কল্পকথার গল্প-সবাই যেন মোটামুটি ভালো থাকি by আলী হাবিব

চিকিৎসাবিজ্ঞানের হিসাব অনুযায়ী মোটা হয়ে যাওয়াটা একটি রোগ। অর্থাৎ মোটা হয়ে যাওয়া কিংবা মুটিয়ে যাওয়া ভালো নয়। এটা তো এখন একটা রোগ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। যদিও এই রোগের পেছনে নানা কারণ আছে। বলা হয়ে থাকে, কোমরের মাপ যত বেশি হবে, জীবনের মাপ ততটাই কমে যাবে। কেউ কেউ বংশগতির ধারায় মুটিয়ে যেতে পারেন। কেউ কেউ মোটা হয়ে যান নিজের দোষে। বিশ্বের কত মানুষ এই রোগে ভুগছে? এর সঠিক পরিসংখ্যান


পাওয়া সহজ নয়। মানুষের জন্য মুটিয়ে যাওয়াটা রোগ। মুটিয়ে গেলে মানুষের জীবনরেখা যেমন ছোট হয়ে যায়, তেমনি শরীরে বাসা বাঁধে নানা রোগ।
কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে, মোটাদের দিন ফুরিয়েছে। একেবারেই কি ফুরিয়েছে? সংসারে মোটাদের কদর একেবারে বোধ হয় ফুরিয়ে যায়নি। বিশেষ করে বলা যেতে পারে, এখন বাজারে যে মোটাদের দাম বেশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে, এগুলো হচ্ছে মোটা গরু। এই গরু আবার এমনিতে মোটা হয়নি। মোটা করা হয়েছে। বেশি দামের আশায় মোটাতাজা করা গরু কোরবানির হাটে তোলা হচ্ছে। কিন্তু মোটাতাজা গরুও নাকি বরাবরের মতো এবারের হাটে বেশি দামে বিকোচ্ছে না। কাঙ্ক্ষিত দাম বিক্রেতাদের অনেকেই পাচ্ছেন না। বাড়িতে মোটাতাজা গরুর যে দাম হয়েছিল, কোরবানির পশুর হাটে তার চেয়ে দাম কম।
পশু মোটাতাজা করার ব্যবসাটা একেবারে নতুন নয়। ইতিহাসে পাওয়া যায়, প্রাচীন মিসরে বেশি বেশি খাইয়ে হাঁস মোটাতাজা করা হতো। সূত্রটা খুব সহজ। বেশি খেলে মানুষ যদি মোটা হতে পারে, অন্য কোনো প্রাণীকে কেন বেশি বেশি খাইয়ে মোটা করা যাবে না? যাবে। কিন্তু মানুষের বুদ্ধি বলে কথা! মানুষ পশু মোটাতাজা করাটাকে একটা ব্যবসা হিসেবে নিয়ে নিল। ব্যবসাটা খারাপ নয়। কয়েক মাসের চেষ্টায় যদি একটা গরু মোটা করে দ্বিগুণ দাম পাওয়া যায়, তো মন্দ কী? কিন্তু চাইলেই তো আর পশু মোটা করা যায় না! মানুষের মোটা হওয়ার সহজ পথ আছে। ১০ ধরনের খাবার আছে, যা মানুষের শরীরকে সহজেই মোটা করে দিতে পারে। সেসব খাবার খেয়ে মানুষ মুটিয়ে যাচ্ছে। মোটা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে মোটাদের চিকন হওয়ার প্রতিযোগিতা। সকাল-বিকেল হেঁটে, ডায়েটিং করে এবার চিকন হওয়ার চেষ্টা। সেই চেষ্টায় কতজন সফল হতে পারছে, সেটা অবশ্য গবেষণার বিষয়। কিন্তু এটা ঠিক যে মোটা মানুষ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা। বাড়ছে সমস্যা। সমাজ-সংসারে মোটা মানুষ এখন বড় সমস্যা।
মোটা হওয়াটা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এ নিয়ে তো ছোটদের একটা মজার গল্প আছে। এক ব্যাঙ একবার একটা হাতি দেখল। সেই ব্যাঙ বাড়িতে ফিরে তার বাচ্চাদের সেই হাতির গল্প শোনাতে গেল। হাতির বর্ণনা দিচ্ছিল সে। বাচ্চাদের সে জানাল, আজ সে বাইরে গিয়ে একটা অদ্ভুত জানোয়ার দেখেছে। জনোয়ারটার পা অনেক মোটা। কেমন তার শুঁড়, কেমন কান_সব কথা বলার পর বলল, জানোয়ারটা অনেক মোটা। কেমন মোটা? ব্যাঙটা বেশ করে বাতাস নিয়ে পেটটা ফুলিয়ে বলল, এই এত মোটা। বাচ্চারা বলল, এ তো বেশি মোটা