সর্বোচ্চ আদালত ও রাজনৈতিক ক্রমবিকাশ by এ এম এম শওকত আলী
সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগের পরিধি সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক নির্ধারিত হওয়ার অভিজ্ঞতা কমবেশি সব উন্নয়নশীল দেশেই বহু বছর ধরে দৃশ্যমান, বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে। এ ধরনের পরিবর্তন সামরিক শাসনের মাধ্যমে ১৯৭১-পূর্ববর্তী পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে ১৯৭৫ ও ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে হয়েছিল।
পাকিস্তানে প্রথম পরিবর্তন হয় ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের আগে। তখন প্রসঙ্গ ছিল পাকিস্তানের সংসদ গভর্নর জেনারেল কর্তৃক বিলুপ্ত হওয়ার ঘটনা। ওই সময় এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি তদানীন্তন বাংলাদেশি স্পিকার অবৈধ ঘোষণা করার জন্য আদালতে আবেদন জানান। প্রাথমিকভাবে সিন্ধু প্রদেশের প্রধান আদালতে আবেদন মঞ্জুর করে গভর্নর জেনারেলের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য গড়ায়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের রায় রদ করে ঘোষণা দেন, সংসদ ভেঙে দেওয়ার আদেশটি বৈধ। পরবর্তীকালে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালে সংসদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান সম্পূর্ণ বাতিল করে ১৯৬২ সালে নতুন সংবিধান চালু হয়। এর পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর। ১৯৭১-পরবর্তী সময়েও পাকিস্তানে একাধিকবার সামরিক শাসন জারি করা হয়। সামরিক শাসন জারি করার পর কখনো কোনো সর্বোচ্চ আদালত তা অবৈধ ঘোষণা করেননি। তবে ব্যতিক্রমধর্মী একটি ঘটনা অবশ্যই ছিল। সেই ঘটনা পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতির পদচুত্যির সঙ্গে জড়িত। এ ঘটনা সাম্প্রতিককালের।
পাকিস্তানে সংসদ বিলুপ্তির প্রথম ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশের মূল ভিত্তি ছিল ডকট্রিন অব নেসেসিটি (উড়পঃৎরহব ড়ভ ঘবপবংংরঃু)। এই নীতিই কমবেশি দুই দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে হয়তো সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষণা করার বিষয়ে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ আদালত ডকট্রিন অব নেসেসিটি গ্রহণ করেই অবৈধ ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকেন। তবে প্রশ্ন করা যায়, আদালতে আবেদন না করলে আদালত কেন এ ধরনের আদেশ দেবেন। এর উত্তর হলো, জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে উচ্চতর আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের মামলা চালু করতে ক্ষমতাবান।
উপরোক্ত মন্তব্য সাপেক্ষে এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য, ২০০০ সাল-পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট বিভাগসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত অন্তত তিনটি রায় ঘোষণা করেছেন_১. পঞ্চম সংশোধনী রায়, ২. সপ্তম সংশোধনী রায়, ৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত রায়। প্রথম দুটি রায়ে সামরিক শাসন জারির বিষয়টিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত রায় সামরিক শাসনামলে জারি হয়নি। সংসদের সম্মতিক্রমে এই সংশোধনী জারি করা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের এ আদেশে আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচন এ ধরনের সরকারের মাধ্যমেই হতে হবে। এ ধরনের আদেশ অনেকের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত। কারণ একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হলো, অন্যদিকে আগামী দুই নির্বাচন এ ধরনের সরকারের মাধ্যমেই হওয়ার নির্দেশ পরস্পরবিরোধী বা সাংঘর্ষিক। প্রধান আইনবিদরাও এ কথা বলেছেন। বিদায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চই এ ধরনের আদেশ দিয়েছেন। এ আদেশ যেন বৈধ-অবৈধের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। কালোও যে কিছু সময়ের জন্য সাদা হতে পারে, সেই তত্ত্ব জানা গেল। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রথম রায়ে ডকট্রিন অব নেসেসিটি তত্ত্বকেই মেনে নিয়েছেন। তাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রেও এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে। কালো টাকাকে বৈধ করার সুযোগ প্রদান এর অন্যতম। অন্য একটি উদাহরণ হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের অনুকম্পা প্রদর্শন। আদালত অবশ্য এই আইন ও প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। জানা গেছে, এই কমিশনের সিদ্ধান্তের বলে যারা দায়মুক্তি পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এখন দুদক তদন্ত চালু করবে।
সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণার রায় দু-একটি মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্নটি হলো, ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতা রোধ করার উপায় কী? সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে বের করতে ব্যস্ত। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের জন্য সামরিক শাসকদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করে তাঁদের শাস্তি দেওয়ার বিধান-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। অপরাধ দমনের জন্য বহু আইন প্রচলিত রয়েছে। তা সত্ত্বেও অপরাধের সংখ্যা ও মাত্রা যে হ্রাস পায়নি, তা সর্বজনস্বীকৃত। আইন প্রণয়ন করে সামরিক শাসন জারি বন্ধ করা যাবে কি না, এ বিষয়েও অনেকে সন্দিহান।
দক্ষিণ এশীয় দুটি দেশে সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এ ধরনের শাসন প্রবর্তনের সুযোগ সামরিক বাহিনী তখনই গ্রহণ করে, যখন প্রচলিত শাসনব্যবস্থা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা ব্যর্থ হলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে এই কারণের সঙ্গে অন্য একটি কারণও যুক্ত করা সম্ভব। আর তা হলো, উচ্চতর সামরিক কর্মকর্তাদের উচ্চাভিলাষ। এর কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল ১৯৭৫ সালের প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান। এ ঘটনাটিই সুযোগ করে দেয় ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য পরবর্তী অভ্যুত্থানের। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ ধরনের অভ্যুত্থানের ফলে অন্য কয়েকটি বিষয়ও দৃশ্যমান হয়_১. তথাকথিত জনগণের সমর্থন। অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে। এ জন্য বলা হয়, ৭ নভেম্বর ছিল সিপাহি জনতার বিপ্লব। ২. পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায়, রাজনৈতিক কিছু নেতার প্রথমে গোপনে, পরে প্রকাশ্যে প্রধান সামরিক শাসকের আনুগত্য লাভের প্রচেষ্টা। এ বিষয়টিই প্রধান সামরিক শাসককে নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টিতে উৎসাহী করে। পরবর্তী দৃশ্য হলো, প্রথমে রেফারেন্ডাম, পরে সংসদীয় নির্বাচন। মাঝখানে হয় স্থানীয় সরকার প্রথার সংস্কার। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রধান সামরিক শাসক জাতীয় রাজনীতিতে কয়েক বছরের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করেন। এসব ক্ষেত্র যে সামরিক শাসনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়, সংশ্লিষ্ট সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহই এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
অন্যদিকে নতুন করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা দেওয়ার কি প্রয়োজন রয়েছে? এ প্রশ্নটিই মুখ্য। কারণ প্রচলিত দণ্ডবিধিসহ সামরিক আইনেও শাস্তি প্রদানের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষমতা প্রথমে নির্বাহী বিভাগের, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট আদালতের। প্রাথমিকভাবে সামরিক শাসনামলে প্রচলিত নির্বাহী বিভাগ যে এ ধরনের প্রক্রিয়া চালু করতে সক্ষম নয়, তা সর্বজনবিদিত। আদালতের পক্ষেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব নয়। কারণ একই। সামরিক শাসনামলে উভয় বিভাগই সামরিক আইন সাপেক্ষেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। আইন প্রয়োগ করার সফলতা বা সামর্থ্য বল প্রয়োগের ক্ষমতার ওপরই নির্ভরশীল। সংবিধান এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারও একচেটিয়া বল প্রয়োগের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান। তবে এ ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করতে হয় সংবিধান এবং প্রচলিত আইন সাপেক্ষে। সামরিক আইনে এসবের বালাই নেই। অন্যায়ভাবে বল প্রয়োগ করলেও তার কোনো প্রতিকার নেই। সংবিধান অক্ষুণ্ন থাকলে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
সর্বোচ্চ আদালত যে সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন, এ বিষয়টি অতীতের দুই সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভবিষ্যতের জন্য এটা অবৈধ কিভাবে হবে? বিষয়টি চিরতরে বন্ধ করার উপায় একটাই। আর তা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলসহ সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীলতা। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে চারবার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পর্যায়ক্রমে ক্ষমতাসীন ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংঘাতময় রাজনৈতিক ধারা বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে বিষয়টি তুঙ্গে ওঠে ২০০৬ সালে। এর আগে ১৯৯৫-৯৬ সালে। ১৯৯৬ সালে ওই ধারা সাময়িকভাবে প্রশমিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার সাংবিধানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে। অচিরেই তা বিলীন হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে সংঘাতময় রাজনৈতিক ধারা ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর কিছু না হোক, ২০০৮ সালের সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়।
