সমুদ্রসম্পদ-অরক্ষিত উপকূলে সুরক্ষিত জলদস্যু by শেখ রোকন
যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়ছে; ঘন ঘন নিম্নচাপে সমুদ্রযাত্রা ভণ্ডুল কিংবা নিষ্ফল হয়; তারা লড়তে ভয় পায় না। কিন্তু অ-প্রাকৃতিক বিপদ মোকাবেলা করবে তারা কীভাবে? জলদস্যুর আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে তো মনের সাহস ও দেশের বল কাজে আসে না। মাঝে মধ্যে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটে যে ডাঙায় নিরাপদে থাকা জেলেদেরও কাফনের কাপড় পরেমিছিল-সমাবেশ করতে হয়
সমুদ্রের বিস্তৃতি ও গভীরতা ব্যাপক হওয়ার কারণেই কি-না জানি না; বঙ্গোপসাগর সংক্রান্ত আলোচনা কিংবা লেখালেখিও সীমাবদ্ধ থাকে এর আজদাহা বিষয়গুলো নিয়ে_ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ এবং জাতিসংঘে এ নিয়ে সালিশির পরিণতি; চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সামর্থ্য, মংলা বন্দরের কার্যকারিতা, এই দুই বন্দর চীন, ভারত, নেপাল, ভুটানের সরাসরি ব্যবহারযোগ্যতার সম্ভাব্যতা; বহুল আলোচিত গভীর সমুদ্রবন্দরের সম্ভাব্য অবস্থান, এর ব্যবহার ও ঠিকাদারি নিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলোর কথিত দ্বৈরথ; সমুদ্রবক্ষের তেল-গ্যাস সম্পদ, এতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শ্যেনদৃষ্টি, আহরণের নীতি, কারিগরি বিবেচনা; মৎস্যসম্পদ, বিদেশি জেলেদের দৌরাত্ম্য; পরিবেশ দূষণ, সুন্দরবনের স্বাস্থ্য, লবণাক্ততা; জলবায়ু পরিবর্তন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, উপকূলীয় বাঁধ, সবুজ বেষ্টনী ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয় হচ্ছে সমুদ্রসীমায় সার্বভৌমত্বের অক্ষুণ্নতা।
সন্দেহ নেই, এগুলো অতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এসব প্রশ্নে সতর্কতা ছাড়া সমুদ্রসম্পদের বিপুল সম্ভাবনা নিজেদের কাজে লাগানো যাবে না। কিন্তু দৃশ্যমান বড় বড় ইস্যুর ভিড়ে তুলনামূলক ছোট অথচ সমুদ্র উপকূলবর্তী লাখ লাখ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো সম্পর্কে নির্লিপ্ততা কারও কাম্য হতে পারে না। আর রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক বিষয় জড়িত থাকলেই যে তা বড় ইস্যু হবে, অন্যথায় ছোট, অগ্রাহ্যনীয়, সে তত্ত্বেরই-বা ভিত্তি কোথায়? কোনো পরিবারের সর্বস্ব হারানো কিংবা উপার্জনক্ষম ব্যক্তির হতাহত হওয়া হয়তো রাষ্ট্র ও সমাজের মানদণ্ডে বড় ক্ষতি নয়; কিন্তু ওই পরিবারের জন্য তো অস্তিত্বের প্রশ্ন! ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে আসলে উপকূলীয় অঞ্চলে জলদস্যুর উৎপাতের কথাই বলছি। আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতিক, নাগরিক সমাজ উপকূলীয় অঞ্চলের এই নীরব বিভীষিকা সম্পর্কে আশ্চর্য রকম নির্লিপ্ত। এমনকি সংবাদমাধ্যমও দায়সারা ভূমিকায়। উপকূলীয় অঞ্চলে তালগাছের আগামরা রোগ আমাদের কাছে যত বড় খবর; তালবীথির পাশের কুটিরে থাকা দিন এনে দিন খাওয়া জেলে পরিবারটির কারও সর্বস্ব হারানো, অপহৃত হওয়া, জখম, এমনকি প্রাণ হারানোও তত বড় খবর নয়। সমুদ্র দূষণের কারণে অণুজীবের জীবন নিয়ে কেউ কেউ চিন্তিত; কিন্তু জীবিকার তাগিদে মাছ ধরতে গিয়ে প্রাণ হারানো জেলেদের ব্যাপারে তাদের টুঁ শব্দটি নেই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, উপকূলীয় অঞ্চলে মগ জলদস্যুদের লুটপাট, অত্যাচারের কথা আমাদের দেশের কর্তাদের তখন যেমন বিরাট মাথাব্যথার কারণ ছিল; বিজাতীয় সম্পৃক্ততা ছিল বলেই কি-না, ওইসব অঘটন কয়েকশ' বছর পরও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। অথচ একই কায়দায় উপকূলীয় অঞ্চলে অহরহ, হ্যাঁ অহরহই, জলদস্যুরা সমুদ্রগামী জেলেদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কথা নেই। এই জলদস্যুদের মধ্যে 'বিদেশি' ফ্যাক্টর অনুপস্থিত বলেই। গত দুই মাসের সংবাদপত্র খুঁজলে দেখা যাবে জীবিকার তাগিদে সমুদ্রে গিয়ে কত জেলের জীবন ও সম্পত্তি বিপন্ন হয়েছে।
গত বুধবার সমকালের লোকালয় পাতায় একত্রে ছাপা হওয়া দুটি খবর : ২৪ অক্টোবর রাতে সুন্দরবন সংলগ্ন বয়া এলাকায় রাত্রিকালীন আশ্রয়ে থাকা ৪০টি মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট চালিয়েছে উপকূলীয় জলদস্যু বাহিনী। অপহরণ করে নিয়ে গেছে ৬৮ জেলেসহ ১১টি ট্রলার। পরদিন রাতে হাতিয়ার কাছে উপকূলে অপহরণের শিকার হয়েছে আরও ১৩টি ট্রলার। ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরের শেষ দুই সপ্তাহে বাগেরহাটের শরণখোলা ও মংলা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কমবেশি একশ' জেলে ও ১১টি ট্রলার অপহৃত হয়েছে। লুটপাটের শিকার হয়েছে আরও ৯৫টি ট্রলার। জলদস্যুরা জখম করে ফেলে রেখে গেছে অন্তত ৩৫ জেলেকে। এর আগে ২৩-২৪ আগস্ট বরগুনা ও বাগেরহাট উপকূলে লুটপাট হয়েছে ৮৫টি ট্রলার। অপহৃত হয়েছে ৭৫ জন জেলে ও ১০টি ট্রলার।
এসব বড় বড় অঘটন; দু'একজন জেলে, দু'একটি ট্রলার ছিনতাই হওয়ার খবর হয়তো সংশ্লিষ্ট পরিবারের আহাজারির মধ্য দিয়ে উপকূলেই মিলিয়ে যায়, সংবাদমাধ্যমে আসে না। অপহৃত ট্রলার মুক্ত হতে বেশি সময় লাগে না, মহাজন নিজের গরজেই মুক্তিপণ দেন। কিন্তু দরিদ্র জেলের মুক্তি সহজ নয়। পণের টাকা জোগাড় করতে না পারলে ক্রীতদাসের মতো খেটে তা শোধ করতে হয়। অনেক সময় দস্যু দল এত ঝামেলায় না গিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দেয়। প্রাকৃতিক নানা বিপদ কাটিয়ে যদি ওই জেলে তীরে ফিরতে পারে তো ভালো, না ফিরতে পারলেও মন্দ কি! আবার তো একই চক্র!
