স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র-পথের বাধা দূর হোক
জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদের আবেদন জানিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় ও মুক্তিকামী মানুষকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। মাহমুদ আব্বাস বলেন, 'আমার সাহসী ও গর্বিত দেশবাসীর জন্য সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে_ যখন তারা পৃথিবীর অন্য সব মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারবে, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে মুক্তভাবে চলাফেরা করার অধিকার পাবে।'
গত চার দশকে বহু নতুন রাষ্ট্র স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছে তার সার্বভৌম সত্তার বারতা। পৃথিবীর বহু দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে, মিলেছে জাতিসংঘের সদস্যপদও। কিন্তু ইসরায়েলি দখলদারিত্বের মধ্যে ফিলিস্তিনিরা থেকেছে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে। একটি রাষ্ট্রের জন্য তাদের স্বপ্ন আজও তাজা, রাষ্ট্রের জন্য এখনও চলছে রক্তদানের অনন্ত কর্মসূচি, চলছে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় শান্তি আলোচনার আয়োজনও। কিন্তু ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) ও ইয়াসির আরাফাতের সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। নিকট অতীতে হবে কি-না সে নিশ্চয়তা দিতে পারে শুধু বিশ্বের নেতৃস্থানীয় দেশগুলোই। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনের অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসির আরাফাত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের আগের সীমান্ত অনুসারে স্বাধীন রাষ্ট্রের এই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে তখন ১০০টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তখন থেকেই ফিলিস্তিনিরা জাতিসংঘের সদস্যপদ চেয়ে আসছে। কেননা, আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানে জাতিসংঘের সদস্যপদই সবচেয়ে অর্থজ্ঞাপক। কিন্তু জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। আর স্থান রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের নয়, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের। এখন ফিলিস্তিনিরা পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ চায়। পশ্চিম তীর, গাজা ও পূর্ব জেরুজালেম নিয়ে স্বাধীন এ ফিলিস্তিনের প্রতি সাধারণ পরিষদের ১২২টি দেশের সমর্থন আছে। কিন্তু প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে পাস হলেও চূড়ান্তভাবে নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন নিয়েই জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে হবে ফিলিস্তিনকে। ইতিমধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। সে ভেটোর কাঁটা তুলে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হয়তো এবারও অধরাই থেকে যাবে। অনেকেই আশা করছেন, পর্যবেক্ষকের মর্যাদা থেকে পর্যবেক্ষক সদস্যের মর্যাদা পাবে ফিলিস্তিন। কিন্তু ২০১১ সালে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিই অধিকতর প্রত্যাশিত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিচালিত শান্তি প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে চূড়ান্তভাবে দুই রাষ্ট্রের সমাধানে পেঁৗছানোর কথা বলা হয়েছিল। সেদিক থেকে ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই এ দাবি করতে পারে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ লক্ষ্যের প্রতি তার আস্থা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু মাহমুদ আব্বাসের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে তিনি যে ভেটোর কথা বলেছেন তা সবাইকে বিস্মিত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এর বিরূপ সমালোচনা হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, নির্বাচনের বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার উদ্দেশ্যেই প্রেসিডেন্ট এমন কথা বলেছেন। ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারিত্বই হোক, কি অন্য কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্র যদি ফিলিস্তিনের সদস্যপদের বিরোধিতা করে তবে বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণ তার তীব্র সমালোচনা করবে। তারা আশা করবে, শান্তি আলোচনার নতুন যুগে স্বাধীন ফিলিস্তিনই মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। সবচেয়ে প্রত্যাশিত হবে যদি কোনো ভেটো বা বাধাদানের ঘটনা না ঘটে। জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হিসেবে ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়াকে অনেক বেশি অর্থবহ করে তুলতে পারে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভাজন আছে। হামাস ইতিমধ্যে জাতিসংঘে সদস্যপদের প্রস্তাবকে মাহমুদ আব্বাসের একতরফা উদ্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে মাহমুদ আব্বাসের হাত ধরে যদি ফিলিস্তিন জাতিসংঘের সদস্যপদ পায় তবে শান্তি প্রক্রিয়ায় তার অবস্থান আরও সংহত হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রতিশ্রুতি পূরণ করলে ফিলিস্তিনের জনগণ তো বটেই পুরো মুসলিম বিশ্ব তাদের প্রতি আস্থাভাজন হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের জনগণও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিনের আত্মপ্রকাশ দেখার জন্য।
No comments