পড়তেও পারলাম না, কিছু বুঝলামও না। ভদ্রলোকের চিরকুটখানা আমার কোনো কাজে লাগেনি। ভবিষ্যতেও যে লাগবে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মাত্র ১০ মিনিটে অজানা-অচেনা একটি লোক তাঁর মনের যে পরিচয় রেখে গেলেন, তা চিরদিন গাঁথা রবে আমার স্মৃতিপটে।

লেখক : অধ্যাপক-টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর-জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid_tnstate.edu

No comments

Powered by Blogger.