এরপর সংঘাতের ধারা দৃশ্যমান। ১৯৯৫-৯৬ সালের মতো সংসদও অচল বা অকার্যকর। সাধারণ ভোটাররা এর জন্য দায়ী নয়। দায়ী কে বা কারা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বোচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট আদেশ এবং প্রাসঙ্গিক মন্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ যদি রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে অসাংবিধানিক সরকার যে ক্ষমতা গ্রহণ করবে না, তা নিশ্চিত নয়। নির্বাচিত ক্ষমতাসীন সরকারসহ প্রধান বিরোধী দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল যদি ক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তাহলে তা হবে রাজনৈতিক ক্রমবিকাশ তথা সুশাসনের জন্য একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বা প্রক্রিয়া। সর্বোচ্চ আদালত সুস্থ রাজনৈতিক ক্রমবিকাশের জন্য পরিপূরক শক্তি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বর্তমানে এ উপলব্ধিই জরুরি।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
পাকিস্তানে সংসদ বিলুপ্তির প্রথম ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আদেশের মূল ভিত্তি ছিল ডকট্রিন অব নেসেসিটি (উড়পঃৎরহব ড়ভ ঘবপবংংরঃু)। এই নীতিই কমবেশি দুই দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে হয়তো সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষণা করার বিষয়ে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ আদালত ডকট্রিন অব নেসেসিটি গ্রহণ করেই অবৈধ ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকেন। তবে প্রশ্ন করা যায়, আদালতে আবেদন না করলে আদালত কেন এ ধরনের আদেশ দেবেন। এর উত্তর হলো, জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে উচ্চতর আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ ধরনের মামলা চালু করতে ক্ষমতাবান।
উপরোক্ত মন্তব্য সাপেক্ষে এ কথা নিঃসন্দেহে সত্য, ২০০০ সাল-পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট বিভাগসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত অন্তত তিনটি রায় ঘোষণা করেছেন_১. পঞ্চম সংশোধনী রায়, ২. সপ্তম সংশোধনী রায়, ৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত রায়। প্রথম দুটি রায়ে সামরিক শাসন জারির বিষয়টিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত রায় সামরিক শাসনামলে জারি হয়নি। সংসদের সম্মতিক্রমে এই সংশোধনী জারি করা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের এ আদেশে আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচন এ ধরনের সরকারের মাধ্যমেই হতে হবে। এ ধরনের আদেশ অনেকের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত। কারণ একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করা হলো, অন্যদিকে আগামী দুই নির্বাচন এ ধরনের সরকারের মাধ্যমেই হওয়ার নির্দেশ পরস্পরবিরোধী বা সাংঘর্ষিক। প্রধান আইনবিদরাও এ কথা বলেছেন। বিদায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চই এ ধরনের আদেশ দিয়েছেন। এ আদেশ যেন বৈধ-অবৈধের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। কালোও যে কিছু সময়ের জন্য সাদা হতে পারে, সেই তত্ত্ব জানা গেল। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এই তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রথম রায়ে ডকট্রিন অব নেসেসিটি তত্ত্বকেই মেনে নিয়েছেন। তাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল। নির্বাহী বিভাগের ক্ষেত্রেও এ ধরনের উদাহরণ রয়েছে। কালো টাকাকে বৈধ করার সুযোগ প্রদান এর অন্যতম। অন্য একটি উদাহরণ হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ট্রুথ কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের অনুকম্পা প্রদর্শন। আদালত অবশ্য এই আইন ও প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। জানা গেছে, এই কমিশনের সিদ্ধান্তের বলে যারা দায়মুক্তি পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এখন দুদক তদন্ত চালু করবে।
সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণার রায় দু-একটি মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্নটি হলো, ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রবণতা রোধ করার উপায় কী? সংবিধান সংশোধন-সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে বের করতে ব্যস্ত। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের জন্য সামরিক শাসকদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করে তাঁদের শাস্তি দেওয়ার বিধান-সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা যায় কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। অপরাধ দমনের জন্য বহু আইন প্রচলিত রয়েছে। তা সত্ত্বেও অপরাধের সংখ্যা ও মাত্রা যে হ্রাস পায়নি, তা সর্বজনস্বীকৃত। আইন প্রণয়ন করে সামরিক শাসন জারি বন্ধ করা যাবে কি না, এ বিষয়েও অনেকে সন্দিহান।
দক্ষিণ এশীয় দুটি দেশে সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এ ধরনের শাসন প্রবর্তনের সুযোগ সামরিক বাহিনী তখনই গ্রহণ করে, যখন প্রচলিত শাসনব্যবস্থা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা ব্যর্থ হলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে এই কারণের সঙ্গে অন্য একটি কারণও যুক্ত করা সম্ভব। আর তা হলো, উচ্চতর সামরিক কর্মকর্তাদের উচ্চাভিলাষ। এর কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল ১৯৭৫ সালের প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান। এ ঘটনাটিই সুযোগ করে দেয় ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য পরবর্তী অভ্যুত্থানের। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ ধরনের অভ্যুত্থানের ফলে অন্য কয়েকটি বিষয়ও দৃশ্যমান হয়_১. তথাকথিত জনগণের সমর্থন। অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে। এ জন্য বলা হয়, ৭ নভেম্বর ছিল সিপাহি জনতার বিপ্লব। ২. পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায়, রাজনৈতিক কিছু নেতার প্রথমে গোপনে, পরে প্রকাশ্যে প্রধান সামরিক শাসকের আনুগত্য লাভের প্রচেষ্টা। এ বিষয়টিই প্রধান সামরিক শাসককে নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টিতে উৎসাহী করে। পরবর্তী দৃশ্য হলো, প্রথমে রেফারেন্ডাম, পরে সংসদীয় নির্বাচন। মাঝখানে হয় স্থানীয় সরকার প্রথার সংস্কার। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রধান সামরিক শাসক জাতীয় রাজনীতিতে কয়েক বছরের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করেন। এসব ক্ষেত্র যে সামরিক শাসনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়, সংশ্লিষ্ট সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনাপ্রবাহই এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
অন্যদিকে নতুন করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা দেওয়ার কি প্রয়োজন রয়েছে? এ প্রশ্নটিই মুখ্য। কারণ প্রচলিত দণ্ডবিধিসহ সামরিক আইনেও শাস্তি প্রদানের বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষমতা প্রথমে নির্বাহী বিভাগের, পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট আদালতের। প্রাথমিকভাবে সামরিক শাসনামলে প্রচলিত নির্বাহী বিভাগ যে এ ধরনের প্রক্রিয়া চালু করতে সক্ষম নয়, তা সর্বজনবিদিত। আদালতের পক্ষেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব নয়। কারণ একই। সামরিক শাসনামলে উভয় বিভাগই সামরিক আইন সাপেক্ষেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে বাধ্য হয়। আইন প্রয়োগ করার সফলতা বা সামর্থ্য বল প্রয়োগের ক্ষমতার ওপরই নির্ভরশীল। সংবিধান এবং প্রচলিত আইন অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারও একচেটিয়া বল প্রয়োগের ক্ষমতায় ক্ষমতাবান। তবে এ ক্ষেত্রে বল প্রয়োগ করতে হয় সংবিধান এবং প্রচলিত আইন সাপেক্ষে। সামরিক আইনে এসবের বালাই নেই। অন্যায়ভাবে বল প্রয়োগ করলেও তার কোনো প্রতিকার নেই। সংবিধান অক্ষুণ্ন থাকলে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব।
সর্বোচ্চ আদালত যে সামরিক শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন, এ বিষয়টি অতীতের দুই সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভবিষ্যতের জন্য এটা অবৈধ কিভাবে হবে? বিষয়টি চিরতরে বন্ধ করার উপায় একটাই। আর তা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলসহ সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্বশীলতা। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে চারবার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পর্যায়ক্রমে ক্ষমতাসীন ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংঘাতময় রাজনৈতিক ধারা বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। ১৯৯১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ে বিষয়টি তুঙ্গে ওঠে ২০০৬ সালে। এর আগে ১৯৯৫-৯৬ সালে। ১৯৯৬ সালে ওই ধারা সাময়িকভাবে প্রশমিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথার সাংবিধানিক স্বীকৃতির মাধ্যমে। অচিরেই তা বিলীন হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে সংঘাতময় রাজনৈতিক ধারা ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর কিছু না হোক, ২০০৮ সালের সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়।
এরপর সংঘাতের ধারা দৃশ্যমান। ১৯৯৫-৯৬ সালের মতো সংসদও অচল বা অকার্যকর। সাধারণ ভোটাররা এর জন্য দায়ী নয়। দায়ী কে বা কারা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সর্বোচ্চ আদালতের সংশ্লিষ্ট আদেশ এবং প্রাসঙ্গিক মন্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ যদি রাজনৈতিক দলগুলো গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভবিষ্যতে অসাংবিধানিক সরকার যে ক্ষমতা গ্রহণ করবে না, তা নিশ্চিত নয়। নির্বাচিত ক্ষমতাসীন সরকারসহ প্রধান বিরোধী দল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল যদি ক্ষমতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তাহলে তা হবে রাজনৈতিক ক্রমবিকাশ তথা সুশাসনের জন্য একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বা প্রক্রিয়া। সর্বোচ্চ আদালত সুস্থ রাজনৈতিক ক্রমবিকাশের জন্য পরিপূরক শক্তি হিসেবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বর্তমানে এ উপলব্ধিই জরুরি।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের
সাবেক উপদেষ্টা
No comments