টিপাইমুখে বাঁধ নয় by প্রকৌ. মুহম্মদ হিলালউদ্দিন
বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা-কালনী-মেঘনা অনেক অনেক শতাব্দীর একটি মুক্তধারা জলপ্রবাহ। কত গ্রামগঞ্জ, কত কৃষিজমি, কতশত বৃক্ষ এবং দুর্লভ লতাগুল্ম, সুস্বাদু মৎস্য, জলজ প্রাণী মিলিয়ে বরাক-মেঘনা পরিবার। বরাক-মেঘনাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে ছয় কোটি লোকের এক অববাহিকা-নিকুঞ্জ। মানবজাতির একটি মেধাবী, বুদ্ধিমান এবং চালাক অংশ অমন চমৎকার প্রকৃতিকে, মুক্তধারাকে নারকীয় সহিংসতায় রুদ্ধ করে মুনাফা মুদ্রার তেলেসমাতি করে চলেছে। প্রথ
বেপরোয়া, অশান্ত পাহাড়ি নদীকে বাঁধ দিয়ে বন্ধ করে তা থেকে বিদ্যুৎ ও সেচের সুবিধা সৃষ্টির প্রকৌশলগত বুদ্ধিমত্তা ছিল অনবদ্য। প্রকৌশলগত অর্জনকে খুবই সমীহের চোখে দেখা হয়েছে অনেককাল। কিন্তু প্রকৌশলীদের বুদ্ধিমত্তার চেয়েও অনেক অনেক বুদ্ধিমান হচ্ছে বিশ্বজুড়ে বর্ধমান পুঁজি। ওই মুনাফা শিকারি পুঁজি পৃথিবীতে ৫০ হাজার নদীর ওপর বড় বাঁধ (১৫ মিটার উচ্চতার বেশি) তৈরি করেছে। ওদের চোখ এ ধরনের আরও ৫০ হাজার নদীর ওপর। এদের নাম দেওয়া যায় বাঁধ সিন্ডিকেট, সিমেন্ট-টারবাইন-আয়রন (রড) সিন্ডিকেট। এদের হাত বড়, প্রভাব ব্যাপক। পৃথিবীর দেশে দেশে ওরা সরকার, রাজনীতিবিদ, জল-আমলা (ওয়াটার ব্যুরোক্রেট) এবং সংশ্লিষ্টদের ভেতর নানাভাবে প্রবেশ করে। 'এনার্জি-সিকিউরিটি' নামের ধুয়া তুলে, ভিশন-২০৫০-ধরনের মরীচিকা-ম্যাজিকের চালচিত্র গড়ে তুলে এবং নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করে মুনাফার বিকৃত লালসা পূর্ণ করে চলে। আমাদের কাপ্তাই বাঁধ উৎখাত করেছে লাখ লাখ পাহাড়ি পরিবার, যাদের অনেকে আজ ভারতের অরুণাচলে 'রাষ্ট্রবিহীন' পরিচয়সত্তায় এক অমানবিক জীবনযাপন করে চলেছে। সামান্য বিদ্যুতের জন্য কাপ্তাই বাঁধের জল রক্তলাল হয়ে গেল। এই বাঁধ পানি আটকে ভাটিতে দীর্ঘমেয়াদে যা ঘটায় তা হচ্ছে প্রতিবেশ-বিপর্যয়, ইকোলজিক্যাল ডিজাস্টার। পৃথিবীজুড়ে এখন চলছে বাঁধ সিন্ডিকেটের প্রভাব-তাণ্ডব। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি_ সবাই এই মুনাফার আয়োজনের মিত্র জোট। এখন বিশাল পুঁজি নিয়ে বাঁধ সিন্ডিকেটের নব্য সদস্য গণচীনও বাজারে নেমেছে বিশ্বব্যাংকের চেয়েও বড়
থলে হাতে।
আমাদের বরাক-মেঘনায় ১৫০০ মেগাওয়াটের একটা বড়সড় প্রকল্পে মুনাফাবাজির এক নকশা বহুকালের। অন্তত আড়াই দশক ধরে বরাক ও টুইভাই নদীর সঙ্গমস্থলে 'টিপাইমুখ' নামের এক গ্রামে পাঁচশ' ফুট উঁচু এক বিশাল বাঁধ তৈরির প্রকৌশল নকশা সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সেটি কার্যকর করতে গিয়ে খোদ মণিপুরের জনগণের প্রতিরোধে বারবার পিছিয়ে গেছে এই বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিপকো কোম্পানি ছিল টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে। কত কিছু করল তারা, কিন্তু বাঁধটি নির্মাণে এক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে না পারায় নিপকোর বদলে