নয়। ব্যাঙটা আরো বেশি বাতাস পেটে ঢুকিয়ে পেট মোটা করে বলল, এই এত মোটা। কিন্তু যে প্রাণীটার অতবড় শুঁড়, অমন পাখার মতো কান, তার শরীর কেন অত ছোট হবে? ব্যাঙের বাচ্চাদের কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। ব্যাঙটিও ছাড়ার পাত্র নয়। সে আবার বাতাস নিয়ে পেটটি ফুলিয়ে বলল, এই এত মোটা। কিন্তু এবার তার নিজেরই পছন্দ হলো না। সে আবার বাতাস নিয়ে পেট ফোলাতে গেল। বেশি বাতাস নেওয়ায় একসময় পেট ফেটে মরেই গেল সে। হাতি যে কত মোটা তা আর দেখানো হলো না তার। মোটা মানুষদেরও এমন অপমৃত্যুর আশঙ্কা কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যায় না। পরিসংখ্যান তেমনটিই বলছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোটা মানুষদেরও এমন সমস্যা হতে পারে।
মোটা মানুষের অনেক সমস্যা। মোটাদের সহজে কেউ দলে নিতে চায় না। মোটা মানুষ পরিশ্রম করতে পারে না। মোটা মানুষ আরামপ্রিয় হয়। কাজ দেখলে পিছিয়ে আসে। কাজেই মোটাদের দাম নেই। এই মোটা কারা, যারা শারীরিকভাবে মোটা তাদের দাম একটু কমই হয় বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মোটা ছাড়াও তো সমাজে আরো অনেক রকমের মোটা মানুষ পাওয়া যায়, যাদের দাম একেবারেই কম নয়। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই মোটাদের কদর আছে। কদরের পাশাপাশি সমস্যাও আছে। মোটারা সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো?
সমস্যাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ইচ্ছে করলেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। মোটা হয় কারা? মানুষ। অন্যদিকে মোটা করা হয় কোরবানির পশু। মানুষ ও কোরবানির পশুর মোটা হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। কোরবানির পশু মোটা করা হয়। অন্যদিকে মানুষ মোটা হয়ে যায়। মানুষ মোটা হয়ে যায় নিজের দোষে। মানুষের বড় শত্রু তার জিহ্বা। এখানে একবার স্বাদ লেগে গেলে আর রক্ষা নেই। স্বাদটা কিসের? খাদ্যের? কী কী জিনিস মানুষের খাবার হতে পারে? তালিকা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। কাজেই ওই প্রসঙ্গে গিয়ে লাভ নেই। তবে এটাও জেনে রাখা যায়, মানুষকেও মোটা করা যায়। সময় মানুষকে মোটা করে দেয়। একেক সময় একেক ধরনের মানুষকে মোটা হতে দেখা যায়। এই মোটাদের সহজে চিকন করা যায় না।
কাজেই কোরবানির পশুর কথা এখন থাক। মানুষের প্রসঙ্গে কথা বলা যাক। মোটা হয়ে গেলে বাজারে মানুষের দাম কমে যায়। কোন বাজারে? আপাতত বিয়ের বাজার কিংবা প্রেমের বাজারের কথাই ধরা যাক। ছেলে কিংবা মেয়ে, বিয়ের বাজারে কিংবা প্রেমের বাজারে মুটিয়ে যাওয়ারা মূল্যহীন। ফলে আজকাল মেয়েদের জন্য যেমন চলছে জিরো ফিগারের প্রতিযোগিতা, তেমনি ছেলেদের প্যাক। সিঙ্ প্যাক নাকি এইট প্যাক, শরীরটা কেমন হবে_এ নিয়ে তরুণকুলে গবেষণা। সেই গবেষণায় গিয়ে আমাদের কাজ কী? আমরা দেখতে চাই সুন্দর। চোখে সুন্দর লাগছে তো? অর্থাৎ চোখে ধরতে হবে। চোখে ধরলেই হলো। 'চোখ যে মনের কথা বলে' সূত্র ধরে চোখে পড়ে গেলে মনে ধরবেই। মনে একবার ধরলে তো আর কথাই নেই। যে কারণে এখন সবারই, বিশেষ করে মেয়েদের চাওয়া হচ্ছে জিরো ফিগার। চোখে ধরা শুধু নয়, চোখে ধরানোটাও তো একটা প্রতিযোগিতার ব্যাপার। জিরো ফিগারের জয়জয়কার চারদিকে।