বস্তুত, শত শত বছর ধরে সাগরের বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই উপকূলীয় জেলেরা জীবিকার সন্ধানে যাচ্ছে। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে গভীর-অগভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা আবহমানকাল থেকেই ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নিম্নচাপ মোকাবেলা করেছে। কিন্তু সেজন্য নিজস্ব হিসাব-নিকাশ তৈরি রয়েছে। কোন মাসের কোন সপ্তাহে ঝড় হতে পারে, অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমাতে সাগরের পরিস্থিতি কেমন থাকবে_ সব নখদর্পণে জেলেদের। এখন যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়ছে; ঘন ঘন নিম্নচাপে সমুদ্রযাত্রা ভণ্ডুল কিংবা নিষ্ফল হয়; তারা লড়তে ভয় পায় না। কিন্তু অ-প্রাকৃতিক বিপদ মোকাবেলা করবে তারা কীভাবে? জলদস্যুর আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে তো মনের সাহস ও দেহের বল কাজে আসে না। মাঝে মধ্যে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটে যে ডাঙায় নিরাপদে থাকা জেলেদেরও কাফনের কাপড় পরে মিছিল-সমাবেশ করতে হয়।
এখনকার জলদস্যুরা মগদের মতো অপরিচিত নয়। কোন বাহিনী কবে-কোথায় দস্যুতা করল, সংবাদমাধ্যমে তার নামধামও আসে। কারা কোন এলাকায় লুটপাট করবে, তা নিয়ে দস্যু দলের মধ্যে অলিখিত সমঝোতাও রয়েছে। খবর রয়েছে, উপকূলীয় এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দস্যুরা 'কর' আদায় ব্যবস্থাও চালু করেছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অথৈ সমুদ্রের হাজারো বিপদ ঠেলে উপার্জিত অর্থের বড় অংশ যদি স্বেচ্ছায় দস্যু দলের কাছে পেঁৗছে দেওয়া হয়, তা হলে ঝামেলা হয় না। কিন্তু তাতে করে পথ চেয়ে থাকা পরিবার-পরিজনের মুখে খাবার জোটানো কঠিন। জেলেরা স্বভাবতই অপহৃত ও প্রহৃত হওয়ার ঝুঁকিই নেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা উপকূলজুড়ে এই অরাজকতা চলতে দেব কি-না? সমাজবিরোধী এ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিকল্প নেই। বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠিত দস্যুবাহিনীর নিজস্ব অর্থ আদায় ব্যবস্থা বহুল আলোচিত সার্বভৌমত্ব ও আইনের শাসনের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। অস্বীকার করা যাবে না, কোস্টগার্ড মাঝে মধ্যে অভিযানে নামে। কখনও কখনও জলদস্যুদের কেউ কেউ ধরা পড়ে, গোলাগুলিতে মারাও যায়। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ও সাময়িক অভিযানে যে সুফল মেলে না, তার প্রমাণ আমরা ইতিপূর্বে অনেকবার পেয়েছি। আসলে জলদস্যু দমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততাও জরুরি। এ অভিযোগ তো পুরনো যে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রভাবশালীরা নির্বাচনসহ অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে জলদস্যুদের ব্যবহার করে থাকে। জলদস্যু দমনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়ার কারণ হিসেবে প্রশাসন থেকে যান ও জনবল সংকটের কথা বলা হয়ে থাকে। উন্নয়নশীল একটি দেশের পক্ষে এমন সীমাবদ্ধতা কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে আমরা বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে পারি?
কর্তাদের মনে রাখা ভালো, উপকূলীয় অঞ্চলে জলদস্যুদের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, সমুদ্রসীমার বিরোধ, জলবায়ু পরিবর্তন, গভীর সমুদ্রবন্দর প্রভৃতি কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যাবে না। আজ যে জলদস্যু জেলেদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, কাল তারা যে উপকূলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আঘাত হানবে না; আজ যে জলদস্যু অর্থের লোভে খেটে খাওয়া মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে, কাল সে যে বিদেশি কোনো শক্তির সঙ্গে হাত মেলাবে না; সে নিশ্চয়তা কে দেবে? জলদস্যুদের এমন কীর্তি ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