কেন্দ্রীয় সরকারেরই কোম্পানি এনএইচপিসি এখন নির্মাণভার নিয়েছে। এনএইচপিসি অন্য একটি কোম্পানি এবং মণিপুর সরকারকে সঙ্গে নিয়ে সম্প্রতি নিজেদের ভেতর চুক্তি করে বাঁধটি নির্মাণের পথে একধাপ অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু তারা মণিপুর-আসাম-বাংলাদেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের গণশক্তির মর্মকথা ঠিকমতো বোঝেনি। কেননা প্রায় এক দশক ধরে মণিপুর-আসাম ও বাংলাদেশের পানি-অধিকার সংগ্রামীরা টিপাইমুখ বাঁধের কুফল নিয়ে জনগণের ভেতর এক বড়মাপের প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে। 'টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের ক্ষতি করবে না'_ এমন একটা মিষ্টি বুলি আওড়াচ্ছে বাঁধ সিন্ডিকেট বন্ধুরা দিলি্ল সরকারের মুখপাত্রদের উচ্চারণযন্ত্রের সহযোগিতায়। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর গণচীন পৃথিবীর বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলছে বিশাল বাঁধের মাধ্যমে। ভাটির ভারত আপত্তি তুলেছে। গণচীনও দিলি্ল থেকেই বুঝি ভাষা ধার করে বলে চলেছে, 'ভারতের ক্ষতি হয় এমন কিছু আমরা করব না।'
বিশ্বব্যাংক, বাঁধ বিশেষজ্ঞ এবং বাঁধবিরোধী সংগ্রামীদের নিয়ে পৃথিবীতে বড় বাঁধকেন্দ্রিক একটা কমিশন গঠন করেছিল জাতিসংঘ, ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যাম (ডবি্লউসিডি) যার নাম। বড় বাঁধ যে পরিবেশ-প্রতিবেশগত বিপর্যয় ঘটায় সে সংবাদ ওই কমিশনের রিপোর্টেই আছে। বড় বাঁধ বড় ক্ষতি। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি সংবিধান সংশোধন করেছে, যা নিয়ে বিতর্কের তুফান উঠেছে। কিন্তু একটি অসাধারণ সংশোধনী হয়েছে এই ফাঁকে, যা অনেকেই লক্ষ্য করেননি। জীববৈচিত্র্য এবং প্রতিবেশ সংরক্ষণের সপক্ষে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান। টিপাইমুখ বাঁধ মেগা বাঁধ, মেগা বিপর্যয়ের উৎস। অতএব টিপাইমুখ বাঁধের সপক্ষে যারা দাঁড়াবেন তারা সংবিধানবিরোধী কাজ করবেন। সেই বিচারে বাংলাদেশ সরকারকে সংবিধান রক্ষার স্বার্থেই টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
অভিন্ন নদীপ্রবাহে একতরফা হস্তক্ষেপ জাতিসংঘ কনভেনশনবিরোধী। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ভারত টিপাইমুখের যে নকশা করেছে বরাক-মেঘনা প্রবাহের ২৭৭ কিলোমিটার অংশে বাকি ছয় শতাধিক কিলোমিটারের বাংলাদেশ অংশের কোনো সমীক্ষা ছাড়াই, এটা প্রকৌশলগত মূর্খতা। তদুপরি ভূমিকম্পপ্রবণ টিপাইমুখ অঞ্চলে এই বাঁধ ফেটে গেলে তা সুনামির চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। বাঁধ সিন্ডিকেট, মুনাফা শিকারি শকুনেরা তা বোঝে না। তারা সরকার-রাজনীতিক-আমলাদের ক্রয় করে। কিন্তু জনগণকে ক্রয় করা সহজ নয়। বাংলাদেশ-আসাম-মণিপুরের জনগণ বিক্রি হবে না। সেই জনগণের অমোঘ সিদ্ধান্ত টিপাইমুখ বাঁধ হতে দেওয়া হবে না। হতে দেওয়া হবে না। আকাশ ফুটো করা প্রকৃতি-বিধ্বংসী উন্নয়নের নীতিকৌশলকে তারা ফুটো করে দেবে।
No comments