টিপাইমুখ বাঁধ-জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় ঐক্য
আমাদের সুরমা ও কুশিয়ারার যৌথ উজান ভারতের বরাক নদীতে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ সংক্রান্ত 'গোপন' চুক্তি প্রায় দুই মাস পরে জানাজানির কারণে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল, তা কিছুটা হলেও কাটতে শুরু করেছে। বিলম্বে হলেও এক বিবৃতিতে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশীর পক্ষে অংশীদারিত্বমূলক একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা স্বীকার করে জানানো হয়েছে, প্রকল্পটির কারণে বাংলাদেশে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না।
এর মাধ্যমে অভিন্ন বরাক নদীর পানিও সরিয়ে নেওয়া হবে না বলে সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২২ নভেম্বর বলা হয়েছে। আমরা মনে করি, এই বিবৃতি চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই দেওয়া উচিত ছিল। তাতে করে যেমন ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকত না, তেমনই বাংলাদেশের উদ্বেগ নিরসনে তাদের সদিচ্ছাও স্পষ্ট হতো। ঢাকার পক্ষ থেকে 'কড়া বার্তা' দিয়ে নয়াদিলি্লর কাছে যেভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে, আমরা তা সমর্থন করি। টিপাইমুখ প্রকল্প সংক্রান্ত সবকিছু আলোচনার জন্য ভারতে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানোর বাংলাদেশি প্রস্তাবও যুক্তিযুক্ত। তবে ২০০৯ সালে পাঠানো প্রতিনিধি দল নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠেছিল, এবার তার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। কাম্য নয় জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভেদ ও কাদা ছোড়াছুড়ি। অবশ্য গত কয়েক দিনের বক্তৃতা, বিবৃতি ও আলোচনায় টিপাইমুখ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের ব্যবধান আমাদের কাছে সামান্যই মনে হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এক জনসভায় ভাষণ দানকালে টিপাইমুখ ইস্যুতে সরকারকে সহযোগিতার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা যথেষ্ট গঠনমূলক। বলা চলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিরোধী দলের দিক থেকে প্রথমবারের মতো দায়িত্বশীল অবস্থান। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই প্রস্তাবকে যেভাবে স্বাগত জানিয়েছেন, তাও আমাদের আশাবাদী করে তোলে। টিপাইমুখ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের কাঙ্ক্ষিত সমাধান সূত্রও অভিন্ন। সংসদে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিরোধীদলীয় নেত্রীর চিঠি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্তা এবং সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে বরাক তথা সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকায় যৌথ সমীক্ষার দাবি জানানো হয়েছে। আমরা মনে করি, এর বিকল্প নেই। টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যাপারে উভয় দেশ এবং সীমান্তের দুই পারের জনসাধারণের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় এটি সহায়ক হবে। আমরা আশা করি, নয়াদিলি্ল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি ও রেওয়াজ মেনে নিয়ে যৌক্তিক ও বিজ্ঞানসম্মত এই প্রস্তাবে আন্তরিকতার সঙ্গে সাড়া দেবে। প্রস্তাবিত প্রতিনিধি দলের সফর সফল করে তোলার ক্ষেত্রেও সদিচ্ছার প্রমাণ চাই আমরা। তারও আগে টিপাইমুখ প্রকল্প এবং আরও ভাটিতে ফুলেরতলে যে ব্যারেজ স্থাপনের কথা শোনা যাচ্ছে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য বাংলাদেশের কাছে সরবরাহ করবে। সীমান্ত বিরোধ, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ঘাটতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মতো ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে যখন চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করছে, তখন একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে সন্দেহের মায়াবী জাল বিস্তারের সুযোগ ভারত দেবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি। তবে এটা মনে রাখা জরুরি, আমাদের জাতীয় ঐক্যই পারে নয়াদিলি্লর কাছ থেকে এই ইস্যুতে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা আদায় করতে। জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের প্রথম সোপান প্রস্তাবিত প্রতিনিধি দলটি উভয় দলের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠনের
মধ্য দিয়েই রচিত হোক।
মধ্য দিয়েই রচিত হোক।
No comments