সরকারের ঋণ -সার্বভৌম বন্ড, ভাবতে হবে এখনই by মোশাহিদা সুলতানা
বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক বাজারে সার্বভৌম বন্ড ছাড়ার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে যাচাই-বাছাই ও গবেষণার জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। এক মাসের মধ্যে কমিটি একটি রিপোর্ট প্রদান করবে, যার ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কী প্রক্রিয়ায়, কত সুদে এবং কোন বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণের উদ্দেশ্য নিয়ে এই বন্ড ছাড়া হবে।
বাংলাদেশ এর আগে কখনো সার্বভৌম বন্ড আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে ছাড়েনি। সম্প্রতি তেলের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আমদানির খরচ বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স হ্রাস এবং টাকার অবমূল্যানের কারণে এক দিকে যেমন ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতি তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে দেশীয় ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ার কারণে ব্যাংকের তারল্য হ্রাস পেয়েছে। যদিও জানুয়ারি মাসে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেড়েছে কিন্তু একদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস এবং অন্যদিকে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সৃষ্ট জটিলতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহের গতি ব্যাহত হয়েছে। এ অবস্থায় নীতিনির্ধারক মহল বিকল্প অর্থায়নের উৎস-সন্ধান করতে গিয়ে উচ্চসুদে সার্বভৌম ঋণের কথা ভাবছে। দাতা সংস্থার প্রদত্ত ঋণের শর্তের সঙ্গে তুলনা করার আগে এবং এ সময়ে নিলে ভালো হবে না অন্য সময়ে নিলে ভালো হবে, তা বিবেচনা করার আগে বেশি প্রয়োজন খতিয়ে দেখা যে সার্বভৌম ঋণের ঝুঁকিগুলো আসলে কী এবং একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এই বন্ড বাজারে চালু করার ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে।
সার্বভৌম বন্ড একটি বিশেষ ধরনের বন্ড, যা সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে বিক্রি করার অধিকার রাখে এবং এর মধ্য দিয়ে সেই রাষ্ট্র অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতি মোকাবিলায় কাজে লাগায়। সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে গেলে অনেক দেশ সার্বভৌম বন্ড চালু করে সাধারণত এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থ জোগায়। যদিও বাংলাদেশে সব বন্ডকেই সার্বভৌম বন্ড বলার প্রচলন আছে, তবুও সরকারের ইস্যু করা অন্যান্য বন্ডের সঙ্গে নতুন ধরনের সার্বভৌম বন্ডের পার্থক্য আছে। সরকারি বন্ড কেনাবেচা হয় টাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে আর সার্বভৌম বন্ড কেনাবেচা হয় বৈদেশিক মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাজারে এবং এর ক্রেতা হতে পারে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দেশ ও আন্তর্জাতিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলো।
প্রথমত, অন্যতম আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি, Moodz's Investors Service-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং এখন ba3 যা ফিলিপাইনের সমতুল্য, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ওপরে এবং ভারতের নিচে। ক্রেডিট রেটিং কত, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারে এই বন্ডের চাহিদা ও মূল্য। আর ক্রেডিট রেটিং নির্ভর করে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। ক্রেডিট রেটিং নির্ণয়ের জন্য মূলত দেখা হয় অর্থনৈতিক নীতিগুলো বাজার অর্থনীতির নীতি বা উদার, মুনাফাকেন্দ্রিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না। অর্থাৎ বেসরকারীকরণ, উৎপাদনশীল খাতে ব্যয়, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার থেকে আয়ের নিশ্চয়তা, বাণিজ্যে ও পুঁজিবাজারে উদারনীতি অনুসরণ এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা ক্রেডিট রেটিং বাড়াতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়ত, সাধারণভাবে যদি দেখি যে একজন বিনিয়োগকারী কী কী কারণে একটা দেশের সার্বভৌম বন্ড কিনতে আগ্রহী হবেন, তাহলে দেখা যাবে যে বিনিয়োগকারীরা চাইবেন যাতে তিনি স্বল্প বিনিয়োগ করে অধিক লাভ করতে পারেন। তাই যদি হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা জানতে চাইবেন তাঁর টাকা নিয়ে বন্ড বিক্রেতা লাভজনক খাতে ব্যয় করছেন কি না। সরকার যদি এই টাকা নিয়ে এমন কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে, যার জন্য সরকারকে লাভ করতে হবে না; বরং নাগরিক সুবিধা দিতে গিয়ে লোকসান করতে হবে, তাহলে বিনিয়োগকারী তাতে আকৃষ্ট হবেন না। তাহলে দেখা যাচ্ছে সার্বভৌম বন্ড বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে এর চাহিদা ধরে রাখার জন্য সরকারকে জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় কমিয়ে সেই অর্থ লাভজনক খাতে ব্যয় করতে হবে। এ কারণেই দেখা গেছে, আর্জেন্টিনা ও গ্রিস সরকারকে খরচ কমাতে গিয়ে বেসরকারীকরণ ও জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য করা হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে হয়তো পড়তে চায়নি গ্রিস বা আর্জেন্টিনা কিন্তু বাস্তবতা এমন পর্যায়ে গেছে যে ঋণের বোঝা সামলাতে না পেরে এর দায় জনগণের ওপরই পড়েছে। এখন ধরে নিলাম যে এই বন্ড বিক্রির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগকারীদের সুনজরে থাকা জরুরি। তাই সরকার দেশে উদারনীতি গ্রহণে আগ্রহী। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকে কি তার নিজের দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না যে সরকার বন্ড বিক্রির টাকা দিয়ে জনগণের জন্য কী কল্যাণ বয়ে আনবে?
