বিশ্ব পরিবেশ দিবস-ব্যাঙের জন্য ভালোবাসা by ড. গাজী এস এম আসমত ও রাজীব নন্দী
বাংলাদেশে পাওয়া গেল আরো এক নতুন প্রজাতির ব্যাঙ। নাম 'রাওরচেস্টিস পারভুলাস' (Raorchestes parvulus)। এটিসহ মোট ৩৮ প্রজাতির ব্যাঙ বাংলাদেশে শনাক্ত করা হলো। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০১১ সালের দিনটি আগে এমন খবর পরিবেশপ্রেমীদের জন্য নিশ্চয় সুখবর।
মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত গাঢ় খয়েরি রঙের পানপাত্রের মতো দাগ, মসৃণ চামড়া, হাত-পায়ের আঙুলের গোল ডগা আর খাঁজকাটা জিভের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এ ব্যাঙগুলো সাধারণত পাহাড়ি বনভূমিতে পাওয়া যায়। বোলেঞ্জার ১৮৯৩ সালে মিয়ানমারের কারিন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত এ প্রজাতির ব্যাঙের নাম দিয়েছিলেন ইঙ্লোস পারভুলাস। শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এর জেনাস ইঙ্লোস, সুডোফাইলেটাস ও ফাইলেটাস হয়ে বর্তমানে হয়েছে রাওরচেস্টিস। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছোট ঝাড়ব্যাঙ নামেই বেশি পরিচিত। বিস্তৃতি মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও লাওসে। ব্যাঙটির শনাক্তকরণ ও প্রজাতি নির্ধারণের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমী অব সায়েন্সেসের বিশিষ্ট উভচর বিজ্ঞানী ড. গুইন ওগান এবং ভারতের আসাম রাজ্যের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ ইন সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলোজির সভাপতি ড. সাবিত্রী চৌধুরী বরদোলইর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে গত ২৫ মে ই-মেইল বার্তায় তাঁরা বাংলাদেশের জন্য এটি নতুন রেকর্ড বলে নিশ্চিত করেছেন।
গত ৩০ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের শিক্ষার্থী অনিমেষ ঘোষ, আবদুর রাকিব ভুঁইয়া, নাবিলা হাসান, তাহমিনা হক এবং ফারজানা আকতার খান ব্যবহারিক ক্লাস চলাকালে খাদিমনগর ফরেস্টের সেগুন বাগানে সেগুনবীজ সংগ্রহের সময় খুঁজে পেয়েছেন ব্যাঙের এই নতুন ধরনের প্রজাতি। বছর চারেক ধরে এক ঝাঁক শিক্ষার্র্থীর উৎসাহে বাংলাদেশে 'ব্যাঙ বিপ্লব' ঘটে গেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদ আলী হাওলাদার গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব প্রাণিবিদ্যার গবেষণায় যোগ করলেন নতুন এক প্রজাতির ব্যাঙ। এর নাম দিয়েছেন 'ফেজারভেরিয়া আসমতি'! প্রাণিবিদ্যা গবেষণায় পৃথিবীর বিখ্যাত জার্নাল 'জুওটেঙ্া' তাঁকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ আবিষ্কারের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এবং ডিনদের কমিটি পৃথকভাবে পুরস্কৃতও করেছে। আইইউসিএনের প্রধান কার্যালয় ২০০৯ সালের ৩ নভেম্বর প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের চারটি ফেজারভেরিয়া ব্যাঙ-প্রজাতির নাম তালিকাভুক্ত করেছে। এ ঘটনায় আমরা গর্বিত, কারণ এ ব্যাঙ চারটির প্রকাশনায় লেখক ছিলেন তিন শিক্ষার্থী। তাঁরা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আরো সুখের কথা হচ্ছে, ব্যাঙগুলো চবি ক্যাম্পাসেও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের তালিকায় নতুন নতুন ব্যাঙের অন্তর্ভুক্তি সত্যিই উল্লেখ্যযোগ্য। ২০০০ সালে আইইউসিএনের কান্ট্রি অফিস যে কয়টি (২২টি) ব্যাঙের নাম তালিকাভুক্ত করেছিল, তা ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে চবি শিক্ষার্থীদের আবিষ্কৃত নতুন আরো ১৬টি ব্যাঙের তালিকাভুক্তির কারণে। পাঁচ-ছয়টি ব্যাঙ এখনো শনাক্তের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত ৩৮ প্রজাতির ব্যাঙ শনাক্ত করা হয়েছে। ওই ব্যাঙ প্রজাতিগুলোর মধ্যে প্রায় ২৩ প্রজাতির ব্যাঙ চবি ক্যাম্পাসকে সারা বছর মাতিয়ে রাখে। বাংলাদেশের অন্য কোনো জায়গা থেকে, এমনকি দিনাজপুর থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এত প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে বিরল প্রজাতির ব্যাঙও আছে। ক্যাম্পাসের জীবভৌগোলিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে যে এত ব্যাঙ বা এর বেশিসংখ্যক প্রজাতির ব্যাঙ এতটুকু এলাকায় থাকার ঘটনা আদৌ আশ্চর্যের নয়। এর কারণ হচ্ছে, চবি ক্যাম্পাসটি ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের খুব কাছাকাছি অংশ। ঘূর্ণিঝড় হলে যেমন এর কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকে, আর আশপাশে অল্প হলেও বাতাসের ঝাপটা লাগে, চবি ক্যাম্পাসের অবস্থানের বিষয়টিও তাই। বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট সিলেটের কোনা থেকে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামান্য অংশ ছুঁয়ে চলে গেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। চবি ক্যাম্পাস বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের অংশ না হলেও বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান হটস্পট বলা যেতে পারে, আর ক্যাম্পাসের হটস্পট হচ্ছে কাটাপাহাড় নামের অংশটি। কাটাপাহাড়টি যদিও তিন-চার জায়গা কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে, তার পরও ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ প্রাণী প্রজাতি এ পাহাড়ের আশপাশ থেকে রেকর্ড করা হয়েছে। সে অর্থে কাটাপাহাড় হচ্ছে সুপার হটস্পট। এ অংশটি সুরক্ষিত হলে নিঃসন্দেহে চবি হতে পারে দেশের প্রধান ব্যাঙ সংরক্ষণাগার। এখনো এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখা না গেলেও আমি আশা করি, ক্যাম্পাসের ভরাট হয়ে যাওয়া নালাগুলো পুনরুদ্ধার হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ পাহাড় সংরক্ষণে মনোযোগ দেবে। জীববৈচিত্র্যের পীঠস্থান চবি ক্যাম্পাসে দ্রুত একটি শক্তিশালী পরিবেশ কমিটি গঠন করা উচিত।
ব্যাঙ রক্ষায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির একটি উপায় আছে, তা হলো ব্যাঙের শঙ্কিত হওয়ার কারণগুলো নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। সোজা কথায়, ব্যাঙের সংখ্যা হ্রাসের ক্রমবর্ধমান উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ, আবহাওয়াগত পরিবর্তন, পানি ও মাটিতে বিভিন্ন এসিড সঞ্চয় এবং নানা ধরনের কীটনাশক, সার ও রাসায়নিকের সংস্পর্শে বিনষ্ট হচ্ছে ভৌত পরিবেশ। অন্যদিকে জৈবনিক পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হচ্ছে বসতি বিনাশ, পরিবর্তন (জলাভূমি ভরাট) ও খণ্ডায়ন, ভিন্ন প্রজাতির অনুপ্রবেশ ঘটানো, অতি আহরণ, রোগ-ব্যাধি, বিকলাঙ্গতা প্রভৃতি। অতএব, ধ্বংসের কারণ প্রতিহত করতে পারলে ব্যাঙের বংশের ধারা থাকবে অব্যাহত। ব্যাঙের বংশ রক্ষায় বিজ্ঞানীদের যে পরামর্শ পাওয়া