টিপাইমুখ বাঁধ : বাংলাদেশের মরণফাঁদ by শহিদুল ইসলাম
এক. গত ২১ নভেম্বর জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ, জাতীয় সংসদের নির্দলীয় সংসদ সদস্য ফজলুল হক যখন ভারত সরকারের একতরফাভাবে বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে হাত দেওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ও নিন্দা জ্ঞাপন করেন, তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক কোনো দলের পক্ষ থেকে তাঁর কোনো সমর্থক পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য শরিক দলের সংসদ সদস্যরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলেন।
গত ২২ নভেম্বর বিভিন্ন দৈনিকের খবর থেকে জানা গেল, আমাদের বিজ্ঞ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তালুকদার বলেছেন, 'টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এ ক্ষেত্রে ভারতকে বাধা দেওয়ার এখতিয়ার বাংলাদেশের নেই।' প্রতিমন্ত্রীর এ মন্তব্যে অনেকেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন। প্রতিমন্ত্রীর শিক্ষা, মেধা-মনন সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর কথায় আবার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে পড়ল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানি ও তাদের এ দেশীয় দোসর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বিশ্ব জনমত গঠনে প্রবৃত্ত হয়েছিল। গত ২১ নভেম্বর প্রায় সব কাগজেই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ওবায়দুল কাদেরের এক সংবাদ সম্মেলনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। ২০ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে তিনি বলেন, টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্থগিত করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করা হবে না_ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির পরও টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।' তিনি আরো বলেন, 'আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় টিপাইমুখ বাঁধ সম্পর্কে ভারতের কাছে জানতে চেয়েছে।' পররাষ্ট্রসচিবও বলেছেন, তিনি আশা করছেন, সোমবার ২১ নভেম্বর এ সম্পর্কে জানা যাবে। কিন্তু ২২ নভেম্বর মঙ্গলবার খবরে প্রকাশ_'টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে ভারত কোনো তথ্য দেয়নি।' পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস বলেছেন, এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য আমার কাছে আসেনি। এদিকে সারা দেশ প্রতিবাদে সোচ্চার। সরকার কী করছে মানুষ তা জানতে চায়। আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদেরের কথার কোনো প্রতিধ্বনি শোনা যায়নি সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়ায়। অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের উচিত এর এক কড়া প্রতিবাদ জানানো এবং সম্পূর্ণ প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ও ব্যাখ্যা দাবি করা।
দুই. গত ২২ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা না করে অনেকটা গোপনে ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। খবরটি মিডিয়ায় আসার সঙ্গে বাংলাদেশসহ ভারতের ভাটি অঞ্চলের মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। উভয় দেশের পরিবেশবাদী, পরিবেশকর্মী, বিশেষজ্ঞ ও জনগণ আঞ্চলিক পরিবেশ বিপর্যয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে সিলেটের ২৬ শতাংশ ও মৌলভীবাজারের ১১ শতাংশ হাওর অঞ্চল শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে ২০০৫ সালের এক গবেষণায় বলা হয়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাঁধ নির্মিত হলে এ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য পুরোপুরি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড়-জঙ্গল পানির নিচে তলিয়ে যাবে। পানিসম্পদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। টিপাইমুখের উজানে পানি ঠেকিয়ে দিলে ভাটি অঞ্চলের জমিগুলো পানি সংকটের মধ্যে পড়বে। ফলে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ জীবিকা হারাবে। মোট ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব আমরা এখনো জানি না। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে আমরা যেটুকু জানতে পারছি, সেটুকুই ভয়াবহ পরিণতির জন্য অশনিসংকেত। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে এর ক্ষতির পরিমাণ ও ধরন সম্পর্কে সরকারের উচিত অবিলম্বে তা দেশবাসীর নজরে নিয়ে আসা। এর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টির সমাধানের সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা। কারণ এটা বাংলাদেশের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। আমরা সবার বন্ধুত্ব কামনা করি এটা সত্য; কিন্তু নিজের জীবনের বিনিময়ে নয়। ভারতের প্রখ্যাত বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট কূলদীপ নায়ারও ভারত সরকারের পদক্ষেপকে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল বলে মনে করছেন। আন্তর্জাতিক নদী আইনেও ভাটির দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে উজানে কোনো রকমের বাঁধ নির্মাণ করা নিষিদ্ধ।