তৃতীয়ত, স্বল্পমেয়াদি সার্বভৌম বন্ডের একটা নেতিবাচক দিক আছে, যার জন্য এ ধরনের বন্ডের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। ধরে নিলাম বাংলাদেশ একটি বন্ড বিক্রি করল, যার এক বছর পর থেকে বাংলাদেশকে বন্ডের লিখিত অঙ্গীকার অনুযায়ী সরকারি কোষাগার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার বিনিয়োগকারীকে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি এমন কোনো প্রজেক্ট হাতে নেয়, যার থেকে আয় সরকারি কোষাগারে জমা হতে সময় লাগবে পাঁচ বছর, তখন বাংলাদেশের জন্য এই টাকা পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়বে এবং তখন অন্য খাতে ব্যয় কমিয়ে সেই টাকা পরিশোধ করতে হবে। আমাদের দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার কারণে অনেক প্রজেক্ট মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। এমনকি অনেক প্রজেক্ট অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় দিনের পর দিন পড়ে থাকে। আবার অনেক সময় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, মেশিন ইত্যাদি কিনতে গিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র পেতে দেরি হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় সামগ্রী চড়া মূল্যে কিনে থাকে। এসব কারণে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা হতে বিলম্ব হয়। বাংলাদেশকে যখন এই কঠোর শর্ত মেনে সময়মতো অর্থ পরিশোধ করতে হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাবে এবং অর্থ পরিশোধে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এ সমস্যাটিকে বলা হয় ম্যাচিউরিটি মিসম্যাচ অর্থাৎ ম্যাচিউরিটির সময়ের ভিন্নতার কারণে উদ্ভূত ঝুঁকি। অনেকে বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের চাপ থাকলে সরকার নিজস্ব আগ্রহেই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু আগের অনেক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের অসংখ্য চাপের সম্মুখীন হয়েও সরকারের এডিপি বাস্তবায়ন সময়মতো হয়নি, দাতাদের দেওয়া অনেক টাকা বাস্তবায়নের অভাবে ফেরত দিতে হয়েছে এবং যেসব ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ প্রয়োজন ছিল, সেসব ক্ষেত্রে জনগণকেই বর্ধিত মূল্যে জিনিস ও সেবা কিনতে হয়েছে। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে রোডস, হাইওয়ে, ট্রান্সপোর্ট ও জ্বালানি খাতে বিলম্বিত প্রজেক্ট বাস্তবায়ন। ভবিষ্যতে যদি সরকারের কোষাগারে সময়মতো ট্যাক্স জমা না হয়, আজকের বিক্রীত বন্ডের খেসারত যাঁরা বন্ড বিক্রির সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁদের নিতে হবে না, নিতে হবে খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদেরই।
চতুর্থত, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে, টাকার অবমূল্যায়ন হলে, পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে, বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ওপর কোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ তৈরি হলে বন্ডের চাহিদা কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যদি ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে তাহলে একটা ঋণ পরিশোধ করতে আরেকটা ঋণ নিতে হবে এবং তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেডিট রেটিং কমে গেলে বাংলাদেশকে আরও অধিক সুদে বন্ড বিক্রি করতে হবে। যদিও বাংলাদেশের অবস্থা ১৯৯৮ সালে রাশিয়ার মতো, ১৯৯৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার মতো, আশির দশকে ইন্দোনেশিয়ার মতো এবং সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিসের মতো একই ফর্মুলা মেনে না-ও হতে পারে কিন্তু আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কাকে নিছক দূরবর্তী ঝুঁকি মনে করে এড়িয়ে গেলে চলবে না। জনগণকে জানাতে হবে সরকার বন্ড বিক্রি করে এই অর্থ কী কাজে লাগবে এবং জনগণের সম্মতি থাকতে হবে পরবর্তী সময়ে জনগণ এই ঋণের বোঝায় জর্জরিত হতে চায় কি না। সাত সদস্যের কমিটি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে কি না, তা-ও প্রশ্ন করতে হবে। রাজনীতিবিদদের সৎ ও অসৎ উদ্দেশ্য দুই-ই থাকতে পারে। খুব আশাবাদী হয়েও যদি ধরি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, জনগণের কল্যাণেই সরকার এই পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী। তার পরও দেখতে হবে সৎ উদ্দেশ্য থাকলেই শুধু জনগণের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না, সিদ্ধান্ত নিতে হলে হতে হয় দূরদর্শী। আমরা এই বিশ্বায়নের যুগে পণ্য ও সেবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় টিকতে গিয়ে জনগণকে যাতে ঋণের বোঝা বইতে না হয়, তা নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে এবং ভাবতে হবে এখনই।
মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সার্বভৌম বন্ড একটি বিশেষ ধরনের বন্ড, যা সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে বিক্রি করার অধিকার রাখে এবং এর মধ্য দিয়ে সেই রাষ্ট্র অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঘাটতি মোকাবিলায় কাজে লাগায়। সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে গেলে অনেক দেশ সার্বভৌম বন্ড চালু করে সাধারণত এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যয়ের অর্থ জোগায়। যদিও বাংলাদেশে সব বন্ডকেই সার্বভৌম বন্ড বলার প্রচলন আছে, তবুও সরকারের ইস্যু করা অন্যান্য বন্ডের সঙ্গে নতুন ধরনের সার্বভৌম বন্ডের পার্থক্য আছে। সরকারি বন্ড কেনাবেচা হয় টাকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে আর সার্বভৌম বন্ড কেনাবেচা হয় বৈদেশিক মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাজারে এবং এর ক্রেতা হতে পারে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দেশ ও আন্তর্জাতিক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকগুলো।
প্রথমত, অন্যতম আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি, Moodz's Investors Service-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং এখন ba3 যা ফিলিপাইনের সমতুল্য, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ওপরে এবং ভারতের নিচে। ক্রেডিট রেটিং কত, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারে এই বন্ডের চাহিদা ও মূল্য। আর ক্রেডিট রেটিং নির্ভর করে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। ক্রেডিট রেটিং নির্ণয়ের জন্য মূলত দেখা হয় অর্থনৈতিক নীতিগুলো বাজার অর্থনীতির নীতি বা উদার, মুনাফাকেন্দ্রিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না। অর্থাৎ বেসরকারীকরণ, উৎপাদনশীল খাতে ব্যয়, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার থেকে আয়ের নিশ্চয়তা, বাণিজ্যে ও পুঁজিবাজারে উদারনীতি অনুসরণ এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সক্ষমতা ক্রেডিট রেটিং বাড়াতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয়ত, সাধারণভাবে যদি দেখি যে একজন বিনিয়োগকারী কী কী কারণে একটা দেশের সার্বভৌম বন্ড কিনতে আগ্রহী হবেন, তাহলে দেখা যাবে যে বিনিয়োগকারীরা চাইবেন যাতে তিনি স্বল্প বিনিয়োগ করে অধিক লাভ করতে পারেন। তাই যদি হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা জানতে চাইবেন তাঁর টাকা নিয়ে বন্ড বিক্রেতা লাভজনক খাতে ব্যয় করছেন কি না। সরকার যদি এই টাকা নিয়ে এমন কোনো জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে, যার জন্য সরকারকে লাভ করতে হবে না; বরং নাগরিক সুবিধা দিতে গিয়ে লোকসান করতে হবে, তাহলে বিনিয়োগকারী তাতে আকৃষ্ট হবেন না। তাহলে দেখা যাচ্ছে সার্বভৌম বন্ড বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে এর চাহিদা ধরে রাখার জন্য সরকারকে জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় কমিয়ে সেই অর্থ লাভজনক খাতে ব্যয় করতে হবে। এ কারণেই দেখা গেছে, আর্জেন্টিনা ও গ্রিস সরকারকে খরচ কমাতে গিয়ে বেসরকারীকরণ ও জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য করা হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে হয়তো পড়তে চায়নি গ্রিস বা আর্জেন্টিনা কিন্তু বাস্তবতা এমন পর্যায়ে গেছে যে ঋণের বোঝা সামলাতে না পেরে এর দায় জনগণের ওপরই পড়েছে। এখন ধরে নিলাম যে এই বন্ড বিক্রির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগকারীদের সুনজরে থাকা জরুরি। তাই সরকার দেশে উদারনীতি গ্রহণে আগ্রহী। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারকে কি তার নিজের দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না যে সরকার বন্ড বিক্রির টাকা দিয়ে জনগণের জন্য কী কল্যাণ বয়ে আনবে?
