যাওয়ার রাস্তা নেই, ঢেউয়ে দেবে যায় স্কুলের ভিটা
যোগাযোগব্যবস্থার বিচারে আজও বঞ্চনার শিকার সুনামগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চল। অন্যান্য দিক বাদ দিলেও জেলার শিক্ষাব্যবস্থায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যাপকভাবে। বেশির ভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। শুকনো মৌসুমে হাওর, জাঙ্গাল, পতিত ভূমি আর দিগন্তজোড়া মাঠ পেরিয়ে স্কুলে যাতায়াত করা গেলেও বর্ষায় লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে স্কুল।
থই থই হাওরের মাঝখানে তখন স্কুলগুলোকে দূরের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলে মনে হয়।অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষায় শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শিক্ষকের উপস্থিতিও অনিয়মিত হয়ে পড়ে। অন্যান্য সময়ও নাজুক যোগাযোগব্যবস্থার কারণে শিক্ষকরা সঠিক সময়ে স্কুলে যান না। তাঁরা স্কুলে পেঁৗছেন দেরিতে, স্কুল ছুটি দিয়ে নিজেরাও বাড়ি ফেরেন নির্ধারিত সময়ের আগেই। প্রাথমিক বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আগের তুলনায় হাওর অঞ্চলের মানুষ এখন শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট সচেতন। ফলে শিক্ষকদের ফাঁকির প্রবণতা অনেকাংশেই কমে এসেছে।
প্রাকৃতিক কারণে হাওর অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেছেন তাঁরা।
তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের শাহগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে। শনি ও মাটিয়ান হাওরঘেরা এ স্কুলে যাওয়ার কোনো সংযোগ সড়ক নেই। বর্ষায় নৌকায়, হেমন্তে হাওরের জাঙ্গাল আর পতিত ভূমি পেরিয়ে স্কুলে আসতে হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। তিনটি কক্ষের স্কুলটিতে শ্রেণীকক্ষের অভাবে একটি শ্রেণীর ক্লাস নেওয়া হয় অফিস রুমে। দাঁড়িয়ে ক্লাস করে শিক্ষার্থীরা। প্রধান শিক্ষক প্রতি ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষকে জানালেও কোনো উদ্যোগ নেই। তিনজন শিক্ষক আর সাকল্যে ৬২ জন শিক্ষার্থীর জন্য নেই পর্যাপ্ত বেঞ্চ ও টেবিল।
সরেজমিনে মঙ্গলবার দুপুরে ওই স্কুলে গিয়ে দেখা যায় তিনজন শিক্ষকই স্কুলে রয়েছেন। প্রধান শিক্ষক দিলীপ কুমার গাঙ্গুলি তাঁর অফিস রুমে তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাস নিচ্ছেন। বেঞ্চের অভাবে শিক্ষার্থীরা পাঠ নিচ্ছে দাঁড়িয়ে। প্রধান শিক্ষক জানান, প্রতিদিনই কক্ষ সংকটের কারণে অফিস রুমে দাঁড়িয়ে ক্লাস নেওয়া হয়। অন্য দুটি কক্ষে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস নিচ্ছেন সহকারী দুই শিক্ষক। তিনি জানান, মাঝেমধ্যে বিলম্ব হলেও তাঁরা নিয়মিত স্কুলে আসেন।
বৌলাই নদীর পাড়ে ভিটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলটিতে কোনো খেলার মাঠ নেই। হেমন্তে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও বর্ষায় যাতায়াতের অভাবে ক্লাসরুম ফাঁকা থাকে। তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ফাতেমা ও আলী জানায়, বর্ষায় চারদিকে পানি থাকায় তারা স্কুলে নিয়মিত আসতে পারে না।
বৌলাই নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত উমেদপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। এই স্কুলে কর্মরত তিনজন শিক্ষকের মধ্যে উপস্থিত আছেন প্রধান শিক্ষকসহ দুজন। একজন শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এ স্কুলের উত্তর-দক্ষিণে মাটিয়ান ও শনির হাওর। সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এ স্কুলে সরাসরি কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। বর্ষায় হাওরের উত্তাল ঢেউয়ে স্কুলের ভিটে দিন দিন ধসে যাচ্ছে। চারটি কক্ষের মেঝে অর্ধেক করে দেবে গেছে। প্রতিটি মেঝের অবশিষ্ট অংশে কোনোমতে কার্যক্রম চলছে। সারাক্ষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। এ স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২৪ জন। স্কুলের মাঠ না থাকায় এখানেও সমাবেশ ও খেলাধুলা হয় না বলে জানায় তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী আমেনা। দেবে যাওয়া মেঝেতে ক্লাস করতে ভয় লাগে বলেও জানায় সে।
প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন কবীর বলেন, 'হাওরের ঢেউয়ে শ্রেণীকক্ষের অর্ধেক মেঝে দেবে যাওয়ায় বাকি অর্ধেকে আতঙ্ক নিয়েই কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। বর্ষায় শিশুদের নিরাপত্তা আমাদের জন্য বড় ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।'
উমেদপুর গ্রামের অভিভাবক আজব আলী জানান, বর্ষার সময় শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকদেরও উপস্থিতি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। একই গ্রামের অভিভাবক শাহেব নূর জানান, এই স্কুল এবং পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর স্কুলের শিক্ষকের উপস্থিতি নিয়মিত নয়। নানা প্রতিবন্ধকতায় এসব স্কুলে সরকারি রুটিন মানা হয় না।
জেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহনলাল দাস বলেন, 'সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে বর্ষা তো বটেই, শুকনো মৌসুমেও বেশির ভাগ স্কুলে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। জেলার প্রত্যন্ত হাওর এলাকা ঘুরে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। কাউকে না জানিয়ে আমি হাওরাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলে গিয়েও শিক্ষকের উপস্থিতি পেয়েছি। অভিভাবকরা সচেতন হওয়ায় শিক্ষকদের স্কুল ফাঁকি দেওয়ারও সুযোগ নেই। তবে বিড়ম্বিত যোগাযোগের কারণে অনেকেরই স্কুলে আসতে দেরি হয়।' তিনি আরো বলেন, সারা দেশের তুলনায় বৃহত্তর সিলেটের প্রাথমিক শিক্ষা কাঠামো অতীতের অবিভক্ত আসামের কাঠামোতেই চলছে। ভৌগোলিক কারণে হাওর অঞ্চলের জন্য আলাদা শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও অবকাঠামো বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি।
No comments