একাত্তরের কামান্না ট্র্যাজেডি-জাহিদ রহমান by জাহিদ রহমান

কাত্তরে 'কামান্না ট্র্যাজেডি' মাগুরাবাসীর হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ তৈরি করেছিল তা আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি। ডিসেম্বরে পাক হানাদারদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যখন দরজায় কড়া নাড়ছিল ঠিক তখনই বজ্রপাতের মতো আচমকা সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে, শ্রীপুর থানার নিকটবর্তী শৈলকূপা থানার কামান্না গ্রামে হাজীপুর আঞ্চলিক বাহিনীর ২৭ জন টগবগে কিশোর ও তরুণ মুক্তিযোদ্ধা পাক বাহিনীর চোরাগোপ্তা হামলায় নির্মমভাবে শহীদ হয়েছেন।


স্বভাবতই এই খবরে চারদিকে কান্নার রোল পড়ে। এক সঙ্গে এত মুক্তিযোদ্ধার প্রাণহানির ঘটনায় বিষাদের কালো ছায়া নেমে আসে সর্বত্র। শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে গোটা মাগুরার জনপদ। শোকার্ত মা-বাবা আর স্বজনদের দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে 'অপারেশন সার্চলাইট' শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একতরফাভাবে নিরীহ বাঙালির ওপর আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধের সূচনা করে পাক হানাদাররা। দেশজুড়ে নেমে আসে ভয়াবহ এক অবস্থা। সারাদেশের মতো মুক্তিযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহকুমাতেও। এই মহকুমার মাগুরা সদর, শ্রীপুর, শালিখা এবং মোহাম্মদপুর_ এই চার থানাতেও মুক্তিযোদ্ধারা জোর প্রতিরোধে নামে। মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কুমার নদের পাড়ে অবস্থিত কামান্না গ্রামে কামান্না মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন মাধব চন্দ্র ভৌমিকের ফেলে যাওয়া বাড়িতে হাজীপুরের আঞ্চলিক বাহিনীর নেতৃত্বে সশস্ত্র অবস্থান নেন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ২৬ নভেম্বর কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে সবার অলক্ষ্যে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কয়েক পল্গাটুন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর নির্মম হামলা চালায়। ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্তে ভেসে যায় চারদিক। পাক আর্মিদের হামলায় মোট ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার নির্মম মৃত্যু ঘটে। বাদবাকিরা ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান। আহত হন বেশ কয়েকজন মুক্তিসেনা। রাতে মূল ক্যাম্পে না থাকার কারণে অনেকেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে ভেসে যায় কামান্নার মাটি। জন্ম হয় এক রক্তাক্ত ইতিহাসের। মুহূর্তেই এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ে শৈলকূপা, শ্রীপুর, মাগুরাসহ সর্বত্র। লোকমুখে কামান্নার ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়ে হাজীপুর এবং অন্যান্য গ্রামে। এমন সংবাদে ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে যায়। কিন্তু পুনরায় পাক সেনাদের হামলার ভয়ে সবাই যেন শোক বুকে চেপে ধরে রাখে। এদিকে পাক হানাদাররা চলে যাওয়ার পর কামান্না ও আশপাশের গ্রামের সাহসী সাধারণ জনগণ এবং বেঁচে থাকা সহযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধাদের লাশগুলো উদ্ধার করে কামান্না স্কুলের ডান পাশে তিনটি গণকবর খুঁড়ে শায়িত করেন। শুধু গুরুতর আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা দাইরপোলের আবদুর রাজ্জাক ওরফে রাজা মিয়া পরের দিন মারা যাওয়ায় তার লাশ বাড়িতেই কবর দেওয়া হয়। এও ঠিক, সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ সব মুক্তিযোদ্ধা এবং বিএলএফের মুক্তিযোদ্ধা দলটি কামান্নাতে অবস্থান করলে ইতিহাস হয়তো অন্যভাবেও রচিত হতে পারত। হয়তো সেদিন মুক্তিযোদ্ধা নয়, পাকিস্তানি সৈন্যদের লাশেই ছেয়ে যেত পুরো কামান্না গ্রাম।
কামান্নায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই ছিলেন দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। সেই দরিদ্রতা এখনও দৃশ্যমান। যে জরাজীর্ণ ঘর থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন সেই ঘর আগের মতোই আছে। তাদের পরিবারের ভাগ্যের কোনো বদলই হয়নি। শুধু তাই নয়, কামান্নার শহীদ যোদ্ধাদের বেশিরভাগ পরিবারই নানা বঞ্চনার শিকার। অভাব-অনটনে জর্জরিত এক শহীদ যোদ্ধার মা শেষ জীবনে ভিক্ষা করেছেন, এমন তথ্য আমাদের বিস্মিত না করে পারে না।
জাহিদ রহমান : সাংবাদিক এবং প্রধান নির্বাহী মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা গবেষণা কেন্দ্র

No comments

Powered by Blogger.