তৃতীয়ত, স্বল্পমেয়াদি সার্বভৌম বন্ডের একটা নেতিবাচক দিক আছে, যার জন্য এ ধরনের বন্ডের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। ধরে নিলাম বাংলাদেশ একটি বন্ড বিক্রি করল, যার এক বছর পর থেকে বাংলাদেশকে বন্ডের লিখিত অঙ্গীকার অনুযায়ী সরকারি কোষাগার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডলার বিনিয়োগকারীকে পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি এমন কোনো প্রজেক্ট হাতে নেয়, যার থেকে আয় সরকারি কোষাগারে জমা হতে সময় লাগবে পাঁচ বছর, তখন বাংলাদেশের জন্য এই টাকা পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়বে এবং তখন অন্য খাতে ব্যয় কমিয়ে সেই টাকা পরিশোধ করতে হবে। আমাদের দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার কারণে অনেক প্রজেক্ট মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। এমনকি অনেক প্রজেক্ট অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় দিনের পর দিন পড়ে থাকে। আবার অনেক সময় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, মেশিন ইত্যাদি কিনতে গিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে ছাড়পত্র পেতে দেরি হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় সামগ্রী চড়া মূল্যে কিনে থাকে। এসব কারণে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা হতে বিলম্ব হয়। বাংলাদেশকে যখন এই কঠোর শর্ত মেনে সময়মতো অর্থ পরিশোধ করতে হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাবে এবং অর্থ পরিশোধে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। এ সমস্যাটিকে বলা হয় ম্যাচিউরিটি মিসম্যাচ অর্থাৎ ম্যাচিউরিটির সময়ের ভিন্নতার কারণে উদ্ভূত ঝুঁকি। অনেকে বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের চাপ থাকলে সরকার নিজস্ব আগ্রহেই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু আগের অনেক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের অসংখ্য চাপের সম্মুখীন হয়েও সরকারের এডিপি বাস্তবায়ন সময়মতো হয়নি, দাতাদের দেওয়া অনেক টাকা বাস্তবায়নের অভাবে ফেরত দিতে হয়েছে এবং যেসব ক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধ প্রয়োজন ছিল, সেসব ক্ষেত্রে জনগণকেই বর্ধিত মূল্যে জিনিস ও সেবা কিনতে হয়েছে। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে রোডস, হাইওয়ে, ট্রান্সপোর্ট ও জ্বালানি খাতে বিলম্বিত প্রজেক্ট বাস্তবায়ন। ভবিষ্যতে যদি সরকারের কোষাগারে সময়মতো ট্যাক্স জমা না হয়, আজকের বিক্রীত বন্ডের খেসারত যাঁরা বন্ড বিক্রির সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁদের নিতে হবে না, নিতে হবে খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদেরই।
চতুর্থত, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে, টাকার অবমূল্যায়ন হলে, পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে, বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ওপর কোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ তৈরি হলে বন্ডের চাহিদা কমে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যদি ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে তাহলে একটা ঋণ পরিশোধ করতে আরেকটা ঋণ নিতে হবে এবং তখন আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রেডিট রেটিং কমে গেলে বাংলাদেশকে আরও অধিক সুদে বন্ড বিক্রি করতে হবে। যদিও বাংলাদেশের অবস্থা ১৯৯৮ সালে রাশিয়ার মতো, ১৯৯৯ থেকে ২০০২ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার মতো, আশির দশকে ইন্দোনেশিয়ার মতো এবং সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিসের মতো একই ফর্মুলা মেনে না-ও হতে পারে কিন্তু আসন্ন অর্থনৈতিক সংকটের আশঙ্কাকে নিছক দূরবর্তী ঝুঁকি মনে করে এড়িয়ে গেলে চলবে না। জনগণকে জানাতে হবে সরকার বন্ড বিক্রি করে এই অর্থ কী কাজে লাগবে এবং জনগণের সম্মতি থাকতে হবে পরবর্তী সময়ে জনগণ এই ঋণের বোঝায় জর্জরিত হতে চায় কি না। সাত সদস্যের কমিটি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে কি না, তা-ও প্রশ্ন করতে হবে। রাজনীতিবিদদের সৎ ও অসৎ উদ্দেশ্য দুই-ই থাকতে পারে। খুব আশাবাদী হয়েও যদি ধরি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে, জনগণের কল্যাণেই সরকার এই পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী। তার পরও দেখতে হবে সৎ উদ্দেশ্য থাকলেই শুধু জনগণের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না, সিদ্ধান্ত নিতে হলে হতে হয় দূরদর্শী। আমরা এই বিশ্বায়নের যুগে পণ্য ও সেবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় টিকতে গিয়ে জনগণকে যাতে ঋণের বোঝা বইতে না হয়, তা নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে এবং ভাবতে হবে এখনই।
মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments