নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষা নাজুক by মিজানুর রহমান নান্নু,
নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম অত্যন্ত নাজুক। বর্ষায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন কমে যায়, অনেক শিক্ষকও অনুপস্থিত থাকেন। তবে শিক্ষকদের গড়হাজিরা অন্য সময়েও চলতে থাকে। নিয়মিত নজরদারি করা হয় না। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, দেশের অন্যান্য জেলায় শিক্ষা কার্যক্রমকে যেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়, তেমনটি দেখা হয় না এ অঞ্চলের ক্ষেত্রে।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকার বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে হাওর উন্নয়নে। কিন্তু বাস্তবে তার দেখা তেমন মেলেনি। অবহেলিত থেকে গেছে এ অঞ্চলের শিক্ষা কার্যক্রম। এ কারণে হাওরাঞ্চলের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার বেশ কম।
খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন, কলমাকান্দা, আটপাড়া ও বারহাট্টা উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল। বছরের ছয় মাস বানের পানিতে ভাসতে থাকে গোটা হাওরাঞ্চল। এ ছয় মাসই প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে স্কুলমুখো হতে পারে না বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। তাই প্রাথমিক শিক্ষা থেকে অনেক শিশু অকালে ঝরে পড়ে। শিক্ষকরাও এ সময় অনুপস্থিত থাকেন ব্যাপক হারে, তা মনিটরিং করা হয় না প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে।
জেলার হাওরাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩০০-এর কিছু বেশি। পুরোপুরি হাওরভিত্তিক খালিয়াজুরী উপজেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০টি ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩৬টি। এর মধ্যে জিয়াখড়া, ইছাপুর, মেন্দিপুর, সাতগাঁও সরকারি প্রাথমিক স্কুল ছাড়া অন্য স্কুলগুলোয় বর্ষায় নৌকা ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়। মদন উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৪টি। এর মধ্যে কাইকড়িয়া, পদারকোনা, মান্দারবাড়ি ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ থাকলেও বর্ষাকালে বাকি সব স্কুল দুর্গম হয়ে পড়ে। মোহনগঞ্জ উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০টি। কলমাকান্দায় ৭৫টি।
অভিভাবকরা জানান, ছেলেমেয়েরা বছরের ছয় মাস স্কুলে যেতে না পারায় শিক্ষার ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত ঘটে। মা-বাবাদের অনেকে স্কুল বাদ দিয়ে ছেলেমেয়েদের গৃহস্থালির কাজে লাগিয়ে দেন। যাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল তাঁরা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য শহরে পাঠান। গতকাল বৃহস্পতিবার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাওর অধ্যুষিত কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে শিক্ষার বেহাল।
সকাল ১১টায় পূর্ব তেঁতুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুঙ্গি পরে ক্লাস নিচ্ছিলেন। একজন সহকারী ক্লাসে থাকলেও বাকি দুজন ক্লাস ফেলে ছিলেন পাশের চায়ের দোকানে। সাংবাদিক এসেছে শুনে ছুটে আসেন। ৭ নম্বর গাগলাজুড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছিল সকাল ১১টার দিকে। এ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র তৌকির আহম্মেদ রাফী বলে, বর্ষায় নৌকায় করে, সাঁকো পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। তিন কিলোমিটার দূর গাগলাজুড় থেকে স্কুলে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। সামনে সমাপনী পরীক্ষা, তাই এখন স্যারের বাসায় থাকছি। কামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩৬১ জন। প্রথম শ্রেণীর ১২৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একটি মাত্র কক্ষ। ক্লাসে বেঞ্চের যেমন অভাব, তেমনি শিক্ষকও প্রয়োজনের তুলনায় কম। পানির টিউবওয়েল নেই। এবার ২৩ জন পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে। এক ছাত্র ও এক ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। ওই ছাত্রীকে মা-বাবা বিয়ে দেবেন বলে শোনা গেছে। আর ছাত্রটি মাছ ধরার কাজে লেগে গেছে।
চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী হামিদা বলে, 'এখন শুকনা, তাই ছাত্রছাত্রী বেশি। বর্ষায় নৌকা দিয়ে আসি। তখন কেউ আসে, কেউ ডরাইয়া আসে না।' স্কুলে ২৩ জন সমাপনী পরীক্ষার্থীর কাউকে পাওয়া গেল না। প্রধান শিক্ষক কাজী মশিউর রহমান জানান, সবাই ছবি তুলতে উপজেলা সদরে গেছে।
শ্যামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৩০২ জন। পাঁচজন কর্মরত শিক্ষকের মধ্যে গতকাল অনুপস্থিত ছিলেন একজন। পঞ্চম শ্রেণীতে ২৬ জনের মধ্যে ১৬ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। চতুর্থ শ্রেণীতে ৪২ জনের মধ্যে ২৩ জন উপস্থিত। তৃতীয় শ্রেণীতে ৫৮ জনের মধ্যে ৩৩ জন উপস্থিত। মান্দারোয়া গ্রামে অবস্থিত স্কুলটির পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সীমা আক্তার বলে, 'বর্ষায় ঢেউ উঠলে স্কুলে আসি না।'
খালিয়াজুরী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল হক বাঙ্গালী এ প্রতিবেদককে বলেন, হাওরাঞ্চলে স্কুল পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। স্কুল পরিদর্শনে যে ভাতা দেওয়া হয় তার চেয়ে পরিদর্শনের ব্যয় চারগুণ বেশি লাগে। প্রতি মাসে ৪০০ টাকা ভাতা দিয়ে আদৌ এতগুলো স্কুল ভিজিট সম্ভব নয়। হাওরাঞ্চলে বদলিকে অনেকে শাস্তিমূলক হিসেবে গণ্য করেন। টিইও (উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) ও এটিইওরা (সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) এসব এলাকায় কর্মস্থলে নিয়মিত থাকতে চান না।
খালিয়াজুরী উপজেলার চাকুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান রহমত আলী জানান, তাঁর ইউনিয়নের মকিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। আগে ইউনিয়ন পরিষদের তিনটি নৌকা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হতো। পরিষদ থেকে মাঝিদের টাকা-পয়সা দেওয়া হতো। এবারও তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, স্কুলে যাতায়াতের ব্যবস্থা করবেন।
রহমত আলী অভিযোগ করেন, বেশির ভাগ শিক্ষককে বাজারে আড্ডা দিতে দেখা যায়। তাঁরা নিয়মিত বেতন তুলে নিচ্ছেন। শিক্ষা কর্মকর্তারা স্কুল পরিদর্শনে আসার প্রস্তুতি নিলে মোবাইল ফোনে সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। স্কুল কমিটিতে রাজনৈতিক নেতারা সদস্য থাকেন। ফলে অনেকে এর ফায়দা নিয়ে থাকেন। শিক্ষা অফিসের মনিটরিং নেই ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, মদন, কলমাকান্দা, আটপাড়া ও বারহাট্টা উপজেলার কিছু অংশ নিয়ে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল। বছরের ছয় মাস বানের পানিতে ভাসতে থাকে গোটা হাওরাঞ্চল। এ ছয় মাসই প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে স্কুলমুখো হতে পারে না বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। তাই প্রাথমিক শিক্ষা থেকে অনেক শিশু অকালে ঝরে পড়ে। শিক্ষকরাও এ সময় অনুপস্থিত থাকেন ব্যাপক হারে, তা মনিটরিং করা হয় না প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে।
জেলার হাওরাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩০০-এর কিছু বেশি। পুরোপুরি হাওরভিত্তিক খালিয়াজুরী উপজেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০টি ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩৬টি। এর মধ্যে জিয়াখড়া, ইছাপুর, মেন্দিপুর, সাতগাঁও সরকারি প্রাথমিক স্কুল ছাড়া অন্য স্কুলগুলোয় বর্ষায় নৌকা ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়। মদন উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৪টি। এর মধ্যে কাইকড়িয়া, পদারকোনা, মান্দারবাড়ি ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ থাকলেও বর্ষাকালে বাকি সব স্কুল দুর্গম হয়ে পড়ে। মোহনগঞ্জ উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০টি। কলমাকান্দায় ৭৫টি।
অভিভাবকরা জানান, ছেলেমেয়েরা বছরের ছয় মাস স্কুলে যেতে না পারায় শিক্ষার ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত ঘটে। মা-বাবাদের অনেকে স্কুল বাদ দিয়ে ছেলেমেয়েদের গৃহস্থালির কাজে লাগিয়ে দেন। যাঁরা আর্থিকভাবে সচ্ছল তাঁরা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য শহরে পাঠান। গতকাল বৃহস্পতিবার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাওর অধ্যুষিত কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে শিক্ষার বেহাল।
সকাল ১১টায় পূর্ব তেঁতুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুঙ্গি পরে ক্লাস নিচ্ছিলেন। একজন সহকারী ক্লাসে থাকলেও বাকি দুজন ক্লাস ফেলে ছিলেন পাশের চায়ের দোকানে। সাংবাদিক এসেছে শুনে ছুটে আসেন। ৭ নম্বর গাগলাজুড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছিল সকাল ১১টার দিকে। এ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র তৌকির আহম্মেদ রাফী বলে, বর্ষায় নৌকায় করে, সাঁকো পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। তিন কিলোমিটার দূর গাগলাজুড় থেকে স্কুলে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। সামনে সমাপনী পরীক্ষা, তাই এখন স্যারের বাসায় থাকছি। কামালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩৬১ জন। প্রথম শ্রেণীর ১২৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একটি মাত্র কক্ষ। ক্লাসে বেঞ্চের যেমন অভাব, তেমনি শিক্ষকও প্রয়োজনের তুলনায় কম। পানির টিউবওয়েল নেই। এবার ২৩ জন পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে। এক ছাত্র ও এক ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না। ওই ছাত্রীকে মা-বাবা বিয়ে দেবেন বলে শোনা গেছে। আর ছাত্রটি মাছ ধরার কাজে লেগে গেছে।
চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী হামিদা বলে, 'এখন শুকনা, তাই ছাত্রছাত্রী বেশি। বর্ষায় নৌকা দিয়ে আসি। তখন কেউ আসে, কেউ ডরাইয়া আসে না।' স্কুলে ২৩ জন সমাপনী পরীক্ষার্থীর কাউকে পাওয়া গেল না। প্রধান শিক্ষক কাজী মশিউর রহমান জানান, সবাই ছবি তুলতে উপজেলা সদরে গেছে।
শ্যামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ৩০২ জন। পাঁচজন কর্মরত শিক্ষকের মধ্যে গতকাল অনুপস্থিত ছিলেন একজন। পঞ্চম শ্রেণীতে ২৬ জনের মধ্যে ১৬ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। চতুর্থ শ্রেণীতে ৪২ জনের মধ্যে ২৩ জন উপস্থিত। তৃতীয় শ্রেণীতে ৫৮ জনের মধ্যে ৩৩ জন উপস্থিত। মান্দারোয়া গ্রামে অবস্থিত স্কুলটির পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সীমা আক্তার বলে, 'বর্ষায় ঢেউ উঠলে স্কুলে আসি না।'
খালিয়াজুরী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শহীদুল হক বাঙ্গালী এ প্রতিবেদককে বলেন, হাওরাঞ্চলে স্কুল পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। স্কুল পরিদর্শনে যে ভাতা দেওয়া হয় তার চেয়ে পরিদর্শনের ব্যয় চারগুণ বেশি লাগে। প্রতি মাসে ৪০০ টাকা ভাতা দিয়ে আদৌ এতগুলো স্কুল ভিজিট সম্ভব নয়। হাওরাঞ্চলে বদলিকে অনেকে শাস্তিমূলক হিসেবে গণ্য করেন। টিইও (উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) ও এটিইওরা (সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা) এসব এলাকায় কর্মস্থলে নিয়মিত থাকতে চান না।
খালিয়াজুরী উপজেলার চাকুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান রহমত আলী জানান, তাঁর ইউনিয়নের মকিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। আগে ইউনিয়ন পরিষদের তিনটি নৌকা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হতো। পরিষদ থেকে মাঝিদের টাকা-পয়সা দেওয়া হতো। এবারও তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, স্কুলে যাতায়াতের ব্যবস্থা করবেন।
রহমত আলী অভিযোগ করেন, বেশির ভাগ শিক্ষককে বাজারে আড্ডা দিতে দেখা যায়। তাঁরা নিয়মিত বেতন তুলে নিচ্ছেন। শিক্ষা কর্মকর্তারা স্কুল পরিদর্শনে আসার প্রস্তুতি নিলে মোবাইল ফোনে সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। স্কুল কমিটিতে রাজনৈতিক নেতারা সদস্য থাকেন। ফলে অনেকে এর ফায়দা নিয়ে থাকেন। শিক্ষা অফিসের মনিটরিং নেই ও প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
No comments