তিন. ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর গিয়ে উভয় দেশের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। সেই সফরে ভারতীয় প্রতিপক্ষ ভারত সরকার এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল যে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়_এমন কোনো বাঁধ বা কাজ ভারত সরকার করবে না। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় দ্বিতীয়বারের মতো সে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছিল। কাজেই এটাই স্বাভাবিক যে এ ধরনের কাজের আগে ভারত সরকার অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পাই। সরকার এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। কেবল ভারত নয়, প্রতিটি দেশের সঙ্গেই আমরা বন্ধুত্বের সম্পর্ক চাই। এতে কোনো ভুল নেই; কিন্তু ভারতের মতো বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন এমনিতেই শক্ত_আমরা আরো শক্ত সম্পর্ক কামনা করি। কিন্তু সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আমাদের মধ্যে যে এক আশার আলো জ্বলে উঠেছিল, তা হঠাৎ করেই নিভে গেল। আমরা হতাশ হলাম। এখনো আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, হয়তো শিগগিরই তিস্তা সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এর মধ্যে টিপাইমুখ আমাদের সে আশাকে আরো ঘন কালো হতাশায় ঢেকে দিল। অর্থনীতিতে ভারত আজ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শক্তি। তার দৃষ্টি আজ সবাইকে ছাড়িয়ে সে এক নম্বরে পেঁৗছবে। ভারত যদি সে লক্ষ্যে পেঁৗছে যায়, তাহলে তা আমাদের জন্য খুশির বিষয়। কিন্তু তার আচরণ যদি সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং বর্তমানের মার্কিন নয়া সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী হয়, তাহলে ভারতের চারপাশের ছোট দেশগুলোর জন্য তা হবে হতাশাব্যঞ্জক। গরিবি হালে আমরা আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা নিয়ে বাস করতে চাই। আমরা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাই। এ বিষয়ে ভারত এক বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত যখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তখন আমাদের মতো গরিব দেশের এসব সামান্য বিষয় অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারে। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই, ভারতও যদি আমাদের বন্ধুত্ব চায়, তাহলে দ্বিপক্ষীয় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে এবং দ্বিপক্ষীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বাংলাদেশ ও আশপাশের অন্যান্য ছোট ও দরিদ্র দেশের সমস্যাকে গুরুত্বসহকারে সমাধান করতে হবে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর সরকারিভাবে এ দেশে ভারতবিদ্বেষী মনোভাবে রাজনৈতিক বীজ রোপণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সে মনোভাবের মৃত্যু হয়েছে_এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। ভারত যদি একের পর এক এই বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে বাংলাদেশকে ভয়ানক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে সেই মনোভাবকে চাঙ্গা করার সুযোগ করে দেবে। তাই দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরুর আগেই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ করার ঘোষণা আসতে হবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। গত ২৪ নভেম্বর রাজশাহীতে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ সমস্যার সমাধানে সরকার যথাযথ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে এবং এ সরকার এর সমাধান করবে। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ যৌথ সমীক্ষা চায়। আমরা বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থানে আশাবাদী। ২৫ নভেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত 'দিলি্লকে ঢাকার কড়া বার্তা, ব্যাখ্যা দাবি' শীর্ষক প্রতিবেদনেও সরকারের দৃঢ় অবস্থানের চিত্রই পাওয়া গেল।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
দুই. গত ২২ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা না করে অনেকটা গোপনে ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। খবরটি মিডিয়ায় আসার সঙ্গে বাংলাদেশসহ ভারতের ভাটি অঞ্চলের মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। উভয় দেশের পরিবেশবাদী, পরিবেশকর্মী, বিশেষজ্ঞ ও জনগণ আঞ্চলিক পরিবেশ বিপর্যয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে সিলেটের ২৬ শতাংশ ও মৌলভীবাজারের ১১ শতাংশ হাওর অঞ্চল শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে ২০০৫ সালের এক গবেষণায় বলা হয়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাঁধ নির্মিত হলে এ অঞ্চলে জীববৈচিত্র্য পুরোপুরি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। বিস্তীর্ণ এলাকার পাহাড়-জঙ্গল পানির নিচে তলিয়ে যাবে। পানিসম্পদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। টিপাইমুখের উজানে পানি ঠেকিয়ে দিলে ভাটি অঞ্চলের জমিগুলো পানি সংকটের মধ্যে পড়বে। ফলে চাষাবাদ বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ জীবিকা হারাবে। মোট ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব আমরা এখনো জানি না। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে আমরা যেটুকু জানতে পারছি, সেটুকুই ভয়াবহ পরিণতির জন্য অশনিসংকেত। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে এর ক্ষতির পরিমাণ ও ধরন সম্পর্কে সরকারের উচিত অবিলম্বে তা দেশবাসীর নজরে নিয়ে আসা। এর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টির সমাধানের সর্বাত্মক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা। কারণ এটা বাংলাদেশের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। আমরা সবার বন্ধুত্ব কামনা করি এটা সত্য; কিন্তু নিজের জীবনের বিনিময়ে নয়। ভারতের প্রখ্যাত বর্ষীয়ান সাংবাদিক ও কলামিস্ট কূলদীপ নায়ারও ভারত সরকারের পদক্ষেপকে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল বলে মনে করছেন। আন্তর্জাতিক নদী আইনেও ভাটির দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে উজানে কোনো রকমের বাঁধ নির্মাণ করা নিষিদ্ধ।
তিন. ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর গিয়ে উভয় দেশের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। সেই সফরে ভারতীয় প্রতিপক্ষ ভারত সরকার এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল যে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়_এমন কোনো বাঁধ বা কাজ ভারত সরকার করবে না। এ বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় দ্বিতীয়বারের মতো সে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছিল। কাজেই এটাই স্বাভাবিক যে এ ধরনের কাজের আগে ভারত সরকার অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের খবর মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা জানতে পাই। সরকার এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। কেবল ভারত নয়, প্রতিটি দেশের সঙ্গেই আমরা বন্ধুত্বের সম্পর্ক চাই। এতে কোনো ভুল নেই; কিন্তু ভারতের মতো বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন এমনিতেই শক্ত_আমরা আরো শক্ত সম্পর্ক কামনা করি। কিন্তু সেপ্টেম্বরে মনমোহন সিংয়ের সফরের আগে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে আমাদের মধ্যে যে এক আশার আলো জ্বলে উঠেছিল, তা হঠাৎ করেই নিভে গেল। আমরা হতাশ হলাম। এখনো আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, হয়তো শিগগিরই তিস্তা সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এর মধ্যে টিপাইমুখ আমাদের সে আশাকে আরো ঘন কালো হতাশায় ঢেকে দিল। অর্থনীতিতে ভারত আজ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শক্তি। তার দৃষ্টি আজ সবাইকে ছাড়িয়ে সে এক নম্বরে পেঁৗছবে। ভারত যদি সে লক্ষ্যে পেঁৗছে যায়, তাহলে তা আমাদের জন্য খুশির বিষয়। কিন্তু তার আচরণ যদি সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং বর্তমানের মার্কিন নয়া সাম্রাজ্যবাদের অনুগামী হয়, তাহলে ভারতের চারপাশের ছোট দেশগুলোর জন্য তা হবে হতাশাব্যঞ্জক। গরিবি হালে আমরা আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা নিয়ে বাস করতে চাই। আমরা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাই। এ বিষয়ে ভারত এক বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারত যখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও জাপানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তখন আমাদের মতো গরিব দেশের এসব সামান্য বিষয় অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারে। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই, ভারতও যদি আমাদের বন্ধুত্ব চায়, তাহলে দ্বিপক্ষীয় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে এবং দ্বিপক্ষীয় আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বাংলাদেশ ও আশপাশের অন্যান্য ছোট ও দরিদ্র দেশের সমস্যাকে গুরুত্বসহকারে সমাধান করতে হবে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর সরকারিভাবে এ দেশে ভারতবিদ্বেষী মনোভাবে রাজনৈতিক বীজ রোপণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সে মনোভাবের মৃত্যু হয়েছে_এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। ভারত যদি একের পর এক এই বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে বাংলাদেশকে ভয়ানক পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে সেই মনোভাবকে চাঙ্গা করার সুযোগ করে দেবে। তাই দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরুর আগেই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ করার ঘোষণা আসতে হবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। গত ২৪ নভেম্বর রাজশাহীতে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ সমস্যার সমাধানে সরকার যথাযথ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে এবং এ সরকার এর সমাধান করবে। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ যৌথ সমীক্ষা চায়। আমরা বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থানে আশাবাদী। ২৫ নভেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত 'দিলি্লকে ঢাকার কড়া বার্তা, ব্যাখ্যা দাবি' শীর্ষক প্রতিবেদনেও সরকারের দৃঢ় অবস্থানের চিত্রই পাওয়া গেল।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments