অবৈধ ভিওআইপির রমরমা ব্যবসা by সজল জাহিদ
আবার শুরু হয়েছে অবৈধ ভিওআইপির রমরমা ব্যবসা। বিদেশ থেকে প্রতিদিন আসা ফোন কলের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসছে অবৈধ পথে। ইউরোপভিত্তিক ভিওআইপি নিশ্চিতকারী কোম্পানি মিউচি সলিউশনের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে ৪৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ কলই আসছে অবৈধ ভিওআইপি পন্থায়। সর্বশেষ ২৩ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ৮০ হাজার নমুনা কলের মধ্যে ৩৫ হাজার ৮৬৪টি কলই বৈধ পথ
ফাঁকি দিয়ে এসেছে। প্রতি মিনিট ইনকামিং আইএসডি কলে তিন সেন্ট করে দেশে আসে। সেক্ষেত্রে কয়েক কোটি মিনিট কল অবৈধ পথে এলে তাতে দিনে সরকারের ক্ষতি ১০ কোটি টাকার বেশি।
মিউচি জানাচ্ছে, গত ১৯ মাসের মোট ইনকামিং আইএসডি কলের ৩৫ দশমিক ৬৯ শতাংশই অবৈধ পন্থায় এসেছে। গত বছরের ১১ মে থেকে এ বছরের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ইনকামিং আইএসডি কলের ওপর দ্বৈবচয়ন পদ্ধতির জরিপের মাধ্যমে এ তথ্য পেয়েছে তারা। মিউচির হিসাব অনুসারে দ্বৈবচয়ন পদ্ধতির ১৫ লাখ ২০ হাজার নমুনার মধ্যে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪২৯টি কলই দেশে এসেছে অবৈধ পন্থায়। মজার ব্যাপার, অবৈধ পথে আসা এ ইনকামিং কলের ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪০৮টিই আবার এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের সিমের মাধ্যমে। অবৈধ কল আসার রুট হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে অপর রাষ্ট্রায়ত্ত ল্যান্ডফোন কোম্পানি বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক গেটওয়ে। বিটিসিএলের একটি চক্র আবার গেটওয়ের তথ্য মুছে দিয়ে সরকারি রাজস্ব লুটে নিচ্ছে। এক কথায়, আইএসডি
কল নিয়ে চলছে তেলেসমাতি।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও স্বীকার করেছে, অবৈধ কলের সংখ্যা বেড়েছে। এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি কোম্পানির ওপর দায় চাপিয়েছে বিটিআরসি। বিটিআরসির নিয়ন্ত্রণ কৌশল নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সরকারের উচ্চপদস্থরা। তারা বলছেন, অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে বিটিআরসি পার পেতে চাইছে। ভিওআইপি নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ এখতিয়ার তাদের। এক বছর আগে বিটিআরসি ভিওআইপি উন্মুক্ত করার খসড়া নীতিমালা করলেও এখনও তা অনুমোদন পায়নি।
বিটিসিএলসহ অন্য তিনটি আন্তর্জাতিক গেটওয়ের মাধ্যমে আসা কলের হিসাব থেকে বিটিআরসি বলছে, বৈধ আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ দেড় বছর আগের চেয়েও এখন কম। গত বছর এপ্রিলেও দিনে গড়ে ইনকামিং আইএসডি কল ছিল ৫ কোটি ৭০ লাখ মিনিট। এখন তা নেমে এসেছে ৪ কোটি মিনিটে। গেল অক্টোবরেও বৈধ কল ৫ কোটি মিনিটের বেশি ছিল। সামান্য এ হেরফেরেই দিনে সরকারের ক্ষতি বেড়েছে আড়াই কোটি টাকা।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ সমকালকে বলেন, অবৈধ কল কিছুটা বেড়েছে। এ জন্য সরকারি কোম্পানি দুটিও দায়ী। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে বারবার লিখেও কোনো সাড়া মেলেনি। চেয়ারম্যান বলেন, বিটিআরসি সব জায়গায় চাইলেই পুলিশিং করতে পারে না। তবে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিটিসিএল ও টেলিটকের বোর্ড চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস বলেছেন, ভিওআইপি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিটিআরসির। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনুও বলেছেন, ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা বন্ধের ক্ষেত্রে বিটিআরসির যতটা উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন ছিল তা আর দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে সংসদীয় কমিটিতেও তুমুল আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি সাব-কমিটিও গঠন করেছে সংসদীয় কমিটি। সে কমিটিও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষ করে এনেছে। যেখানে টেলিটক এবং বিটিসিএলকেই মূলত দায়ী করা হচ্ছে।
কিছুদিন আগেও বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম খাবিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় 'স্মাগলিং' ব্যবসা ভিওআইপি। অনেকেই মুখে এর বিরুদ্ধে বললেও আদতে তারা এটিকে লালনই করেন।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, স্পেন, সিঙ্গাপুর, জাপান, ব্যাংকক, এশিয়া ও ইউরোপের একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক টেলিসিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশীয় একটি চক্রের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে এ ভিওআইপির নামে লুটপাটের মহোৎসব। আগে মোবাইল অপারেটর, বেসরকারি ল্যান্ডফোন কোম্পানির মাধ্যমে বেশিরভাগ কল এলেও এখন এ কর্মযজ্ঞের পথ ও পদ্ধতি বদলে গেছে। চারদলীয় জোট আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, হাওয়া ভবন, অর্থ মন্ত্রণালয়, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি এবং অধুনালুপ্ত তার ও টেলিফোন বোর্ডের কতিপয় প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ সদস্য ছিলেন এ সিন্ডিকেটের মূল নিয়ন্ত্রক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ সিন্ডিকেটের সদস্য বদল হয়েছে কেবল। সিন্ডিকেট ভাঙেনি। বিটিসিএলের হোতাদের অনেকেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লেবাস পাল্টে নিজেদের অবস্থান আবারও শক্ত করেছেন। সেক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও সরকারেরই কিছু প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ রয়েছে। আগে কেবল ঢাকায় বসে এ ব্যবসা চললেও এখন ঢাকার বাইরেও তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে এ অসৎ ব্যবসা।
এ সিন্ডিকেটের কারণেই এখন বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক কলের হিসাব মুছে যাচ্ছে। ২৪ অক্টোবর ভিওআইপি বিষয়ে সংসদীয় সাব-কমিটিতেও বলা হয়েছে, বিটিসিএলের কল ডেটা রেকর্ডস (সিডিআর) সিস্টেম কাজ করছে না। আর এটিকেই সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। ওই বৈঠকে বিটিআরসির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান বলেন, টেলিটক এবং বিটিসিএলের দিকে নজর দিলেই ভিওআইপি কমে আসবে। তার বিবেচনায় টেলিটকের মাধ্যমেই ৬০ শতাংশ ভিওআইপি কল আসে। বিটিসিএলের এক কর্মকর্তা বলেন, মাস দেড়েক আগে বিটিসিএলের উচ্চ পর্যায়ের অন্তত আট কর্মকর্তাকে বদলি করে পুরনো সিন্ডিকেটের লোকদের ফিরিয়ে আনায় তাদের হাতেই সব চলে গেছে।
৬২ মামলা দেখার কেউ নেই : ভিওআইপির বিরুদ্ধে নানা অভিযান এবং যন্ত্রাংশ আটক সংক্রান্ত ৬২টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে অসংখ্য। কিন্তু এর কোনো অগ্রগতি নেই। ফলোআপও কেউ করে না। বিটিআরসিও এসব মামলা দেখছে না বলে জানিয়েছে কমিশনটির আইন শাখার এক কর্মকর্তা। অন্যদিকে শতশত কোটি টাকার যন্ত্রাংশ উদ্ধার হওয়ার ঘোষণা দিলেও তা কার কাছে তার কোনো হিসাব নেই। বিটিআরসি জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট থানাতেই এগুলো রাখা আছে।
জানা গেছে, ভিওআইপির অভিযোগে দুই ভাগে ১৮ লাখ ২৭ হাজার সিম বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৫০ হাজার সিম বন্ধ করেছে মোবাইল ফোন অপারেটর তাদের নিজেদের উদ্যোগে। আর ৪ লাখ ৭৭ হাজার সিম বিটিআরসির নির্দেশনায় বন্ধ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে কল টার্মিনেশনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিটিআরসি ৩০ হাজার ৭৮৯টি আইপি বন্ধ করেছে।
ভিওআইপি উন্মুক্ত করতে বিলম্ব : ভিওআইপি উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে ঠিক এক বছর আগে বিটিআরসি একটি খসড়া নীতিমালা করে দিলেও এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেনি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার বা ভিএসপি নামের ওই খসড়া নীতিমালায় বিটিআরসি ৫ লাখ টাকা লাইসেন্স এবং বার্ষিক ১ লাখ টাকা ফির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও বৈধতা দিয়ে এ ব্যবসায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করে। আন্তর্জাতিক গেটওয়ের অধীনেই ভিএসপি অপারেটরদের ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলে বিটিআরসি।
এ বিষয়ে টেলিযোগাযোগ সচিব সুনীল কান্তি বোস আর মাত্র এক মাসের মধ্যে ভিএসপি লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। তিনি জানান, তাদের দিক থেকে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার পর এখন সেটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ সপ্তাহেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত ঘোষণা না আসার কোনো কারণ নেই।
অভিযান না থাকা নিয়ে প্রশ্ন : গত বছর মার্চে হঠাৎ করেই পাঁচটি বেসরকারি ল্যান্ডফোন কোম্পানি বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। তাতে অবশ্য অবৈধ কলের পরিমাণ কমেছিল। এরপর আবারও নিষ্ক্রিয় রয়েছে বিটিআরসির ভিওআইপি সংক্রান্ত কমিটি।
মিউচি জানাচ্ছে, গত ১৯ মাসের মোট ইনকামিং আইএসডি কলের ৩৫ দশমিক ৬৯ শতাংশই অবৈধ পন্থায় এসেছে। গত বছরের ১১ মে থেকে এ বছরের ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ইনকামিং আইএসডি কলের ওপর দ্বৈবচয়ন পদ্ধতির জরিপের মাধ্যমে এ তথ্য পেয়েছে তারা। মিউচির হিসাব অনুসারে দ্বৈবচয়ন পদ্ধতির ১৫ লাখ ২০ হাজার নমুনার মধ্যে ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৪২৯টি কলই দেশে এসেছে অবৈধ পন্থায়। মজার ব্যাপার, অবৈধ পথে আসা এ ইনকামিং কলের ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪০৮টিই আবার এসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের সিমের মাধ্যমে। অবৈধ কল আসার রুট হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে অপর রাষ্ট্রায়ত্ত ল্যান্ডফোন কোম্পানি বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক গেটওয়ে। বিটিসিএলের একটি চক্র আবার গেটওয়ের তথ্য মুছে দিয়ে সরকারি রাজস্ব লুটে নিচ্ছে। এক কথায়, আইএসডি
কল নিয়ে চলছে তেলেসমাতি।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও স্বীকার করেছে, অবৈধ কলের সংখ্যা বেড়েছে। এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি কোম্পানির ওপর দায় চাপিয়েছে বিটিআরসি। বিটিআরসির নিয়ন্ত্রণ কৌশল নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সরকারের উচ্চপদস্থরা। তারা বলছেন, অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে বিটিআরসি পার পেতে চাইছে। ভিওআইপি নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ এখতিয়ার তাদের। এক বছর আগে বিটিআরসি ভিওআইপি উন্মুক্ত করার খসড়া নীতিমালা করলেও এখনও তা অনুমোদন পায়নি।
বিটিসিএলসহ অন্য তিনটি আন্তর্জাতিক গেটওয়ের মাধ্যমে আসা কলের হিসাব থেকে বিটিআরসি বলছে, বৈধ আন্তর্জাতিক কলের পরিমাণ দেড় বছর আগের চেয়েও এখন কম। গত বছর এপ্রিলেও দিনে গড়ে ইনকামিং আইএসডি কল ছিল ৫ কোটি ৭০ লাখ মিনিট। এখন তা নেমে এসেছে ৪ কোটি মিনিটে। গেল অক্টোবরেও বৈধ কল ৫ কোটি মিনিটের বেশি ছিল। সামান্য এ হেরফেরেই দিনে সরকারের ক্ষতি বেড়েছে আড়াই কোটি টাকা।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) জিয়া আহমেদ সমকালকে বলেন, অবৈধ কল কিছুটা বেড়েছে। এ জন্য সরকারি কোম্পানি দুটিও দায়ী। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে বারবার লিখেও কোনো সাড়া মেলেনি। চেয়ারম্যান বলেন, বিটিআরসি সব জায়গায় চাইলেই পুলিশিং করতে পারে না। তবে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিটিসিএল ও টেলিটকের বোর্ড চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস বলেছেন, ভিওআইপি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিটিআরসির। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনুও বলেছেন, ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা বন্ধের ক্ষেত্রে বিটিআরসির যতটা উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন ছিল তা আর দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে সংসদীয় কমিটিতেও তুমুল আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি সাব-কমিটিও গঠন করেছে সংসদীয় কমিটি। সে কমিটিও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষ করে এনেছে। যেখানে টেলিটক এবং বিটিসিএলকেই মূলত দায়ী করা হচ্ছে।