সন্দেহ নেই, এগুলো অতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এসব প্রশ্নে সতর্কতা ছাড়া সমুদ্রসম্পদের বিপুল সম্ভাবনা নিজেদের কাজে লাগানো যাবে না। কিন্তু দৃশ্যমান বড় বড় ইস্যুর ভিড়ে তুলনামূলক ছোট অথচ সমুদ্র উপকূলবর্তী লাখ লাখ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো সম্পর্কে নির্লিপ্ততা কারও কাম্য হতে পারে না। আর রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক বিষয় জড়িত থাকলেই যে তা বড় ইস্যু হবে, অন্যথায় ছোট, অগ্রাহ্যনীয়, সে তত্ত্বেরই-বা ভিত্তি কোথায়? কোনো পরিবারের সর্বস্ব হারানো কিংবা উপার্জনক্ষম ব্যক্তির হতাহত হওয়া হয়তো রাষ্ট্র ও সমাজের মানদণ্ডে বড় ক্ষতি নয়; কিন্তু ওই পরিবারের জন্য তো অস্তিত্বের প্রশ্ন! ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে আসলে উপকূলীয় অঞ্চলে জলদস্যুর উৎপাতের কথাই বলছি। আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতিক, নাগরিক সমাজ উপকূলীয় অঞ্চলের এই নীরব বিভীষিকা সম্পর্কে আশ্চর্য রকম নির্লিপ্ত। এমনকি সংবাদমাধ্যমও দায়সারা ভূমিকায়। উপকূলীয় অঞ্চলে তালগাছের আগামরা রোগ আমাদের কাছে যত বড় খবর; তালবীথির পাশের কুটিরে থাকা দিন এনে দিন খাওয়া জেলে পরিবারটির কারও সর্বস্ব হারানো, অপহৃত হওয়া, জখম, এমনকি প্রাণ হারানোও তত বড় খবর নয়। সমুদ্র দূষণের কারণে অণুজীবের জীবন নিয়ে কেউ কেউ চিন্তিত; কিন্তু জীবিকার তাগিদে মাছ ধরতে গিয়ে প্রাণ হারানো জেলেদের ব্যাপারে তাদের টুঁ শব্দটি নেই।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, উপকূলীয় অঞ্চলে মগ জলদস্যুদের লুটপাট, অত্যাচারের কথা আমাদের দেশের কর্তাদের তখন যেমন বিরাট মাথাব্যথার কারণ ছিল; বিজাতীয় সম্পৃক্ততা ছিল বলেই কি-না, ওইসব অঘটন কয়েকশ' বছর পরও কিংবদন্তি হয়ে রয়েছে। অথচ একই কায়দায় উপকূলীয় অঞ্চলে অহরহ, হ্যাঁ অহরহই, জলদস্যুরা সমুদ্রগামী জেলেদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কথা নেই। এই জলদস্যুদের মধ্যে 'বিদেশি' ফ্যাক্টর অনুপস্থিত বলেই। গত দুই মাসের সংবাদপত্র খুঁজলে দেখা যাবে জীবিকার তাগিদে সমুদ্রে গিয়ে কত জেলের জীবন ও সম্পত্তি বিপন্ন হয়েছে।
গত বুধবার সমকালের লোকালয় পাতায় একত্রে ছাপা হওয়া দুটি খবর : ২৪ অক্টোবর রাতে সুন্দরবন সংলগ্ন বয়া এলাকায় রাত্রিকালীন আশ্রয়ে থাকা ৪০টি মাছ ধরার ট্রলারে লুটপাট চালিয়েছে উপকূলীয় জলদস্যু বাহিনী। অপহরণ করে নিয়ে গেছে ৬৮ জেলেসহ ১১টি ট্রলার। পরদিন রাতে হাতিয়ার কাছে উপকূলে অপহরণের শিকার হয়েছে আরও ১৩টি ট্রলার। ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরের শেষ দুই সপ্তাহে বাগেরহাটের শরণখোলা ও মংলা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে কমবেশি একশ' জেলে ও ১১টি ট্রলার অপহৃত হয়েছে। লুটপাটের শিকার হয়েছে আরও ৯৫টি ট্রলার। জলদস্যুরা জখম করে ফেলে রেখে গেছে অন্তত ৩৫ জেলেকে। এর আগে ২৩-২৪ আগস্ট বরগুনা ও বাগেরহাট উপকূলে লুটপাট হয়েছে ৮৫টি ট্রলার। অপহৃত হয়েছে ৭৫ জন জেলে ও ১০টি ট্রলার।
এসব বড় বড় অঘটন; দু'একজন জেলে, দু'একটি ট্রলার ছিনতাই হওয়ার খবর হয়তো সংশ্লিষ্ট পরিবারের আহাজারির মধ্য দিয়ে উপকূলেই মিলিয়ে যায়, সংবাদমাধ্যমে আসে না। অপহৃত ট্রলার মুক্ত হতে বেশি সময় লাগে না, মহাজন নিজের গরজেই মুক্তিপণ দেন। কিন্তু দরিদ্র জেলের মুক্তি সহজ নয়। পণের টাকা জোগাড় করতে না পারলে ক্রীতদাসের মতো খেটে তা শোধ করতে হয়। অনেক সময় দস্যু দল এত ঝামেলায় না গিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দেয়। প্রাকৃতিক নানা বিপদ কাটিয়ে যদি ওই জেলে তীরে ফিরতে পারে তো ভালো, না ফিরতে পারলেও মন্দ কি! আবার তো একই চক্র!
বস্তুত, শত শত বছর ধরে সাগরের বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই উপকূলীয় জেলেরা জীবিকার সন্ধানে যাচ্ছে। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে গভীর-অগভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা আবহমানকাল থেকেই ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নিম্নচাপ মোকাবেলা করেছে। কিন্তু সেজন্য নিজস্ব হিসাব-নিকাশ তৈরি রয়েছে। কোন মাসের কোন সপ্তাহে ঝড় হতে পারে, অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমাতে সাগরের পরিস্থিতি কেমন থাকবে_ সব নখদর্পণে জেলেদের। এখন যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে পড়ছে; ঘন ঘন নিম্নচাপে সমুদ্রযাত্রা ভণ্ডুল কিংবা নিষ্ফল হয়; তারা লড়তে ভয় পায় না। কিন্তু অ-প্রাকৃতিক বিপদ মোকাবেলা করবে তারা কীভাবে? জলদস্যুর আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে তো মনের সাহস ও দেহের বল কাজে আসে না। মাঝে মধ্যে পরিস্থিতির এতটাই অবনতি ঘটে যে ডাঙায় নিরাপদে থাকা জেলেদেরও কাফনের কাপড় পরে মিছিল-সমাবেশ করতে হয়।
এখনকার জলদস্যুরা মগদের মতো অপরিচিত নয়। কোন বাহিনী কবে-কোথায় দস্যুতা করল, সংবাদমাধ্যমে তার নামধামও আসে। কারা কোন এলাকায় লুটপাট করবে, তা নিয়ে দস্যু দলের মধ্যে অলিখিত সমঝোতাও রয়েছে। খবর রয়েছে, উপকূলীয় এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দস্যুরা 'কর' আদায় ব্যবস্থাও চালু করেছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অথৈ সমুদ্রের হাজারো বিপদ ঠেলে উপার্জিত অর্থের বড় অংশ যদি স্বেচ্ছায় দস্যু দলের কাছে পেঁৗছে দেওয়া হয়, তা হলে ঝামেলা হয় না। কিন্তু তাতে করে পথ চেয়ে থাকা পরিবার-পরিজনের মুখে খাবার জোটানো কঠিন। জেলেরা স্বভাবতই অপহৃত ও প্রহৃত হওয়ার ঝুঁকিই নেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা উপকূলজুড়ে এই অরাজকতা চলতে দেব কি-না? সমাজবিরোধী এ শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিকল্প নেই। বিভিন্ন নামে প্রতিষ্ঠিত দস্যুবাহিনীর নিজস্ব অর্থ আদায় ব্যবস্থা বহুল আলোচিত সার্বভৌমত্ব ও আইনের শাসনের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না। অস্বীকার করা যাবে না, কোস্টগার্ড মাঝে মধ্যে অভিযানে নামে। কখনও কখনও জলদস্যুদের কেউ কেউ ধরা পড়ে, গোলাগুলিতে মারাও যায়। কিন্তু বিচ্ছিন্ন ও সাময়িক অভিযানে যে সুফল মেলে না, তার প্রমাণ আমরা ইতিপূর্বে অনেকবার পেয়েছি। আসলে জলদস্যু দমনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততাও জরুরি। এ অভিযোগ তো পুরনো যে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রভাবশালীরা নির্বাচনসহ অনেক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে জলদস্যুদের ব্যবহার করে থাকে। জলদস্যু দমনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়ার কারণ হিসেবে প্রশাসন থেকে যান ও জনবল সংকটের কথা বলা হয়ে থাকে। উন্নয়নশীল একটি দেশের পক্ষে এমন সীমাবদ্ধতা কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে আমরা বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে পারি?
কর্তাদের মনে রাখা ভালো, উপকূলীয় অঞ্চলে জলদস্যুদের জিম্মায় ছেড়ে দিয়ে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান, সমুদ্রসীমার বিরোধ, জলবায়ু পরিবর্তন, গভীর সমুদ্রবন্দর প্রভৃতি কাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা যাবে না। আজ যে জলদস্যু জেলেদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে, কাল তারা যে উপকূলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আঘাত হানবে না; আজ যে জলদস্যু অর্থের লোভে খেটে খাওয়া মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে, কাল সে যে বিদেশি কোনো শক্তির সঙ্গে হাত মেলাবে না; সে নিশ্চয়তা কে দেবে? জলদস্যুদের এমন কীর্তি ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
No comments