চালচিত্র -আমাদের দেশ ও পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা by শুভ রহমান

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচন নিয়ে লেখালেখি এত সহজে শেষ হওয়ার নয়। সারা দুনিয়ার দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে এর ওপর। এটা কি শুধু বামফ্রন্টের অবসান, নাকি বামপন্থাই পৃথিবী থেকে বিদায় নিল! আবারও তাই আমরা আলোচনায় প্রবৃত্ত হলাম।


স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও আমাদের দেশটা এমনিতেই হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। আমরা প্রায়ই এই উপলব্ধির জায়গায় এসে পৌঁছাই যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রও একরকম কায়েম হয়েছে-কিন্তু তার পরও সমাজটা আজও সেই হাজার বছর পিছিয়েই রয়েছে। সব রকম 'সোশ্যাল ভাইস' ও 'অবক্ষয়' তথা চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, চোরাচালানি, মজুদদারি, কালোবাজারি, ছিনতাই, লুটতরাজ, দখলদারি, খুন-খারাবি, ইভ টিজিং আর ধর্ষণের মতো অপরাধ, ক্ষুধা-দারিদ্র্য, রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি, সামাজিক নানা কুসংস্কার, অজ্ঞতা, অশিক্ষা সমাজটাকে সজোরে পেছনেই ঠেলে রেখেছে। আর, এরই সুযোগ নিচ্ছে ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী, উগ্র সব হিংসাত্মক শক্তি, যারা অত্যন্ত সংকীর্ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থেই মানুষের পবিত্র ধর্মানুভূতি ও অজ্ঞতা-অশিক্ষা প্রভৃতিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের, মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকে নস্যাৎ করে দিতে সচেষ্ট রয়েছে। বিদ্যমান আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া ও উন্নয়নের সত্যিকার কোনো উপায় নেই। স্বভাবতই সে জন্য যেখানেই সমাজ পরিবর্তনের একটা প্রয়াস চলছে, আমাদের মতো দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশের মানুষ সেদিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকবে_এটাই স্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের যতই ভুলত্রুটি ও বিচ্যুতি থাক, তারা যে সেখানকার সমাজ পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ প্রগতিশীল শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে এবং ৩৪ বছর ধরে তারা সেই অঙ্গীকার পূরণের চেষ্টা চালিয়ে এসেছে, দূর থেকে পাওয়া এ তথ্যটাই এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষকে যথেষ্ট আশান্বিত করে তুলেছিল। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের অপ্রত্যাশিত ভরাডুবি স্বভাবতই এ দেশের সচেতন মানুষকে সে জন্য ব্যথিত ও আশাহত করেছে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিজেকে 'বামপন্থী' বলে দাবি করায় এবং ভূমিধস বিজয় অর্জন করায় তাঁকে কেন্দ্র করেও এ দেশের গরিব-দুঃখীরা নতুন করে আশায় বুক বাঁধবে, এটাও স্বাভাবিক। সে জন্য এ দেশের মানুষ সচেতন গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা ও মূল্যবোধ থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও প্রাণঢালা অভিনন্দনই জানিয়েছে। ইতিমধ্যেই মমতা শুধু সিঙ্গুরে কৃষকদের কাছ থেকে 'জোর করে কেড়ে নেওয়া' বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি ফেরত দেওয়া আর কিছু প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণ করে মানুষের মনে আশার সঞ্চার করতে চেষ্টা করেছেন। এমনও জানা যাচ্ছে, যে টাটা শিল্পগোষ্ঠী চলে গিয়েছিল, তাদেরও ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও মমতা আগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দিয়েই গ্রহণ করছেন। মমতা ২০০ দিন সময় চেয়েছেন, মানুষ অবশ্যই তা দেবে। মানুষ আশাহত হবে না, আমরাও এ বিশ্বাসই পোষণ করতে চাই। তবে সত্যিকার পরিবর্তন আনার জন্য, মানুষের ভাগ্যবদলের জন্য যে দৃঢ় আদর্শবাদী সংগঠন থাকা অপরিহার্য, রাজ্যবাসী এখনো তার দেখা পেয়েছে বলে আমরা মনে করতে পারছি না। মমতা একক ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, এ রকম ভাবা আদৌ বাস্তবসম্মত হবে না।
বাংলাদেশে বাজারজাত ও বহুলপ্রচারিত একটি ভারতীয় বাংলা সাময়িকীতে (দেশ) পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সাম্প্রতিক নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই বিজয়িনী মমতা ব্যানার্জির কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশের, বিশেষ করে বাংলাভাষী রাজ্য বলেই নয়, ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের শাসনের সত্যিই মানুষ পরিবর্তন চায় কি-না, সে ব্যাপারে আমাদের দেশের মানুষের কৌতূহল ও আগ্রহ ছিল অনেক। কেউবা বামফ্রন্টের এমন ভরাডুবি আশা করেনি। অথচ নির্বাচনে কোনো কারচুপির কথা তো শোনা যায়ইনি, বরং নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে দক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনার প্রশংসাই পশ্চিম বাংলার মানুষসহ সবাই একবাক্যে করেছে। এটাও আমাদের কাছে একটি বিস্ময়কর ব্যাপার বলেই মনে হয়েছে। আমাদের এখানে এ ধরনের নির্বাচনী ফলকে প্রথমেই বিজিত দল প্রত্যাখ্যান করত, ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনত এবং নিশ্চিতভাবেই পুনর্নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়ে বসত।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের ফল দেখেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পেঁৗছে গেলে হবে না যে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারত ও সারা দুনিয়ায়ই এবার বাম রাজনীতি মুছে যাওয়ার দিন শুরু হলো।