কিছুদিন আগেও বিটিসিএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম খাবিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় 'স্মাগলিং' ব্যবসা ভিওআইপি। অনেকেই মুখে এর বিরুদ্ধে বললেও আদতে তারা এটিকে লালনই করেন।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, স্পেন, সিঙ্গাপুর, জাপান, ব্যাংকক, এশিয়া ও ইউরোপের একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক টেলিসিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশীয় একটি চক্রের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে চলছে এ ভিওআইপির নামে লুটপাটের মহোৎসব। আগে মোবাইল অপারেটর, বেসরকারি ল্যান্ডফোন কোম্পানির মাধ্যমে বেশিরভাগ কল এলেও এখন এ কর্মযজ্ঞের পথ ও পদ্ধতি বদলে গেছে। চারদলীয় জোট আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, হাওয়া ভবন, অর্থ মন্ত্রণালয়, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি এবং অধুনালুপ্ত তার ও টেলিফোন বোর্ডের কতিপয় প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ সদস্য ছিলেন এ সিন্ডিকেটের মূল নিয়ন্ত্রক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ সিন্ডিকেটের সদস্য বদল হয়েছে কেবল। সিন্ডিকেট ভাঙেনি। বিটিসিএলের হোতাদের অনেকেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লেবাস পাল্টে নিজেদের অবস্থান আবারও শক্ত করেছেন। সেক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও সরকারেরই কিছু প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ রয়েছে। আগে কেবল ঢাকায় বসে এ ব্যবসা চললেও এখন ঢাকার বাইরেও তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে এ অসৎ ব্যবসা।
এ সিন্ডিকেটের কারণেই এখন বিটিসিএলের আন্তর্জাতিক কলের হিসাব মুছে যাচ্ছে। ২৪ অক্টোবর ভিওআইপি বিষয়ে সংসদীয় সাব-কমিটিতেও বলা হয়েছে, বিটিসিএলের কল ডেটা রেকর্ডস (সিডিআর) সিস্টেম কাজ করছে না। আর এটিকেই সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। ওই বৈঠকে বিটিআরসির মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান বলেন, টেলিটক এবং বিটিসিএলের দিকে নজর দিলেই ভিওআইপি কমে আসবে। তার বিবেচনায় টেলিটকের মাধ্যমেই ৬০ শতাংশ ভিওআইপি কল আসে। বিটিসিএলের এক কর্মকর্তা বলেন, মাস দেড়েক আগে বিটিসিএলের উচ্চ পর্যায়ের অন্তত আট কর্মকর্তাকে বদলি করে পুরনো সিন্ডিকেটের লোকদের ফিরিয়ে আনায় তাদের হাতেই সব চলে গেছে।
৬২ মামলা দেখার কেউ নেই : ভিওআইপির বিরুদ্ধে নানা অভিযান এবং যন্ত্রাংশ আটক সংক্রান্ত ৬২টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে অসংখ্য। কিন্তু এর কোনো অগ্রগতি নেই। ফলোআপও কেউ করে না। বিটিআরসিও এসব মামলা দেখছে না বলে জানিয়েছে কমিশনটির আইন শাখার এক কর্মকর্তা। অন্যদিকে শতশত কোটি টাকার যন্ত্রাংশ উদ্ধার হওয়ার ঘোষণা দিলেও তা কার কাছে তার কোনো হিসাব নেই। বিটিআরসি জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট থানাতেই এগুলো রাখা আছে।
জানা গেছে, ভিওআইপির অভিযোগে দুই ভাগে ১৮ লাখ ২৭ হাজার সিম বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৫০ হাজার সিম বন্ধ করেছে মোবাইল ফোন অপারেটর তাদের নিজেদের উদ্যোগে। আর ৪ লাখ ৭৭ হাজার সিম বিটিআরসির নির্দেশনায় বন্ধ করা হয়েছে। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে কল টার্মিনেশনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিটিআরসি ৩০ হাজার ৭৮৯টি আইপি বন্ধ করেছে।
ভিওআইপি উন্মুক্ত করতে বিলম্ব : ভিওআইপি উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে ঠিক এক বছর আগে বিটিআরসি একটি খসড়া নীতিমালা করে দিলেও এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেনি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার বা ভিএসপি নামের ওই খসড়া নীতিমালায় বিটিআরসি ৫ লাখ টাকা লাইসেন্স এবং বার্ষিক ১ লাখ টাকা ফির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও বৈধতা দিয়ে এ ব্যবসায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করে। আন্তর্জাতিক গেটওয়ের অধীনেই ভিএসপি অপারেটরদের ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলে বিটিআরসি।
এ বিষয়ে টেলিযোগাযোগ সচিব সুনীল কান্তি বোস আর মাত্র এক মাসের মধ্যে ভিএসপি লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। তিনি জানান, তাদের দিক থেকে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার পর এখন সেটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ সপ্তাহেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরের মধ্যে এ সংক্রান্ত ঘোষণা না আসার কোনো কারণ নেই।
অভিযান না থাকা নিয়ে প্রশ্ন : গত বছর মার্চে হঠাৎ করেই পাঁচটি বেসরকারি ল্যান্ডফোন কোম্পানি বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। তাতে অবশ্য অবৈধ কলের পরিমাণ কমেছিল। এরপর আবারও নিষ্ক্রিয় রয়েছে বিটিআরসির ভিওআইপি সংক্রান্ত কমিটি।
No comments