যায় এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে : ১. বিশেষ করে জলাভূমিসংলগ্ন ক্ষেত-খামারে কীটাঘ্ন ছিটানোর পরিমাণ নিম্নতম মাত্রায় কমিয়ে আনা; ২. দেশি প্রজাতির গাছ রোপণ; ৩. প্রাকৃতিক অঞ্চল সংরক্ষণ করা; ৪. প্লাস্টিক সামগ্রী ফেলে না দিয়ে পুনর্ব্যবহার করা; ৫. বিকলাঙ্গ বা হঠাৎ মরে পড়ে থাকা ব্যাঙের খবর সংশ্লিষ্ট অফিসে পেঁৗছে দেওয়া; ৬. বাড়ির আশপাশে ব্যাঙ-বসতি গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া; ৭. চিড়িয়াখানায় বিপন্ন ব্যাঙ প্রজাতির বংশবৃদ্ধি ঘটানো; ৮. নির্দিষ্ট বন্য পরিবেশে নির্দিষ্ট প্রজাতির ব্যাঙের অনুপ্রবেশ ঘটানো; ৯. ব্যাঙের প্রকৃত বসতি থেকে বহিরাগত প্রজাতি সরিয়ে নেওয়া এবং ১০. সংরক্ষণবাদী সংগঠনে যুক্ত হয়ে ব্যাঙ সম্পর্কে নিজে জানা এবং অন্যকে জানানো। বিপুল সম্ভাবনার মধ্যেও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে শুধু সামান্য অ্যালকোহল, ফরমালিন ও সংগ্রহের পাত্র সরবরাহ ছাড়া আর কোনো সহযোগিতা পাওয়ার আশা করা বাহুল্য। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বা রাসায়নিক কেনার জন্য সরকারি অনুদান কম হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিভাগের পক্ষে সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটি গবেষণা কেন্দ্র আছে, তা থেকে গবেষণার জন্য শিক্ষকদের যে টাকা বরাদ্দ করা হয় তার পরিমাণ যেমন একদিকে কম, অন্যদিকে টাকা পাওয়ার প্রক্রিয়াও দীর্ঘ ও জটিল। এ কারণে শিক্ষকরা ওই কেন্দ্রের অর্থায়নে কাজ করতে আগ্রহী নন। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোনো প্রাণী বা প্রাণিগোষ্ঠীর ওপর সঠিক জরিপ চালানো হয়নি। বাংলাদেশের গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে পারলে আরো অনেক প্রজাতি আবিষ্কৃত হবে, অসংখ্য পরিবেশিক রহস্যের দিক উন্মোচন হবে। পরিবেশ টিকলে ব্যাঙ টিকবে, ব্যাঙ বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে। মানুষের টিকে থাকার জন্যই ব্যাঙ বাঁচানো আজ আমাদের জাতীয় কর্তব্য। আমরা আশা করি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে ব্যাঙ গবেষণার এই আকুতি জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত পেঁৗছবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি ব্যাঙ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষিত হবে।
লেখক যথাক্রমে : অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। gasmat@gmail.com, এবং সাংবাদিক ও সাবেক শিক্ষার্র্থী; যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। rajib1nandy@yahoo.com
গত ৩০ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের শিক্ষার্থী অনিমেষ ঘোষ, আবদুর রাকিব ভুঁইয়া, নাবিলা হাসান, তাহমিনা হক এবং ফারজানা আকতার খান ব্যবহারিক ক্লাস চলাকালে খাদিমনগর ফরেস্টের সেগুন বাগানে সেগুনবীজ সংগ্রহের সময় খুঁজে পেয়েছেন ব্যাঙের এই নতুন ধরনের প্রজাতি। বছর চারেক ধরে এক ঝাঁক শিক্ষার্র্থীর উৎসাহে বাংলাদেশে 'ব্যাঙ বিপ্লব' ঘটে গেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদ আলী হাওলাদার গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব প্রাণিবিদ্যার গবেষণায় যোগ করলেন নতুন এক প্রজাতির ব্যাঙ। এর নাম দিয়েছেন 'ফেজারভেরিয়া আসমতি'! প্রাণিবিদ্যা গবেষণায় পৃথিবীর বিখ্যাত জার্নাল 'জুওটেঙ্া' তাঁকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ আবিষ্কারের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এবং ডিনদের কমিটি পৃথকভাবে পুরস্কৃতও করেছে। আইইউসিএনের প্রধান কার্যালয় ২০০৯ সালের ৩ নভেম্বর প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের চারটি ফেজারভেরিয়া ব্যাঙ-প্রজাতির নাম তালিকাভুক্ত করেছে। এ ঘটনায় আমরা গর্বিত, কারণ এ ব্যাঙ চারটির প্রকাশনায় লেখক ছিলেন তিন শিক্ষার্থী। তাঁরা সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আরো সুখের কথা হচ্ছে, ব্যাঙগুলো চবি ক্যাম্পাসেও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের তালিকায় নতুন নতুন ব্যাঙের অন্তর্ভুক্তি সত্যিই উল্লেখ্যযোগ্য। ২০০০ সালে আইইউসিএনের কান্ট্রি অফিস যে কয়টি (২২টি) ব্যাঙের নাম তালিকাভুক্ত করেছিল, তা ইতিমধ্যে বাতিল হয়ে গেছে চবি শিক্ষার্থীদের আবিষ্কৃত নতুন আরো ১৬টি ব্যাঙের তালিকাভুক্তির কারণে। পাঁচ-ছয়টি ব্যাঙ এখনো শনাক্তের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত ৩৮ প্রজাতির ব্যাঙ শনাক্ত করা হয়েছে। ওই ব্যাঙ প্রজাতিগুলোর মধ্যে প্রায় ২৩ প্রজাতির ব্যাঙ চবি ক্যাম্পাসকে সারা বছর মাতিয়ে রাখে। বাংলাদেশের অন্য কোনো জায়গা থেকে, এমনকি দিনাজপুর থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এত প্রজাতির ব্যাঙ পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে বিরল প্রজাতির ব্যাঙও আছে। ক্যাম্পাসের জীবভৌগোলিক অবস্থান পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে যে এত ব্যাঙ বা এর বেশিসংখ্যক প্রজাতির ব্যাঙ এতটুকু এলাকায় থাকার ঘটনা আদৌ আশ্চর্যের নয়। এর কারণ হচ্ছে, চবি ক্যাম্পাসটি ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের খুব কাছাকাছি অংশ। ঘূর্ণিঝড় হলে যেমন এর কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকে, আর আশপাশে অল্প হলেও বাতাসের ঝাপটা লাগে, চবি ক্যাম্পাসের অবস্থানের বিষয়টিও তাই। বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট সিলেটের কোনা থেকে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামান্য অংশ ছুঁয়ে চলে গেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। চবি ক্যাম্পাস বায়োডাইভার্সিটি হটস্পটের অংশ না হলেও বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান হটস্পট বলা যেতে পারে, আর ক্যাম্পাসের হটস্পট হচ্ছে কাটাপাহাড় নামের অংশটি। কাটাপাহাড়টি যদিও তিন-চার জায়গা কেটে রাস্তা বানানো হয়েছে, তার পরও ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ প্রাণী প্রজাতি এ পাহাড়ের আশপাশ থেকে রেকর্ড করা হয়েছে। সে অর্থে কাটাপাহাড় হচ্ছে সুপার হটস্পট। এ অংশটি সুরক্ষিত হলে নিঃসন্দেহে চবি হতে পারে দেশের প্রধান ব্যাঙ সংরক্ষণাগার। এখনো এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখা না গেলেও আমি আশা করি, ক্যাম্পাসের ভরাট হয়ে যাওয়া নালাগুলো পুনরুদ্ধার হয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ পাহাড় সংরক্ষণে মনোযোগ দেবে। জীববৈচিত্র্যের পীঠস্থান চবি ক্যাম্পাসে দ্রুত একটি শক্তিশালী পরিবেশ কমিটি গঠন করা উচিত।
ব্যাঙ রক্ষায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির একটি উপায় আছে, তা হলো ব্যাঙের শঙ্কিত হওয়ার কারণগুলো নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। সোজা কথায়, ব্যাঙের সংখ্যা হ্রাসের ক্রমবর্ধমান উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ, আবহাওয়াগত পরিবর্তন, পানি ও মাটিতে বিভিন্ন এসিড সঞ্চয় এবং নানা ধরনের কীটনাশক, সার ও রাসায়নিকের সংস্পর্শে বিনষ্ট হচ্ছে ভৌত পরিবেশ। অন্যদিকে জৈবনিক পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হচ্ছে বসতি বিনাশ, পরিবর্তন (জলাভূমি ভরাট) ও খণ্ডায়ন, ভিন্ন প্রজাতির অনুপ্রবেশ ঘটানো, অতি আহরণ, রোগ-ব্যাধি, বিকলাঙ্গতা প্রভৃতি। অতএব, ধ্বংসের কারণ প্রতিহত করতে পারলে ব্যাঙের বংশের ধারা থাকবে অব্যাহত। ব্যাঙের বংশ রক্ষায় বিজ্ঞানীদের যে পরামর্শ পাওয়া যায় এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে : ১. বিশেষ করে জলাভূমিসংলগ্ন ক্ষেত-খামারে কীটাঘ্ন ছিটানোর পরিমাণ নিম্নতম মাত্রায় কমিয়ে আনা; ২. দেশি প্রজাতির গাছ রোপণ; ৩. প্রাকৃতিক অঞ্চল সংরক্ষণ করা; ৪. প্লাস্টিক সামগ্রী ফেলে না দিয়ে পুনর্ব্যবহার করা; ৫. বিকলাঙ্গ বা হঠাৎ মরে পড়ে থাকা ব্যাঙের খবর সংশ্লিষ্ট অফিসে পেঁৗছে দেওয়া; ৬. বাড়ির আশপাশে ব্যাঙ-বসতি গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া; ৭. চিড়িয়াখানায় বিপন্ন ব্যাঙ প্রজাতির বংশবৃদ্ধি ঘটানো; ৮. নির্দিষ্ট বন্য পরিবেশে নির্দিষ্ট প্রজাতির ব্যাঙের অনুপ্রবেশ ঘটানো; ৯. ব্যাঙের প্রকৃত বসতি থেকে বহিরাগত প্রজাতি সরিয়ে নেওয়া এবং ১০. সংরক্ষণবাদী সংগঠনে যুক্ত হয়ে ব্যাঙ সম্পর্কে নিজে জানা এবং অন্যকে জানানো। বিপুল সম্ভাবনার মধ্যেও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ থেকে শুধু সামান্য অ্যালকোহল, ফরমালিন ও সংগ্রহের পাত্র সরবরাহ ছাড়া আর কোনো সহযোগিতা পাওয়ার আশা করা বাহুল্য। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বা রাসায়নিক কেনার জন্য সরকারি অনুদান কম হওয়ায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিভাগের পক্ষে সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একটি গবেষণা কেন্দ্র আছে, তা থেকে গবেষণার জন্য শিক্ষকদের যে টাকা বরাদ্দ করা হয় তার পরিমাণ যেমন একদিকে কম, অন্যদিকে টাকা পাওয়ার প্রক্রিয়াও দীর্ঘ ও জটিল। এ কারণে শিক্ষকরা ওই কেন্দ্রের অর্থায়নে কাজ করতে আগ্রহী নন। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোনো প্রাণী বা প্রাণিগোষ্ঠীর ওপর সঠিক জরিপ চালানো হয়নি। বাংলাদেশের গবেষকরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে পারলে আরো অনেক প্রজাতি আবিষ্কৃত হবে, অসংখ্য পরিবেশিক রহস্যের দিক উন্মোচন হবে। পরিবেশ টিকলে ব্যাঙ টিকবে, ব্যাঙ বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে। মানুষের টিকে থাকার জন্যই ব্যাঙ বাঁচানো আজ আমাদের জাতীয় কর্তব্য। আমরা আশা করি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে ব্যাঙ গবেষণার এই আকুতি জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত পেঁৗছবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি ব্যাঙ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষিত হবে।
লেখক যথাক্রমে : অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। gasmat@gmail.com, এবং সাংবাদিক ও সাবেক শিক্ষার্র্থী; যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। rajib1nandy@yahoo.com
No comments