কথাটা_এই তেতো কথাটা প্রকৃত বামরা পৃথিবীর কোথাও গলাধঃকরণ করতে চাইবে না। আমাদের এখানেও বামপন্থী বলে দাবিদাররা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের পরাজয়ে ভ্রূ ও কপাল কুঞ্চিত করছেন। কপালের বলিরেখা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁদের। এবং তাঁদের একটা বড় ভরসা যে হঠাৎ মুখ থুবড়ে পড়ল, এতে তাঁদের অনেকেই খুব মুষড়েও পড়েছেন। পরাজয়টা পশ্চিমবঙ্গ বামফ্রন্ট স্পোর্টসম্যান স্পিরিট থেকে মেনে নিলেও আমাদের এখানে একশ্রেণীর তথাকথিত বামপন্থী তা মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে আবার, আমাদের এখানে বামপন্থী বলে দাবিদারদের একাংশ, যাঁরা মনে করতেন পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ঠিকভাবে বামপন্থা তথা মার্কসবাদ অনুসরণ করছে না এবং অনেকটাই বিপ্লবের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে দক্ষিণপন্থী বা বুর্জোয়া লাইন ধরেছে, তাঁরা মোটামুটি বামফ্রন্টের পরাজয়ে অখুশি হননি। তাঁরা মনে করছেন, মার্কসবাদ থেকে বিচ্যুত হয়ে সমাজবিপ্লব যে করা যায় না, এ শিক্ষা তো এবার সিপিএম তথা বামফ্রন্টের হলো।
এ প্রসঙ্গে সিপিএমের প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা কমরেড জ্যোতি বসুর বারবার উচ্চারিত ও ক্যাডারদের মনে করিয়ে দেওয়া একটি মূল্যবান কথা স্মরণ করা যায়। জ্যোতি বসুকে প্রায়ই বলতে শোনা যেত, আমাদের এটা ভুললে চলবে না যে একটি বিশাল পুঁজিবাদী কাঠামোর ভেতরে থেকেই আমরা বাম রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের পরীক্ষামূলক প্রয়াস চালাচ্ছি। বামপন্থী তথা কমিউনিস্টদের বাম সংকীর্ণতাবাদ (Left sectarianism) ত্যাগ করে ও সেই সঙ্গে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদও (Right opportunism) কঠোরভাবে পরিহার করে সঠিক মার্কসবাদী লাইন অনুসরণ করে শান্তিপূর্ণ সংসদীয় গণতান্ত্রিক পথেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতে হবে। দুনিয়াভর এটি অবশ্যই একটি পরীক্ষামূলক প্রয়াস। দুনিয়ার কোথাও এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে এ প্রয়াস ফলবতী হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে নানা রকম দোষত্রুটি ও বিচ্যুতি নিয়েই বামফ্রন্ট তথা মার্কসবাদী কমিউনিস্টরা রাজ্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থেকেছেন, শুধু তা-ই নয়, এতদূর পর্যন্ত দেশ ও সমাজের গ্রহণযোগ্যতাও অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন যে, সিপিএম নেতা জ্যোতি বসু লেফট সেকটেরিয়ানিজমের খোলস থেকে বেরিয়ে একজন সর্বজনমান্য সর্বভারতীয় নেতা হিসেবেই স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, পার্টির 'ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত' (Great political blunders) মেনে নিয়ে জ্যোতি বসু যদি কেন্দ্রে তৎকালীন ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স) থেকে 'dissociate' না করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করতেন, তাহলে আজ সারা ভারত তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গেও বামফ্রন্ট তথা কমিউনিস্টদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক গুণ বেশি থাকত এবং অষ্টম দফায়ও সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে তৃণমূল-কংগ্রেস জোটের কাছে শোচনীয় পরাজয়বরণ করতে হতো না।
সারা দুনিয়ায় এখন দ্রুত যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তাতে ওই সনাতনী রক্ষণশীল মূল্যায়নে কোনো কাজ হবে না। সাধারণ মানুষের আশা-আঙ্ক্ষাকেই সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে সর্বত্র পরিবর্তনের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব কোনো রকম সংকীর্ণতা পোষণ না করেই প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, ত্রিপুরাসহ সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দুর্মর প্রয়াস চালাচ্ছে। বাংলাদেশের মহাজোট সরকারের কাছে কমিউনিস্ট- অকমিউনিস্ট নির্বিশেষে বিশ্বের সর্বত্র গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সৌহার্দ্য ও সহযোগিতাভিত্তিক দ্বিপক্ষীয় ও আন্তরিক উন্নয়ন ও সংহতির সম্পর্ক গড়ে তোলাই একমাত্র কাম্য।
বস্তুত যাঁরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ বা কেরালায় বামফ্রন্টের শাসনেরই শুধু নয়, বাম রাজনীতিরই অবসান ঘটে গেছে, তাঁরা ইতিহাসের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ইতিহাস কোনো মতাদর্শের মুখাপেক্ষী থেকে তার সম্মুখযাত্রার রথচক্র থামিয়ে রাখবে না। মার্কস তো নিজেই বলেছেন, Marxism is not a dogma, but a guide to action_মার্কসবাদে কোনো রকম গোঁড়ামির স্থান নেই। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে, মানুষের জয়যাত্রার সঙ্গে যে মতাদর্শ, যে ভাবাদর্শ তাল মেলাতে পারবে সেটাই মার্কসবাদ। সেটাই সভ্যতার অগ্রগতির চাবিকাঠি। সেটাই বামপন্থা,
বাম রাজনীতি।
৩১.৫.২০১১

No comments

Powered by Blogger.