মনুষ্য সমাজে জিরো ফিগার আর প্যাকের প্রতিযোগিতা। পশুর হাটে মোটাতাজা করা পশু। কোরবানির পশুর হাটে মোটাতাজা হওয়ার জন্য একশ্রেণীর ব্যবসায়ী ঢুকে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এই মোটাতাজারা হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী। জাল টাকার ব্যবসা এদের। পশুর হাটে এদের মোটাতাজা হওয়া ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশের হাতে জাল নোট শনাক্ত করার যন্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। জাল নোট নিয়ে ভেজালের কারবারিদের এতে একটু সমস্যা হতেই পারে। পশুর বাজারে যাঁরা কোরবানির পশু কেনাবেচা করতে যাবেন, এবার তাঁদের এই মোটাতাজা টাকা ব্যবসায়ীদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। সাবধান থাকতে হবে হঠাৎ মোটাতাজা হয়ে ওঠা গরু সম্পর্কেও। কী এক ওষুধ খাইয়ে যে গরু মোটাতাজা করা হয়েছিল, সেই গরু মারা যাচ্ছে। মোটাতাজা গরু বাজারে তুলে মোটা টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে এখন মাথায় হাত। ওদিকে বাজারেরও নাকি বেহাল দশা। বাজারে খরিদ্দার আছে। কিন্তু গরুর দাম যেমন নেই, তেমনি অনেক জায়গায় নাকি ব্যাপক প্রচারের পরও পশুর হাট সচল করা যাচ্ছে না। কেন? এমন হতে পারে যে মানুষের অবস্থা আগের মতো মোটাতাজা নেই। মানুষ যে মোটাতাজা নেই, সেটা এমনিতেই বোঝা যায়। আমরা পথেঘাটে যে মানুষ দেখছি, চেনা মানুষের চেহারার সঙ্গে সেই মানুষের কি কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়? মানুষ কেন এভাবে বদলে যায়?
তা যায়। বদলে যেতে মানুষের সময় লাগে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষ মোটাতাজা হয়ে যায়। অতীতেও আমরা দেখেছি অনেককে মোটাতাজা হয়ে যেতে। রাজনীতি মানুষকে মোটাতাজ করে দেয়। শুধু সময় বুঝে ছাতাটা ধরতে হবে। সময়মতো উচিত গুরু ধরতে পারলে মোটাতাজা হওয়া সময়ের অপেক্ষা মাত্র। উচিত গুরু ধরে সমাজে মোটাতাজা হওয়া মানুষের সংখ্যা একেবারে তো কম নয়। এসব মানুষ আমাদের অনেকেরই চোখের সামনে মোটাতাজা হয়ে দিব্যি আছেন। 'আঙুল ফুলে কলাগাছ'_কথাটা বোধ হয় এই মোটাতাজা মানুষদের সম্পর্কেই সবচেয়ে বেশি খাটে।
না, সমাজের মোটাদের নিয়ে কৌতুক করা চলবে না।
শেষ করা যাক একটা গল্প দিয়ে। দেশের খ্যাতিমান রম্য লেখক ফাহমিদা আমিনের একটা গল্প একটু-একটু মনে পড়ছে। গল্পের দুই চরিত্র। এক ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী। এক রিকশায় তাঁরা ধরেন না। রিকশায় উঠতে গেলে দুজনকে আলাদা রিকশা নিতে হয়। তো একদিন তারা জোর করেই একটা রিকশায় চেপেছেন। সেই রিকশাচালকের অবস্থা ভাবতে গেলে করুণা হয়। রিকশা যাচ্ছে খুবই ধীরে। পথে পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তাঁরা জানতে চাইছেন, কেমন আছেন? ভদ্রলোক মৃদু হেসে জবাব দিচ্ছেন, 'মোটামুটি ভালো আছি।' ভদ্রলোক তো মোটা। মোটার স্ত্রী লিঙ্গ কি মুটি? সে যা হয় হোক। আমরা মোটামুটি ভালো থাকতে চাই। প্রার্থনা করি, সবাই যেন মোটামুটি ভালোই থাকি।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.